ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

‘নেই কেন সেই পাখী?’

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ২১:০৩, ৩১ আগস্ট ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

না, ওকে আমি চিনতাম না। দেখা হয়নি, পরিচয়ও হয়নি ওর সঙ্গে। কিন্তু ওর মা’কে আমি চিনতাম- প্রায় বছর ৩৫ আগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে আমার শিক্ষার্থী ছিল ফারাহ্ হাসিন। ওদের ক’জনার পঠন-পাঠনে মুগ্ধ ছিলাম আমি- আমার গর্ব ও আমার অহংকার ছিল নাজমা, ফারাহ, মাসুদার মতো শিক্ষার্থীরা। পরে তাঁরা সবাই বিভাগেই যোগ দিয়েছিল শিক্ষক হিসেবে। শিক্ষার্থী আর অধ্যাপক হিসেবে উজ্জ্বল নক্ষত্র তাঁরা আমাদের বিভাগের।

যখন জায়ান সামিয়ানের মতো ২৫ বছরের উজ্জ্বল একটি বাংলাদেশী তরুণের প্রয়াণের সংবাদ আমি শুনি, তখন তাঁর মেধা, মনন, আর সম্ভাবনার কথাই সবাই বলছিলেন। আমি খালি ভাবছিলাম, কোন মায়ের কোল খালি করে ছেলেটি চলে গেলো? আজই জানলাম, সে আমার অতি প্রিয় শিক্ষার্থী অধ্যাপক ফারাহ্ হাসিনের পুত্র।

‘প্রকৃতির সবকিছুই যে সব সময়ে নিয়ম মেনে চলে, এমন কথা কিন্তু কেউ বলতে পারেনা’, -এ রকম একটি যুক্তি দিয়েছিলেন প্রয়াত বিমল কর। তাঁর স্বপক্ষে তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘গাছের সবচেয়ে পুরোনো ডালেই সবসময়ে প্রথম ফুল আসে না, প্রথম সে ফুল ফুটতে পারে, গাছের পঞ্চম ডালেও’। বিমল কর আমার খুব প্রিয় লেখক - তাঁর কথা মানি, কিন্তু একমত হই না।

শ্রীযুক্ত করের কথাগুলো আমার মনের মধ্যে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা’ কচ্ছিল জায়ানের মৃত্যু সংবাদ শুনে। এ রকম একটি টগবগে তরুণের অসময়ে চলে যাওয়ার প্রেক্ষিতে শ্রদ্ধেয় বিমল করের পর্যবেক্ষণ, কোন দার্শনিক মতবাদ কিংবা কোন ধর্মীয় ব্যাখ্যা- কোনটাই গ্রাহ্য নয় আমার কাছে। আমি খুব সাধারণ বুদ্ধির মানুষ- তাই আমি খুব সোজা নিয়মেই সবকিছু দেখি।

জায়ান সামিয়ান

আমি ভাবি যে- আগে যে এসেছে, তার আগে চলে যাওয়াটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। আমাদের সন্তানেরা কেন আমাদের আগে যাবে? উত্তরসূরীর মৃত্যুকে মেনে নিতে আমার প্রবল অনীহা।

‘মানুষ মরণশীল এবং যে কোন সময়েই তাঁর ডাক আসতে পারে’ - এ দার্শনিক মতবাদ আমি মানি, কিন্তু তাই বলে এই বয়সে, এ অসময়ে? তার ব্যাখ্যা কোথায়? ‘যা কিছু হয়, ভালোর জন্যেই হয়’, -এ রকমের আপ্তবাক্য প্রচুর শুনেছি, কিন্তু মেনে নিতে পারিনি। এই যে আমাদের সন্তানেরা অপরিণত সময়ে চলে যায় তাতে কি বা কার ভালোটা হয়? এতো অল্প বয়সে যদি তাদের পৃথিবী ছেড়ে যেতে হয়, তাহলে তাদের পৃথিবীতে আসার যুক্তিটাই বা কি? এ সব প্রশ্নের সদুত্তর আমি আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি।

আমি যদি বলি যে, ফারাহর দু:খ আমি বুঝি, তাহলে মিথ্যে বলা হবে। ওঁর মনের মধ্যে কি হচ্ছে, তা আমি কখনো জানবো না। কারণ আমি ওঁর জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। আমি শুধু জানি যে, সে দু:খ আমার ধারণার বাইরে, আমার বোধের বাইরে, ও আমি ছুঁতেও পারবো না। 

‘আধুনিক মানুষের শোকের আয়ু বড় জোর এক বছর’ - একদা বলেছিলেন তুর্কী কবি নাজিম হিকমত। কিন্তু মায়ের শোকের আয়ু? তার কোন শেষ নেই, সে মায়ের অব্যক্ত দু:খ হয়ে থাকে সারা জীবন ‘পাতার নীচে, ছাতার মতোন, পরম ব্যাপ্তিতে’।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি