নড়ছে চড়ছে জাতি
প্রকাশিত : ১৪:০৬, ১৭ আগস্ট ২০১৯ | আপডেট: ১৪:০৭, ১৭ আগস্ট ২০১৯
গুগল থেকে সংগ্রহ
কিছুদিন ধরে কয়েকটি হাসপাতালে যাচ্ছি ছোটভাইয়ের অসুস্থতার জন্য। খেয়াল করে দেখি হাসপাতালে বেশীর ভাগ মানুষ সারাক্ষণ পা নাচায়। কেউ বা হাত। স্থির হয়ে বসে নেই কেউ। বসে থেকেই এদিক ওদিক তাকায়। নীচে কি যেন খোঁজে। হাত-পা চুলকায়।
মার্কেটে যাই। দেখি অনেকে পা ঝাঁকান। অফিসে বসে আছি। অবাক হয়ে দেখি এক সহকর্মী ডেস্কে বসে অনবরত পা নাড়াচ্ছেন। সারাক্ষণই দেখি সবাই শুধু নড়াচড়া করছে। এ সবই এডিস মশার আতংক। সারাটা সময় শুধু ভয়- এই বুঝি মশা কামড়ালো! ডেঙ্গু জ্বর হলো।
মনে মনে ভাবছি, আতংক স্থবিরতা কাটিয়ে আমরা সবাই কি এক নড়াচড়া জাতিতে পরিণত হচ্ছি! আমরা সর্বদা নড়ছি! আমাদের সব গল্প হয় এক মশাকে ঘিরে। মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে আমাদের হাত পা ছোঁড়াছুড়ি দেখে বিদেশীরা হয় তো ভাববে- বাহ; এরা তো বেশ ভালো নাচতে পারে!
এক মেয়েকে দেখি গরমে মোজা পরে হাঁটছে। শতভাগ নিশ্চিত অন্য সময় হলে এ মেয়ে মোজা পরতো না। এখন পরছে ভয়ে। ডেঙ্গু হয়েছে শুনে পরিচিত একজন তার বাসায় সাহায্যকারীকে আর কাজে নেয়নি। যদি তাদের হয়। মশার ভয়ে প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। ফেসবুকে, ফোনে, লেখায়, ঘরের কোণে সব জায়গা দখল করে আছে সে। বেড়াতে যাব, আছি মশার ভয়ে। যদি কামড়ায়? থাক বাবা বেড়ানোই বাদ। যা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে- এই মশা যেন কোনো ভিআইপি ব্যাক্তি। সে (মশা) ভালো থাক। আমরা বরং লুকিয়ে থাকি। কি শক্তি এই গুণধর মশারে বাবা। নাচিয়ে দিচ্ছে পুরো দেশ ও দেশের মানুষকে।
বিদেশ গেলে আমরা বাঙালিরা চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, ডাবের খোসা, ক্যান যাই খাই তা সুবোধ বালকের মতো ডাস্টবিনে ফেলি। পা টিপে টিপে ভদ্র ভাবে রাস্তায় হাঁটি অতি সাবধানে। যেন ধুলো না লাগে রাস্তার গায়ে। নিজে পরিপাটি থাকি। আশপাশও পরিপাটি রাখি। তালমিলিয়ে চলি দেশের নিয়মকানুনের সঙ্গে। তারপর বলি- দেশটা কত সুন্দর! বলে ঢেকুরও তুলি। মনে মনে ভাবি আহা- আমার দেশটা যদি এমন হতো। না পাওয়ার যন্ত্রনায় তখন মনে মনে কিংবা কখনো প্রকাশ্যে গাল দেই নিজ দেশকে, সরকারকে। তারপর একদিন সব সুখ ফেলে দেশে ফিরি। এয়ারপোর্টে নেমেই থু করে থুথু ফেলি মেঝেতে। শব্দ করে হাঁটি। শব্দ করে খাই। কি একটা দেশ বলে দেশের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে টিসু, খাবারের প্যাকেট যা কিছু ময়লা সব ফেলি রাস্তায়। কারণ আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। যা ইচ্ছে তাই করতে পারি। তা করা আমার অধিকার। আবার বলি- এদেশে কোনো সিস্টেম আছে নাকি? নাক সিটকিয়ে সিস্টেমের দোহাই দিয়ে পানের পিক, সিগারেট, কলার খোসা, বিস্কুটের প্যাকেট যেখানে সেখানে ফেলি। আহা; কি স্বর্গরাজ্য। কেউ কিছু বলার নেই।
দেশের প্রতিটি এলাকায় ওয়ার্ড কমিশনার রয়েছেন। যাদের চেহারা দেখা যায় ৫ বছর পর পর। সেই ভোটের সময়। একঝাক সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে তারা আসেন ভোট চাইতে। সে কি বিনয় আর প্রতিশ্রুতি তাদের! যেন জান দিয়ে দিবেন ভোটারদের জন্য। ভোট শেষ, আর দেখা নেই। তাদের যে কি কাজ জানা হয় না আর!
এর মাঝে নাগরিকরা পানিতে ভাসে। ময়লা কাদায় মাখামাখি করে হাঁটে। নাগরিকদের খাবারে পাওয়া যায় ভেজাল, পানিতে জীবানু, শিশু খাদ্যে সিসা। বাতাসে ধুলা। শাসকষ্টে বাড়ে নেবুলাইজারের দাম। অসহায় ও বিপন্ন নাগরিক। এর মাঝে উড়ে এসে জুড়ে বসলো এডিস মশা। নগরপিতার কর্মকর্তারা বলেন, তাদের মারতে গেলে উত্তরের মশা দক্ষিণে যায়। দক্ষিণের মশা যায় উত্তরে। তাদের কি করার আছে? পাখা মেলে উড়ছে মশা।
মশার কামড়ে অসহায় নাগরিকের করুণ মুখ এখন দেখা যায় হাসপাতাল ও টিভির পর্দায়। হাতের নাগালে এখন আর নেই মশা। চালাক হয়ে গেছে সে। সে জানে নাগরিকরা দুর্বল। তাদের মশা মারার কয়েল নেই, ওষুধ নেই, মশারির দাম বেড়ে গেছে। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগী।
রক্তের সন্ধানে মশা নয়, এবার মানুষ ঘোরে রক্তের জন্য। একটি মজার তথ্য দেই। এই মশার কামড়ে মানুষের রক্তের প্লাটিলেট যখন কমে যায়, তখন জীবন বাঁচাতে তাকে বাড়তি প্লাটিলেট দিতে হয়। চার ব্যগ রক্ত থেকে এক ব্যগ প্লাটিলেট পাওয়া যায়।
অনেকেই হয়তো জানি না যে- রক্তের এই প্লাটিলেট মানুষের শরীরে প্রবেশের পূর্বে তা ঠিক রাখতে নাচানাচির মধ্যে রাখতে হয়। অর্থাৎ রক্ত যতক্ষণ না রোগীর শরীরে দেওয়া হয় তার আগ পর্যন্ত ব্যগটিকে সব সময় নড়াচড়ার মধ্যেই রাখতে হয়। না হলে এটি জমাট বেধে যাবে। তার মানে হচ্ছে- রক্ত যে বহন করে নিয়ে যাবে তাকে নাচানাচির মধ্যে থাকতে হবে।
কিছু আগে মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন এক সহকর্মীর বড় বোন। ওর কান্নায় মন ভীষণ খারাপ আমার। চারিদিকে এত মৃত্যু! রাগও লাগছে। আমাদের কি কিছুই করার নেই? বন্ধুরা ফোন করে বলে অস্থির লাগছে। কতদিন থাকবো মশার ভয়ে?
উত্তর জানা নেই।
এক বন্ধুর পরামর্শ, যার যার বাড়ির আশে পাশে সবাই যদি নিজ উদ্যোগে পরিস্কার করা যায়, একদিন যদি সবাই মিলে রাস্তায় নেমে ডাবের খোসা, ক্যান, পানি জমে থাকার পাত্রগুলো নস্ট করে ফেলা হয় তাহলে তো কিছুটা মশা কমবে।
ওর কথাগুলো ভাবছি। প্রতিটা ওয়ার্ডে যারা কমিশনার হিসেবে দায়িত্বে আছেন তারা কি শুনবেন কথাগুলো। পত্রিকায় পড়েছি মশার ওষুধ কেনা বাবদ ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিলো। প্রশ্ন হচ্ছে- এ টাকা কোথায় গেলো?
প্রতিটি ওর্য়াডের কমিশনাররা দয়া করে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কাজে লাগান। যার যার ওয়ার্ড পরিস্কার করুন নিজ দ্বায়িত্বে। আমরা সরকারকে কর দেই। ভোট দেই। নাগরিক হিসেবে আমার অধিকার আছে আপনার কাজের কৈফিয়ত চাওয়ার। এই যে এত মশার ওষুধ কেনা হলো- সেগুলো গেলো কোথায়? কি কাজ করেছেন আপনারা? মশাতো এসব ওষুধ খায়নি। তাহলে কে খেলো এই ওষুধ।
যার এলাকায় যে ওয়ার্ড কমিশনার দায়িত্বে আছেন তার কাছে দলবেঁধে যান। তাকে বলুন তার কর্মীদের নিয়ে পরিবেশ পরিস্কার রাখতে। পাশাপাশি আমরাও সচেতন হই। নিজেই প্রতিজ্ঞা করি, আর একটা ময়লাও আমরা কখনো ফেলবো না রাস্তায়, বাড়ির পাশে।
এসএ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।