পদ্মার ইলিশ, মুক্তিযুদ্ধ, পদ্মা সেতু এবং ইন্দিরা ও হাসিনা
প্রকাশিত : ১৫:৫৩, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২
‘রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে/জলের উজ্জ্বল শষ্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,/নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।/তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে/ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার/সরস সর্ষের ঝাঁজে।এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।’
ইলিশ নিয়ে কিছু লেখার আগে বুদ্ধদেব বসুর ইলিশ কবিতার লাইনগুলির কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করা অনুচিত হবে। ইলিশ নিয়ে বেশিরভার লেখায় ঘুরে ফিরে আসে তাঁর কবিতার লাইনগুলো। আমিও তার ব্যত্যয় ঘটাতে চাই না।
শুনেছি, ওপারে সেই গোয়ালন্দ থেকে পদ্মা এখন অনেকটা সরে গিয়েছে। ইলিশও তেমন একটা পাওয়া যায় না ওই এলাকায়। যেমন, এপারে স্বাধীনতার ৭৫টি বছর পার করে এসে পূর্ববঙ্গের উজ্জ্বল স্মৃতি এবং দেশভাগের যন্ত্রণা দুই-ই অনেকটা মিলিয়ে গিয়েছে ছেড়ে আসা সেই ভূখণ্ড বাংলাদেশ নামে স্বাধীন এক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর।
যে রাষ্ট্রের সঙ্গে এপারের সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং আত্মিক। তবু সীমান্ত, কাঁটাতার, কূটনীতির সম্পর্কের ওঠানামা, বিধিনিষেধকে তো অস্বীকার করা যায় না। ফলে সম্পর্ক সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছনোর পরও এখন এপারের আমজনতার ওপারের সঙ্গে সাধারণ যোগসূত্রটি বলা চলে একমাত্র পদ্মার ইলিশ। এপার অধীর অপেক্ষায় থাকে কবে কাঁটাতার ভেদ করে এপারের হেঁসেলে প্রবেশ ঘটবে পদ্মার ইলিশের। এমনটা ক’টা দেশে আছে যে ঘরের কোলাঘাট, সুন্দরবন, দীঘার ইলিশের ভিড়ে এপারের বাঙালি ফেলুদা, ব্যোমকেশের চোখ দিয়ে পদ্মার ইলিশ খুঁজে বেড়ায়।
সেই পদ্মার ইলিশ এপারের বাজারে এবার নতুন মাত্রা পেল। কলকাতাসহ বাংলার বিভিন্ন বাজারে এখন পদ্মার ইলিশের ছড়াছড়ি। আর তা এমন একটা সময় এল যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের রাজধানীতে অবস্থান করছিলেন। সকালে খবরের কাগজে শেখ হাসিনার চওড়া হাসিমুখ ছবিতে চোখ বুলিয়ে বাঙালি গিয়েছে ইলিশের বাজারে।
কূটনীতির ইলিশ বহু বছর ধরেই আসে এপারে সরকারি কর্তাদের ঘরে আসে। এবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অতিথি হিসাবে যেন ভারতবাসীর জন্য সঙ্গে করে এনেছিলেন পদ্মার ইলিশ। ওপারের মানুষ নিশ্চয়ই পদ্মা, মেঘনার ইলিশের ফারাক করতে পারেন। এপারের মানুষ কিন্তু সীমান্ত পেরনো ইলিশ মাত্রেই মনে করে তা পদ্মার।
পদ্মার ইলিশের শত-সহস্র বছরের ঐতিহ্য, অর্থনীতিতে অবদান, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে উপস্থিতি, বাঙালির মনোজগতে তার দখলদারী অতঃপর মনে হয় খানিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে পদ্মা নিয়ে আর এক আবেগ ঘিরে। সেই আবেগের নাম পদ্মা সেতু।
খবরের কাগজে পড়ছিলাম, বাংলাদেশে সদ্য চালু হয়েছে ভ্রমণের নতুন প্যাকেজ-পদ্মা সেতু দর্শন। তীর্থস্থান দর্শনের মতো সে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ বাস বোঝাই করে যাচ্ছে সদ্য চালু হওয়া সেতুটি দেখতে। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে যাত্রী হেলিকপ্টার প্রতিদিন পদ্মা সেতুর উদ্দেশে রওনা হচ্ছে। এক বন্ধু বলছিলেন, বিয়েতে নব-দম্পতিকে কপ্টারে চেপে পদ্মা সেতু দেখতে যাওয়ার টিকিট উপহার দিচ্ছে বন্ধু-সহকর্মীরা। বাবা সন্তানকে কথা দিচ্ছেন, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে পদ্মা সেতু দেখাতে নিয়ে যাবেন।
পদ্মা সেতু চালু হলে কপাল ফিরবে, এই আশায় বহু মানুষ ধারদেনা করে ব্যবসা খুলেছেন, আগেই জেনেছিলাম সংবাদমাধ্যমে। তাদের অনেকের মুখে ইতিমধ্যেই চওড়া হাসি। জেনেছি, এই সেতুর সুবাদেই বাংলাদেশের দক্ষিণপ্রান্তের ২২টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ সহজতর হয়ে গিয়েছে। যাদের আর পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে মৃত্যু আতঙ্ক সঙ্গী করে ঘণ্টার পর ঘণ্টার ব্যয় করতে হচ্ছে না রাজধানীতে পৌঁছতে।
শুধু কি বাংলাদেশ? কলকাতার সঙ্গে ঢাকাসহ বাংলাদেশের নানা প্রান্তে যাতায়াতের সময় অনেকটাই কমে গিয়েছে। বাংলাদেশের মোংলা বন্দরের গুরুত্ব এই সেতুর সুবাদেই ভারতের কাছে বেড়ে গিয়েছে। গাড়িতে পদ্মা পেরোতে সময় লাগছে মাত্র কয়েক মিনিট। বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ভারতের পাহাড়ি রাজ্যগুলোর সঙ্গে সমতলের যোগাযোগও আরও সহজ হল। একইভাবে উপকৃত আরও দুই প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটান। কলকাতার পাশাপাশি তারা এবার বাংলাদেশের বন্দরগুলোকে মাল আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করতে পারবে।
পদ্মার ইলিশ আর পদ্মা সেতু এভাবেই মিলে-মিশে একাকার। একই নামের মাছ আর সেতু তাদের জন্মস্থানকে ছাপিয়ে বিস্তীর্ণ ভারতীয় উপমহাদেশে গুরুত্ব লাভ করেছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন বেশ উন্নত ও সহজ হয়েছে। কলকাতায় অনেকেই দার্জিলিং, শিলিগুড়িসহ পশ্চিমবঙ্গের উত্তরপ্রান্তে, বিশেষ করে ডুয়ার্সের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে বসে পদ্মা সেতু দেখবে বলে বাংলাদেশ হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
পদ্মার ইলিশের মতোই পদ্মা সেতুর হাত ধরেও পদ্মা নামটি সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে উপমহাদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে তার জন্ম-বৃত্তান্তের কারণেই। শেখ মুজিবুরের বাংলাদেশ মার্কিন বিদেশ সচিব হেনরি কিসিঞ্জারের ভবিষ্যৎবাণী (তলাবিহীন ঝুড়ি) মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে বহু বছর হল জাগ্রত এক অর্থনীতি।
তবু সেই দেশ যে নিজের টাকায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সেতু পদ্মার মতো সামুদ্রিক চেহারার নদীর উপর নির্মাণ করতে সক্ষম হল, এ দেশের মানুষের কাছেও তা এক চমকপ্রদ বিস্ময়। আমাজনের পরই ভয়ঙ্কর নদীর তালিকায় পদ্মার নাম। শুনেছি, যে নদীর মাঝখানে পৌঁছনোর আগেই আর পাড়ের দেখা মেলে না। সেই নদীতে তিরিশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এমন সেতু নির্মাণ অসম্ভবকে সম্ভব করা বলা চলে, যার পিছনে আছে একটি জাতির ইচ্ছা শক্তি আর সাহসের সংমিশ্রন।
কেউ অতিরঞ্জন, অতিশয়োক্তি ভাবতে পারেন, তবু আমি বলব, ১৯৭১ এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা এবং পদ্মা সেতু নির্মাণে শেখ হাসিনার পদক্ষেপকে একটি দিক থেকে এক করে দেখা যায়। ভারতীয় সেনার প্রধান শ্যাম মানেকশ বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্তে গোড়ায় সায় দেননি। নদী-নালা পরিবৃত পূর্ব-পাকিস্তানে যুদ্ধ জয়ের ব্যাপারে সংশয় ছিল তাঁর। কিন্তু সংকল্পে অবিচল ছিলেন ইন্দিরা, কারণ সাহস এবং দূরদর্শিতা ছিল তাঁর পুঁজি।
পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্ব ব্যাংক ঋণদানের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর শেখ হাসিনাকেও ঘরে-বাইরে নানা পক্ষ পিছিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাহস ও দূরদর্শিতার জোরে সংকল্প রক্ষায় অবিচল ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনা পর্যুদস্ত হলে ইন্দিরার রাজনীতি চুরমার হয়ে যেত সন্দেহ নেই। যেমন পদ্মা সেতু নিয়ে এগিয়ে না গেলে দেশের রাজনীতিতে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আজ এমন প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারতেন না শেখ হাসিনা।
লেখক: ভারতীয় সাংবাদিক।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।