ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

পরিবারে ইতিবাচকতা শিশুর সুবিকাশ নিশ্চিত করে

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার

প্রকাশিত : ১৫:০৭, ১০ মার্চ ২০২১

আমাদের অধিকাংশেরই ধারণা হলো, শিশুর যত্ন শুরু করতে হবে তার জন্মের পর থেকে। কিন্তু এটি আরো আগে থেকেই শুরু হওয়া জরুরি। সেটা কীভাবে?

আজ যে মেয়ে শিশুটি একটু একটু করে বেড়ে উঠছে, ভবিষ্যতে সে-ই তো একদিন মা হবে। আমরা যদি তাকে সুন্দর শিক্ষা-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বড় করে তুলি, ভালো আচরণ শেখাই, প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগাই এবং পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ করে দেই তাহলে সে ভবিষ্যতে সুস্থ সুন্দর শিশুর জন্ম দেবে। একজন ভালো মা হবে। শুধু মেয়েশিশুদের বেলায়ই নয়, ছেলেশিশুদের ক্ষেত্রেও এটি সমানভাবে সত্যি।

টিভি-তে একটি সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন দেখছিলাম। একটি ছেলেকে ছোটবেলা থেকেই বলা হচ্ছে : ‘তুমি ছেলে না! তুমি কাঁদবে কেন? ছেলেরা কাঁদে না।’ পরের দৃশ্যে দেখা গেল, একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে পিটিয়ে আহত করেছে। স্ত্রী কাঁদছে। তখন বলা হলো, ‘ছেলেরা কাঁদে না’ এটা না শিখিয়ে তাকে শেখানো উচিত ছিল ‘ছেলেরা কাউকে কাঁদায় না’। অর্থাৎ সে যেন কারো কান্নার কারণ না হয়। কারো কষ্টের কারণ না হয়। কাউকে কষ্ট না দেয়।

সুস্থ পরিবার গঠনের জন্যে শৈশব থেকেই আসলে এ মানবিক শিক্ষাগুলোয় আমাদের ছেলেমেয়েদের উদ্বুদ্ধ করা উচিত। কিছুদিন আগে একটি মেয়ে এলো আমার চেম্বারে। তার বাবা বললেন, একটু শব্দ হলেই আমার মেয়েটি ভয় পায়। কুঁকড়ে যায়। অস্বাভাবিক আচরণ করে। জিজ্ঞেস করলাম, কবে থেকে এরকম হচ্ছে? বললেন, দু-মাস ধরে।

আমি মেয়েটির সাথে একান্তে কথা বলতে চাইলাম। বাবাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ওকে বললাম, বলো তো বাবু, তুমি কেন এরকম করো? বাচ্চাটা বলল, ‘আমার আব্বু যদি আম্মুকে মেরে ফেলে!’ তারপর সে ঠিকই সত্যটা বলে দিল আমাকে। ওর মাকে রড দিয়ে পিটিয়েছে ওর বাবা। সেদিন থেকেই তার প্রতিমুহূর্তের আতঙ্ক— বাবা না তার মাকে কোনদিন মেরেই ফেলে!

একটি শিশুর প্রথম জগৎ তৈরি হয় তার মা-বাবাকে ঘিরে। তারপর তার আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং অন্যান্যরা। যখন সে দেখে তার মা-বাবার মধ্যে নিত্য-অশান্তি নির্যাতন সহিংসতা, এ দৃশ্যগুলো সারাক্ষণই তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তার মনোজগতে এক প্রচণ্ড আলোড়ন ঘটে যায়।

শিশুর কোমল মন এ বিষয়টি নিতে পারে না। মনে হয়, এসব কী ঘটছে! জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়টা সে পার করে তখন। সে-সময় তার যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না। ফলে ধীরে ধীরে সে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। অন্যদিকে দেখা যায়, যে-সব দম্পতির মধ্যে মনের মিল থাকে, সুসম্পর্ক থাকে, তাদের সন্তানরা হয় বুদ্ধিদীপ্ত, স্বতঃস্ফূর্ত ও সপ্রতিভ।

আবার শিশুর জন্মের আগে থেকেই মা-বাবা কিংবা পূর্বপুরুষের কোনো কোনো আচরণও শিশুর জিন-কে প্রভাবিত করতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণায় বিষয়গুলো উঠে আসছে। 

সম্প্রতি উরুগুয়ে গিয়েছিলাম একটি মেডিকেল কনফারেন্সে। ওখানে পঠিত এক গবেষণা-প্রবন্ধে বলা হয়, একটি শিশুর মধ্যে কিছু জিনগত ত্রুটি ধরা পড়ে এবং তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে চমকপ্রদ তথ্য। প্রায় ছয় দশক আগে সেই বাচ্চাটির পূর্বপুরুষদের কেউ ধূমপায়ী ছিলেন, আর সে কারণেই এ ত্রুটি।

আজকাল অনেক সেমিনার-কনফারেন্সে বলা হয়, মা যখন গর্ভধারণ করেন তাকে ধূমপান করতে নিষেধ করো। কিন্তু কথা হলো, তখন ধূমপান বন্ধ করে লাভ কী? এমনও শুনেছি, একই রুমে গর্ভবতী স্ত্রীর পাশে বসে স্বামী ধূমপান করছে! মানা করলেও নাকি শুনতে চায় না। এতে সেই মা এবং তার গর্ভস্থ শিশু দুজনেই কিন্তু অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

তাই সুস্থ সন্তানের জন্যে একদিকে যেমন আগে থেকেই মা-বাবা দুজনকে এসব বদভ্যাস বর্জন করতে হবে, তেমনি অভ্যস্ত হতে হবে পুষ্টিসম্মত খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ ও ভালো আচরণে। এটা যে কেবল তাদের নিজেদের সন্তানের জন্যেই মঙ্গলজনক তা নয়, বরং এর সুফল পাওয়া যাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মে।

বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার, মায়ের মধ্য দিয়েই যেহেতু সন্তান বেড়ে উঠছে, তাই সবদিক থেকেই মাকে ভালো রাখতে হবে। তার আনন্দ, সুখানুভূতি, হতাশা, বিষণ্নতাসহ সব ধরনের অনুভূতির সাথে গর্ভস্থ সন্তানের যোগাযোগটা একেবারে সরাসরি। মা যদি কোনো কারণে স্ট্রেস-আক্রান্ত হন, তবে তার দেহে প্রবাহিত স্ট্রেস হরমোনগুলো গর্ভস্থ শিশুর স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করে। তাই এ সময় মায়ের শরীর-মন যত ভালো থাকবে, শিশুর সুস্থতার সম্ভাবনাও তত বেশি। মায়ের পাশাপাশি বাবার সচেতনতাও খুব জরুরি।

আর শিশুর জন্মের পর একটি বড় দায়িত্ব হলো, তাকে সুস্থ ও প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। কৌটার দুধ ও প্যাকেটজাত খাবারের ক্ষতিকর দিকগুলোর ব্যাপারে বলতে বলতে আমরা হাঁপিয়ে উঠছি। কিন্তু বিজ্ঞাপন দেখে মা-বাবারা প্রায়ই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। বাহারি বিজ্ঞাপনের প্রতাপে এখন আমাদের মায়েদের বুকের দুধ প্রায় শুকিয়ে যাওয়ার দশা!

ইদানীং আরেকটি সমস্যা হলো, মা-বাবারা তাদের পুরোটা সময়ই ব্যয় করছেন একটি/ দুটি সন্তানের পেছনে। ফলে সবকিছু তারাই করে দিচ্ছেন, সন্তান কিছুই নিজে করতে শিখছে না। 

এ কারণে দেখা যাচ্ছে, একটি শিশুর যেখানে ১০ মাস বয়সে নিজে খেতে পারার কথা, সেখানে ১০ বছর বয়সেও সে তা পারছে না। সেদিন দেখি, ১৫ বছরের একটি মেয়েকে তার বাবা খাইয়ে দিচ্ছেন। সে যে নিজে খাবে, এটাই তাকে শেখানো হয়নি।

আমার খুব ভালো লাগে যে, কোয়ান্টাম এসব ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করে তুলছে। বান্দরবানের লামায় যেভাবে প্রকৃত শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও আনন্দময় সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে হাজারো ছেলেমেয়েকে আলোকিত মানুষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে, দেশের সব শিশুকেই যদি এভাবে মানুষ করা যেত, তাহলে আমাদের দেশটা সত্যিই অনেক সুন্দর হতো।

মা-বাবাদের আমরা বলি, শিশুকে কারো সাথে তুলনা করবেন না। সে যদি আপনার প্রত্যাশামতো কিছু করতে না-ও পারে, তবু তাকে ক্রমাগত ইতিবাচক কথা বলুন যে, তুমি পারবে। একসময় সে ঠিকই পারবে। কোয়ান্টামও তা-ই বলে। পরিবারে ইতিবাচকতার এ চর্চাটা শিশুর সুবিকাশের জন্যে খুব জরুরি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স যাদের, তারা সবাই শিশু। এ শিশুরা ও তরুণ-তরুণীরা অর্থাৎ হবু মা-বাবারা যারা কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে অংশ নিয়েছেন, তাদের আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। তারা এ কোর্স থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন, কারণ এর সুফল তারা পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম ধরে পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।

(সাক্ষাৎকার গ্রহণ : সেপ্টেম্বর ২০১৬)


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি