ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

পরিবেশপ্রেমী হতে হবে ছোট থেকেই

মো: তানভির আহমেদ 

প্রকাশিত : ১৬:৪৯, ১৪ এপ্রিল ২০২১ | আপডেট: ১১:৪৪, ১৯ এপ্রিল ২০২১

সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ অনেকদিক থেকেই গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ। ধারণা করা হয়ে থাকে একমাত্র প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে। এখানে যেমন রয়েছে মানুষের বসবাস, তেমনি উদ্ভিদ, জল ও স্থলে বিচরণ করে এমন প্রাণের স্পন্দন ও কম না। গভীর সাগরে স্বচ্ছ নীল জলরাশীর নিচে রয়েছে এক জগত। পাহাড়, বন, সমুদ্র, সমভূমি এসবকিছু প্রাণিজগৎ ও বাস্তুতন্ত্রে বৈচিত্র্য এনেছে, যা আমরা সবাই কম বেশি জানি।

অপরদিকে সর্বজনীন এ আবাসভূমি ক্রমেই ধ্বংস করে চলেছে মানবসমাজ। জেনে কিংবা না জেনে এই ধ্বংসলীলায় মেতেছি আমরা সবাই। বনভূমি কেটে উজার করা, কৃষি জমিতে ইমারত স্থাপন, পরিবেশের কথা বিবেচনা না করে ঝুকিপূর্ণ কলকারখানা নির্মাণ, খাল, বিল জলাশয়ের যায়গা ভরাট করে তো একদিকে আমরা নিজেরা পরিবেশের ক্ষতি করছি, আবার অন্যদিকে অনাগত ভবিষ্যত প্রজন্মকে করছি অনিরাপদ। যার দরুন পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলা বেড়েছে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার পাশাপাশি দেশগুলোও হুমকির মুখে অগ্রসর হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে তাই ১৭ অক্টোবর ২০০৯ সালে এক অভিনব কাজ করেন মালদ্বীপের সরকার৷ সেদিন সাগরের তলে ডুবুরির পোশাক পরে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছেন তারা৷

আমরা যদি বিষয়গুলো একটু গভীরভাবে অবলোকন করার চেষ্টা করি তবে দেখবো সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে পরিবেশ ধ্বংসের ধারা ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে। আগে মনে করা হতো প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ অপরিসীম। ভূ-গর্ভস্থ ও উপরস্থ সম্পদ কখনো শেষ হবার নয়। তাই আধুনিকায়ন, নগরায়ণ, শিল্পায়নের যাই বলি না কেনো, এসবের নামে পরিবেশের উপরে চলেছে সর্বদায় এক নির্বিচার। বিখ্যাত গণমাধ্যম 'দ্যা গার্ডিয়ান' এর ২৯ মার্চ ২০০৫ এর বিজ্ঞান পাতায় প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বলছে, 'পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ প্রাকৃতিক সম্পদ ইতোমধ্যে ব্যবহার করা হয়েছে'। এভাবে চলতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে এমনও দিন আসতে পারে যে, সাধারণ জীবনধারণ ও কষ্টকর হয়ে যাবে প্রাণীকুলের প্রতি। কারণ মানুষের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে পৃথিবীতে, সমানুপাতিক হারে কিন্তু সম্পদ বা পৃথিবীর আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। যার ফলশ্রুতিতে ক্রমবর্ধমান এই চাপ গিয়ে পরছে পৃথিবীর অবশিষ্ট সম্পদের উপরেই।

শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সেই অনুপাতে পণ্য উৎপাদন আর ভোগের মধ্যেই বিষয়টা সীমাবদ্ধ থাকছে না। এর সাথে জড়িয়ে পরছে পরিবেশ, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি সহ নানান বিষয়গুলো। তখন তৈরি হয় বনিকশ্রেণি, সুবিধাভোগী শ্রেণি সহ নানা গোষ্ঠী। মাঝেমধ্যে দেখা যায় কোন সরকার চাইলেও তখন বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, হয়ে যান তাদের অনুগত। ব্যবসা করার নামে পৃথিবী ব্যাপী সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস আমাদের জানা। জাতি হিসেবে কারা উচ্চশ্রেণির আবার কারা নিন্মশ্রেণির এ নিয়েও অনেক পুরোনো বিবাদ রয়েছে।

আমরা প্রতিদিন দৈনন্দিন কাজে নানান পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে থাকি। যার কিছু প্লাস্টিক, পলিথিন, কাগজ কিংবা অন্য বস্তু দিয়ে মোড়কীকরণ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও আমাদের গৃহস্থালি থেকে টন কে টন বর্জ্য, ট্যানারি, কারখানাগুলো থেকে বর্জ্য, আর গাড়ি-ঘোড়া থেকে নির্গত কার্বন সহ ক্ষতিকারক গ্যাস তো রয়েছেই। তো সেই বর্জ্যগুলো সম্পূর্ণভাবে শোধন কিংবা পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হয় না। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে বিবিসির করা  এক  প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর যতো মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখবিসুখের কারণে। কিন্তু সারা বিশ্বে এধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ। পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার একটি বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছে, শহরাঞ্চলে এই দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে তারা বলছে, দূষণের কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আবার ঢাকা শহরকে দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে প্রতিযোগিতা করতে দেখা যায় হরহামেশাই।

বাজার অর্থনীতির সূত্রগুলো বলে, যতই উৎপাদন বাড়বে, বেচাকেনা বাড়বে, ততই জিডিপি বাড়বে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী উৎপাদনের চক্রের মধ্যে পড়ে পৃথিবীর মাটি, পানি, জলাশয়, বনভূমি বিপর্যস্ত হয়েছে। দাবী উঠেছে জলাভূমি সংরক্ষণের, জলাভূমিকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দেবার। পরিবেশ সচেতনদের সভা-সেমিনারে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অর্থনৈতিক চিন্তার ধরন পাল্টেছে। ইলেকট্রনিকস যন্ত্রাংশে আনা হচ্ছে প্রতিনিয়ত আধুনিকায়ন ও পরবর্তী ভার্সন। যার কোনটির সাথে আগেরটির মিল পাওয়া যাচ্ছে না। বড় বড় কর্পোরেশনগুলো চিন্তা করছে কিভাবে ক্রেতা বৃদ্ধি করা যায়। উৎপাদন বাড়ানো যায়। তাদের চিন্তায় আগে উন্নয়ন, পরে পরিবেশ ও অন্যান্য। প্রতিবছর পৃথিবী থেকে ১৮ মিলিয়ন একর বনভূমি উধাও হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন পৃথিবীর ১২ কোটি গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। মহাসাগরগুলোতে প্রতিবছর ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমছে। সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়া মাইক্রোপ্লাস্টিক মাছের মাধ্যমে মানব শরীরে ঢুকে পড়ছে। করোনায় শুরুতে পরিবেশের উপর মানুষের অত্যাচার কমলে গোলাপি ডলফিন, লাল কাকড়া, মায়া হরিণ, সমুদ্রলতায় ছেয়ে যায়। যদিও ডলফিন মারা যাওয়ার খবর শিরোনাম হয়ে তার কিছুদিন পরেই। মাত্রাতিরিক্ত পেস্টিসাইডে পৃথিবীর প্রায় ৪০ ভাগ জমির উর্বরতা কমছে, মাটির নিচের অণুজীবগুলো মারা যাচ্ছে। সুন্দরবনে সম্প্রতি বাঘ নিয়ে হওয়া জরিপ গুলোতে তাদের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। আমেরিকা–ইউরোপের তিন ভাগের এক ভাগ মৌমাছি স্রেফ হারিয়ে গেছে। চীনের শত শত কৃষক প্লাস্টিকের ডিব্বায় পরাগরেণু ভরে হাতে হাতে পরাগায়ন করতে বাধ্য হচ্ছেন। পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত অ্যামাজন বন থেকেই প্রতি মিনিটে কাটা হচ্ছে ২০০০০ গাছ! কিভাবে টিকবে এ ধরিত্রী?

বছরখানেক আগে জাতিসংঘের বায়োডাইভার্সিটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ৫০টি দেশের বিশেষজ্ঞরা মিলে হাজার পৃষ্ঠার একটি ভীতিকর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন সেখানে। তাঁরা বলছেন, 'খুব শিগগিরই বিশ্বের ১০ লাখ প্রজাতির উদ্ভিদ আর প্রাণী হারিয়ে যাবে'। আশেপাশে তাকালেই দেখতে পাই আমাদের পূর্ব প্রজন্ম গল্প করতেন, তাদের পুকুর, নদী-নালা, খাল-বিলে কি কি জাতের মাছ পাওয়া যেতো। এর উপরে নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করতো জেলে, বেদে থেকে শুরু করে গ্রামীণ জনপদের মানুষেরা। কালের পরিক্রমায় সে ঐতিহ্য আজ তা হারাতে হারাতে নদীগুলো মৃতপ্রায়।  পৃথিবীর নামীদামি অর্থনৈতিক ফোরামগুলো একসময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জিকির তুললেও আজকে তারা কী বলছে? বেশি বেশি উৎপাদন করুন, শপিং করুন? নাকি বলছে অপচয় বন্ধ করুন, পরিবেশ বাঁচান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করুন। 

মেরু অঞ্চলে বরফ গললে আমাদের কি? পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ,  সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিই বা কেনো আমাদের মাথাব্যথার কারণ হবে? জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০০০-২০২০ অবধি তথ্যের ভিত্তিতে  গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক রিপোর্ট বলেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশে ১১৪৫০ জন লোককে ক্ষতির সম্মুখীন করেছে, ৩.৩২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি  এবং ২০০০-২০০৯ সালে ১৮৫ টি চরম আবহাওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করিয়েছে। যদিও সংখ্যা-পরিমান নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি চোখের সামনে ধুলিসাৎ করে দিতে পারে, এ নিয়ে পরিবেশ সচেতনতার বরই অভাব পরিলক্ষিত হয়। জার্মানওয়াচে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (সিআরআই) অনুসারে বাংলাদেশ এখনও সপ্তম সর্বাধিক জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। সিআরআই ২০২০ তেও একই অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে যদি সংশ্লিষ্টরা ভবিষ্যতের প্রস্তুতির পাশাপাশি আজকের পরিবেশগত পরিবর্তন এবং ভূরাজনৈতিক ডামাডোলের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারে তবে অর্থনীতি, পরিবেশ এবং প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জগুলো  আরো তীব্র হয়ে উঠবে। সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে - এই সংকেত স্বীকার করেই নীতি-নির্ধারক এবং ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে হবে। চালাতে হবে পরিবেশ রক্ষায় ক্র‍্যাশ প্রোগ্রাম।

সময় এখন আপনার, আগে উন্নয়ন নাকি পরিবেশ তা নির্ধারন করতে হবে। পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়ে টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে পারলেই আমরা বাঁচবো, নিরাপদ হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এজন্য এগিয়ে আসতে হবে নিজেকে, হতে হবে পরিবেশ রক্ষায় রোল মডেল।

শিক্ষার্থী, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর। 
ই-মেইল: ahmedtanvir.hstu@gmail.com

আরকে//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি