পরিমিত কেনাকাটায় লাভ করবেন ঋণের অভিশাপমুক্ত জীবন
প্রকাশিত : ১৫:২৪, ১৫ মে ২০১৯
ঋণমুক্ত জীবন, এই মুক্ত-স্বাধীন জীবনের জন্যেই সবসময় দোয়া করেছেন আমাদের প্রিয় নবীজী (স.)। রসুলুল্লাহ (স)-এর দোয়ার মধ্যে একটি ছিল যে, সব ধরনের পাপ এবং ঋণ থেকে আমি পানাহ চাচ্ছি।
একবার এক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন যে, আপনি প্রায়ই এই দোয়া করেন কেন। পাপ আর ঋণ কি এক? মানে পাপের সঙ্গে ঋণ কেন উল্লেখ করছেন? তিনি বললেন যে দেখো, দেনাদার যে, সে কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে। কেন? এই ঋণটাকে না শোধ করার জন্যে সে মিথ্যা বলবে, ওয়াদা করবে এবং ভঙ্গ করবে। সে সময় সে পাওনাদারের হাত থেকে বাঁচার জন্যে বলবে যে ঠিক আছে, তিনদিন পরে দেবো। পাঁচদিন পরে দেবো। সাতদিন পরে দেবো। কিন্তু সে ওয়াদা রাখবে না। এটা তার মিথ্যা পায়তারা। এ জন্যেই ঋণ হচ্ছে পাপ, ঋণ হচ্ছে অভিশাপ।
গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের কথা আমরা জানি। তার যখন মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হলো, তিনি খুব সহজভাবে সেটি গ্রহণ করেছিলেন। কারণ তাকে বলা হয়েছিল যে, আমরা তোমার মৃত্যু দণ্ডাদেশ বাতিল করতে পারি যদি তুমি জ্ঞানচর্চা ছেড়ে দাও। তিনি সে শর্তে রাজি হননি। তিনি বললেন যে, আমি জ্ঞানচর্চা ছাড়তে পারব না। সুতরাং মৃত্যুই আমি চাই। মৃত্যুর একদম আধঘণ্টা আগেও তিনি তার শিষ্যদের নিয়ে অমরত্বের বিষয়ে আলোচনা করছিলেন এবং এই সময় জল্লাদ এলো তার হাতে হ্যামলক বিষ।
জল্লাদ এসে সক্রেটিসকে বলল, সাধারণত আমরা কোনও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লোককে যখন হ্যামলক বিষ দিতে আসি তখন তারা সেটা নিতে চায় না। তারা চিৎকার করে, তারা ফেলে দিতে চায়। কিন্তু আপনি তো দার্শনিক, আমার মনে হয় যে আপনি এটা নেবেন। তিনি বললেন, হাঁ, এ জন্যেই তো আমি বসে আছি। আপনি আমাকে দিন। তখন তাকে শিখিয়ে দেওয়া হলো যে তিনি কীভাবে হ্যামলক বিষ পান করবেন, কীভাবে আস্তে আস্তে হাঁটবেন, তারপর একসময় শুয়ে পড়বেন, মাথার ওপর দিয়ে সাদা চাদরটা দিয়ে শরীর ঢেকে দেবেন এবং তারপরে একসময় তিনি মরে যাবেন। তিনি সেটিই সবার সামনে করলেন। তিনি সাদা চাদর দিয়ে শুয়ে আছেন। হঠাৎ একসময় চাদরটা একটু খুললেন। খুলে তার এক শিষ্যকে বললেন যে, অমুকে আমার কাছে একটি মোরগের দাম পায়, ওটা একটু দিয়ে দিও।
আমাদের অবাক লাগতে পারে, মনে হতে পারে যে, সামান্য একটা মোরগ, ওটার দাম দেওয়ার কথাও তার সেই মরণের আগে মনে এসেছে! কীভাবে? কেন? কারণ মহামানবরা কখনও ঋণগ্রস্ত হন না। তারা পৃথিবীকে ঋণী করে রেখে যান। সব ধর্মের শিক্ষাই বলে ঋণ পারতপক্ষে করও না। বাধ্য হয়ে করলেও তা শোধ করে যাও। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি বাধ্য হয়ে করি না শখের বশে করি। আমরা কি ফুটানি দেখানোর জন্যে করি না সত্যিই তা না পেলে আমাদের চলবে না বলে করি। সবজি সেদ্ধ খাওয়ার জন্যে ঋণ করি না ঘি খাওয়ার জন্যে ঋণ করি। আবেগের বশে ঋণ করি না সচেতন থেকে ঋণ করি। নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা কাজে লাগিয়ে ঋণ করি না অন্যদের উসকানিতে ঋণ করি। এই বিষয়গুলো নিয়ে আসলেই আমাদের ভাবতে হবে।
এখন আমরা পবিত্র রমজান মাস অতিবাহিত করছি। সময় খুব ব্যস্ত কাটছে শপিং মলগুলোর বিক্রেতাদের। বিক্রেতারা হুজুগ সৃষ্টি করছেন। আর তাদের ক্রেতার তালিকায় তরুণীরা তো থাকেনই, বাদ যায় না কিশোরী এবং শিশুরাও। এক মেয়ের উচ্চতা চার ফুট, সে দোকানে এসে গো ধরল তাকে সাড়ে চার ফুট লম্বা ফ্লোর টাচ গাউন দিতেই হবে। মা কত করে বোঝালেন যে, এতে রাস্তার ময়লা সব তোমার জামার পেছনে লাগবে, কিন্তু মেয়ের মুখ ভার। তার এটিই লাগবে। কারণ, সিন্ডেরেলা মুভিতে সিঁড়ি দিয়ে দৌঁড়ে নামার সময় সিন্ডেরেলা যেভাবে তার গাউনটাকে দুহাতে আলগে দৌঁড় দিয়েছিল, সে দৃশ্য তার চোখে লেগে আছে।
এই যে মুখ ভার করা, মনটা বেজার হওয়া, সাধ ও সাধ্যের মধ্যে টানাটানি-এগুলোর মূলে রয়েছে অপরিমিত কেনাকাটার ঝোঁক।
স্কুলে পড়তে আমরা সবাই এই প্রবচনটির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম-কাট ইউর কোট একরডিং টু ইউর ক্লোথ। এর মানে শুধু কাপড় কতটুকু আছে তা মেপে গায়ের কোটটি বানাও শুধু নয় বরং ব্যাপক অর্থে সব খরচের ব্যাপারেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে তোমার যা আয় তার পরিমাণ বুঝে তুমি ব্যয় করো। তাহলে মাস শেষে নিঃস্ব হতে হবে না, হাত খালি বলতে হবে না। তবে পুঁজিবাদী শোষকরা এই আফসোস যাতে কেনাকাটার সময় করতে না হয় সে জন্যে দুটি কাজ করেছে। এক হচ্ছে ডেবিট কার্ড, যেটাকে আমরা এটিএম কার্ড বলি। এই কার্ড সঙ্গে থাকলে হাতে নগদ টাকা কম নিয়ে শপিংয়ে গেলেও কোনও সমস্যা নেই। শপিং মলের কাছাকাছি এখন এটিএম বুথ আছে। নয়তো দোকানেই পয়েন্ট অব সেল কর্নার আছে, যা দিয়ে কার্ডে পেমেন্ট করা যাবে অনায়াসে। তবে এখন ক্রেজ চলছে ক্রেডিট কার্ডের।
আসলে এখনকার যত অশান্তি, যত অসুখ তার মূল কারণ হচ্ছে হাইপার কনজ্যুমারিজম। সারা পৃথিবীতে সবসময় শোষকদের উদ্দেশ্য ছিল একটা যে, কীভাবে একজন মানুষকে ঋণের মধ্যে ফেলা যায়। ঋণের মধ্যে ফেললেই তাদের দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা যাবে। তারা কেনাকাটার সময় উসকে দিয়ে বলে-শখের দাম লাখ টাকা। মানে শখের জিনিস হলে লাখ টাকা দিতেও কোনও আপত্তি করবেন না। আপনার শখ বলে কথা! তারা বিজ্ঞাপন বানায়, কেনাকাটা করার অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পণ্য দেখিয়ে লোভ জাগায় আর বলে কিনুন, জিতুন। আসলে জিত হয় না হার হয়? এক তারকা থাইল্যান্ডের শপিং সেন্টারে ঘুরে বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেনার উৎসাহ দিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের জন্যে ৭০ বাথ দিয়ে হাত-পায়ের পেশি মাসাজ করার একটা ছোট্ট লাঠি কিনলেন শুধু। আর ইউটিউবে এই ভিডিও দেখে এক বাংলাদেশি মেয়ে ২০০ জোড়া জুতা কিনে এনেছে যে কি না বাসায় থাকতেই পছন্দ করে। পরিচিতদের কাছে তখন সে এতগুলো জুতো কেনার সাফাই করতে গিয়ে বলল, আসলে প্লেন ভাড়া উসুল করলাম। কীভাবে উসুল হলো? কারণ প্লেন খরচের সঙ্গে যোগ হলো এত্ত জুতোর খরচ। আলমারিতে থেকে শেষ পর্যন্ত কিছু জুতোতে ছত্রাক পড়ে গেল।
তাই কেনাকাটা করার আগে কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। সচেতন না হলে ‘বাকি চাহিয়া খুশি করিবেন’-এই ধরনের দোকানগুলো আমাদেরকে সর্বস্বান্ত করে দিতে পারে।
প্রস্তুতি এক
তালিকা করা কী কী কিনতে হবে। সেই তালিকা সামনে রেখে আল্লামা ড. এম শমশের আলী স্যারের পরামর্শ মতো তিনটি প্রশ্ন নিজেকে করা-প্রথম প্রশ্ন : এটা কি আমার প্রয়োজন? উত্তর যদি আসে ‘হাঁ, প্রয়োজন’, তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্ন: এটি কি সত্যিই খুব প্রয়োজন? এর উত্তরও ‘হাঁ’ হলে তৃতীয় প্রশ্ন : এটা ছাড়া কি আমার চলবেই না? এর উত্তরও যদি ‘হাঁ’ হয়, তবে বুঝতে হবে, ওটা আসলেই প্রয়োজন। তখন কেনার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
প্রস্তুতি দুই
বাজেট করে ফেলা এবং এই দামের মধ্যে যে যে দোকানে গেলে পাওয়া যেতে পারে তার খোঁজখবর নেওয়া। আগে যারা কিনেছেন তাদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া।
প্রস্তুতি তিন
‘কিনতে গেলে পাগল’-এই অবস্থা যেন সৃষ্টি না হয় অর্থাৎ ঘোরের মধ্যে বা আবেগবশত যেন কেনাকাটা হয়ে না যায়, যেটা বাসায় এসে আর ভালো লাগল না বা কোনোদিন পড়লামই না, সে জন্যে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে শিথিলায়ন মেডিটেশন করা। এই মেডিটেশনে মন ও মস্তিষ্কের মধ্যে একটি চমৎকার কর্মছন্দ সৃষ্টি হয়। আবেগের চেয়ে যুক্তি তখন বেশি কাজ করে।
প্রস্তুতি চার
বাজারে প্রবেশের আগে একটি দোয়া আছে আসুন প্রার্থনা করি। কেনাকাটায় অফুরন্ত বরকত দানের জন্যে এই প্রার্থনাটি আমরা পড়ে বাজার করা শুরু করতে পারি।
আর প্রয়োজন একটি সাবধানতা! সেটি হচ্ছে শপিং সেন্টারে পারতপক্ষে না যাওয়া। দেখলে কিনতে ইচ্ছে করেই। কিছু পণ্য আছে লোভনীয় পণ্য। আমার হয়ত আছে। তারপরও কী সুন্দর ডিজাইন দেখে মনে শখ জাগে আমারো একটা চাই! অবশ্য এক স্কুল ছাত্রী এর সমাধান হিসেবে প্রত্যয়ন অনুষ্ঠানে একটি মজার উপায় বলে দিয়েছিলেন। সেটি হলো-এখন যেহেতু মনের বাড়ি আছে আমাদের, মনে মনে কিনলে তো কোনও খরচ নেই। যা যা কিনতে ইচ্ছে করে মনের বাড়িতে গিয়ে কিনে ইচ্ছেমতো সেটা ব্যবহার করা। সবটাই মনে মনে। চাইলে মনের লোভাতুর শখগুলো আমরা এভাবেও মেটাতে পারি।
আর এখন যেহেতু ঈদ মৌসুম চলছে, যারা আগেই কিনে ফেলেছেন তারা তো ভালো করেছেন। আর যারা কেনাকাটার জন্যে রমজান মাসটিকে বেছে নেন, তাদের কাছে পরামর্শ হচ্ছে আগামী বছর পহেলা বৈশাখ আসার আগেই জুতো-পোশাক-প্রসাধনী কিনে ফেলা। রোজায় যেন কেনাকাটার জন্যে বের হতে না হয়। কারণ ঈদ কালেকশন, নিউ অ্যারাইভাল যত কিছুই বলা হোক না কেন, ঘুরেফিরে একটু এদিক-সেদিক করেই ফ্যাশন চেঞ্জ হয়। আর সব নতুন ফ্যাশনেই যে আমাকে ভালো মানাবে তা-ও নয়। তাই নিজেকে মানায়, নিজের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায়, এমন কিছু যেন আমরা রমজান শুরুর আগেই সংগ্রহ করে ফেলি। যাতে রমজানের রুটিনে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে কাটানোর জন্যে বেশি সময় বরাদ্দ করতে পারি। আল কোরআনের বাণীর মধ্যে ডুবে যেতে পারি। তাহলেই রমজান আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ রমজানে পরিণত হতে পারবে।