ঢাকা, রবিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

চোরাচালান নির্ভর স্বর্ণবাজার পর্ব-২

পাঁচ বছরে আড়াই টন স্বর্ণ জব্দ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:১৫, ২ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৯:১২, ৩ ডিসেম্বর ২০১৭

Ekushey Television Ltd.

দেশের স্বর্ণের বাজার মানেই ধোঁয়াশা। সবখানেই কেমন যেন লুকোচুরি ভাব। যারা স্বর্ণের ব্যবসায়ী তারা যেমন জানাতে চান না স্বর্ণ কেনা-বেচার সঠিত তথ্য, তেমনি ক্রেতার কাছে অলংকার বিক্রির সময়ও ওজন ও দাম নিয়ে চলে ছলচাতুরি। হয়তো দামি খনিজ ধাতু বলেই ব্যবসায়ীরা স্বর্ণ নিয়ে এমনটি করেন। এই দামি ধাতুটি সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর।

দেশের চাহিদা মেটাতে বছরে প্রায় ৪০ টন স্বর্ণ লাগে। কিন্তু এ চাহিদা পূরণ হচ্ছে কিভাবে? দেশে তো কোনো স্বর্ণের খনি নেই। আবার বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানিরও কোনো সুযোগ নেই। তবে মোট চাহিদার ১০ শতাংশ পুরানো স্বর্ণ (তেজাবি) থেকে পূরণ হয়। তাছাড়া বিদেশ থেকে দেশে আসার সময় কোনো যাত্রী সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম স্বর্ণ সঙ্গে আনতে পারেন। এভাবে আসা কিছু স্বর্ণও পরে বাজারে চলে আসে। কিন্তু তা মোট চাহিদার তুলনায় খুবই কম। তাহলে এই বিশাল চাহিদা কীভাবে পূরণ হচ্ছে?

প্রকৃতপক্ষে এ চাহিদা পূরণ হচ্ছে চোরাচালানের মাধ্যমে। প্রতি বছর নতুন স্বর্ণের চাহিদার সিংহভাগ, অর্থাৎ প্রায় ৩৫ থেকে ৩৬ টন স্বর্ণ দেশে আসছে চোরাচালানির মাধ্যমে।

ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দর দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই অবৈধভাবে স্বর্ণ আসছে। মজার বিষয় হচ্ছে, বিমানবন্দরে চোরাচালানির যতো স্বর্ণ ধরা পড়ছে, তার কয়েকগুণ বেশি সীমান্ত পার হয়ে পাচার হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। কাস্টমস ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, স্বর্ণ চোরাচালানির সঙ্গে জড়িত রয়েছে ২৬টি চক্র। এরা সকলেই বাংলাদেশি। তবে এই চক্রের সঙ্গে রয়েছে ভারত ও দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাও। আর চোরাচালানকৃত স্বর্ণের বেশিরভাগই আসে দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে।

স্বর্ণ চোরাচালান বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলেন, এ বাজারে কোনো শৃংখলা না থাকায় চোরাচালান কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, স্বর্ণখাতের জন্য সবার আগে দরকার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। সেই নীতিমালায় বলা থাকবে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্য স্বর্ণ কীভাবে আনা হবে বিশ্ব বাজার থেকে।

নীতিমালা তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি স্বর্ণ আমদানির সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, দেশে দৈনিক ২৫ কোটি টাকার স্বর্ণ লেনদেন হয়, যা বছরের হিসাবে ৯ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। এই বিশাল চাহিদা পূরণে বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ দিলে সরকার এ খাত থেকে মোটা অংকের রাজস্ব পাবে।

আরেক অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, একটি সুষ্ঠু স্বর্ণ আমদানি-নীতির অনুপস্থিতিতে এবং সার্বিকভাবে দেশের স্বর্ণখাতের ওপর সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণের অভাবে স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকারের মান এবং স্বর্ণবাজার ব্যবসায়ীদের দ্বারা একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অবৈধভাবে দেশের বাইরে থেকে আসা স্বর্ণালংকার বাংলাদেশের স্বর্ণবাজার ক্রমশ দখল করে ফেলেছে। স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকারের মান যাচাই, ক্রেতা ও বিক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণ ও স্বর্ণ শিল্পী বা শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। সম্ভাবনাময় খাত হওয়া সত্ত্বেও উৎসাহমূলক পদক্ষেপ গৃহীত না হওয়ায় বাংলাদেশে রপ্তানি শিল্প হিসেবে স্বর্ণখাতের বিকাশ হয়নি।

শুল্ক গোয়েন্দা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে প্রায় আড়াই টন স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। এর বাজার মূল্য প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। বৈধ পথে আমদানি না হওয়ায় বছরে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে ৪৮৭-৯৭৪ কোটি টাকা। আর গত ৫ বছরে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০০ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিদেশি রয়েছেন। তাছাড়া এই সময়ের মধ্যে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে গ্রেফতার করে আইনশৃংখলা বাহিনী।

শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিমানবন্দরে কর্মরত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যোগসাজশে সোনার বড় চালান নির্বিঘ্নে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যায়। এ কাজে সহায়তা করেন শুল্ক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও বিমানের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ১০ তোলা ওজনের একেকটি সোনার বার বিমানবন্দর থেকে বাইরে এনে দিলে চোরাচালানীদের কাছ থেকে এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পান তারা। দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে আসার সময় বিমানের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী সোনা পরিবহনে সহায়তা করেন। বাহকদের হাতে সোনা ধরিয়ে দেন দুবাইয়ে অবস্থানরত চক্রের প্রধানরা। বাহক সেই সোনা বিমানের আসনের নিচে, শৌচাগারে বা অন্য কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে রেখে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। পরে বিমানবন্দরে কর্মরত লোকজন নিজ দায়িত্বে সেই সোনা বের করে বাইরে নিয়ে আসেন। এরপর এর একটা অংশ যায়, দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের হাতে, আর একটি অংশ পাচার হয়ে চলে যায় ভারতে।

বাংলাদেশ হয়ে ভারতে সোনা পাচার হওয়ার কারণ জানতে এ খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের স্বর্ণের বাজার এখনও বেশ ছোট। সে তুলনায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের বাজার অনেক বড়। ওয়ার্ন্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য মতে, ভারতের বার্ষিক সোনার চাহিদা প্রায় দেড়শ’ টন। দেশটির এ চাহিদারও একটি বড় অংশ পূরণ হয় চোরাচালানি স্বর্ণের মাধ্যমে। ভারতে প্রতি ভরি (১ ভরি সমান ১১.৬৬ গ্রাম) স্বর্ণের আমদানি শুল্ক চার হাজার রুপি। বাংলাদেশি টাকায় যা ৪ হাজার ৮০০ টাকা। আর বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় ভরিতে ৩ হাজার টাকা। এই শুল্ক কর ফাঁকি দিতেই বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশের স্বর্ণখাতের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, দেশের স্বর্ণবাজারে সরকারি কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার তত্ত্বাবধান না থাকা বড় একটি সমস্যা। তাছাড়া পরিবীক্ষণ তথা জবাবদিহিতার ব্যবস্থা না থাকা, জেলা প্রশাসন থেকে ব্যবসায়ী কর্তৃক প্রয়োজনীয় লাইসেন্স গ্রহণ ও নিয়মিত নবায়ন না করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি, খুচরা বাজারে স্বর্ণ বা স্বর্ণালঙ্কারের ক্রয়-বিক্রয়ে সর্বক্ষেত্রে ইসিআর বা মূসক চালানের ব্যবহার না হওয়ায় ভ্যাট ফাঁকির ঝুঁকি এবং স্বর্ণ বা স্বর্ণালঙ্কার ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বৃহৎ লেনদেন ব্যাংকিং ব্যবস্থা বা ইলেক্ট্রনিক ট্রান্সফারের মাধ্যমে লেনদেন বাধ্যতামূলক না হওয়ায় অর্থপাচারসহ অবৈধ লেনদেনের ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।

এ খাতের জন্য তিনি বেশকিছু সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, স্বর্ণখাত সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন ও ব্যাগেজ রুলের মাধ্যমে আনা স্বর্ণালংকারের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিষিদ্ধ ও শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর এর সার্বিক তত্ত্ববধানে নির্ধারিত সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানির ব্যবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিবেচনা করে স্বর্ণ আমদানির শুল্কহার পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা দরকার।

 

/ডিডি/টিকে


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি