পাইলস কেন হয়? প্রতিকারে যা করণীয়
প্রকাশিত : ১৫:৫৫, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | আপডেট: ১৭:৩৬, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের জীবনের একটি ঘটনা। ১৯৭৮ সালে ক্রিসমাসের ঠিক আগে সপ্তাহখানেকের জন্যে রাষ্ট্র পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব থেকে অব্যহতি নিতে বাধ্য হন তিনি। কারণ কী ছিল জানেন? পাইলস!
অনেকের জীবনের একটি বিড়ম্বনার নাম এই হেমোরয়েড, পাইলস বা অর্শ রোগ। বয়স পঞ্চাশের কোটায় যেতে না যেতেই শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন- এমনটাই বলা হয়েছে হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিংয়ের একটি নিবন্ধে।
কেন হয় পাইলস?
হেমোরয়েডস বা পাইলস নামগুলো সাধারণভাবে রোগ বোঝাতে ব্যবহৃত হলেও আসলে এটা পায়ুপথের শেষাংশে থাকা এক ধরণের রক্তনালীগুচ্ছের সাধারণ নাম। বৃহদান্ত্রের শেষভাগে মলদ্বারের ভেতরে ও বাইরে থাকা কুশনের মতো এই রক্তনালীগুচ্ছ বা জালিকা প্রয়োজনমত সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হয়ে মলত্যাগে সহায়তা করে। পাইলস বা অর্শ রোগ হলো এই রক্তনালীগুচ্ছের প্রদাহ ও সংক্রমণ।
রোগটিকে আমরা প্রচলিত শব্দে যদি পাইলস নামে অভিহিত করি তাহলে এর কারণ নেহায়েত কম নয়! দীর্ঘদিনের কনস্টিপেশন বা কোষ্ঠকাঠিন্য, পুরনো ডায়রিয়া, মেদস্থূলতা, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, আঁশযুক্ত খাবার কম এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাওয়া- মূল কারণ এগুলোই।
প্রেগনেন্সি, বাড়তি ওজন বা অন্য কোনো কারণে মলত্যাগে বেশি জোরাজুরি করলেও পাইলস হতে পারে।
আর ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ারে বসে কাজ করতে যারা অভ্যস্ত পাইলসের উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন তারাও। যে-কারণে বেশিরভাগ সময় বসে কাজ করেন এমন চাকুরিজীবীদের মধ্যে রোগটি একটু বেশিই দেখা যায়।
কীভাবে বুঝবেন পাইলস হয়েছে?
প্রাথমিক যে অবস্থা পাইলসের জানান দেয় তা হলো মলদ্বার ও পায়ুপথে শিরা ফুলে যাওয়া বা গোটা বের হওয়া। ব্যথা বা অস্বস্তি না হওয়ায় পায়ুপথের ভেতরে পাইলস হলে তা বোঝা মুশকিল। তবে পায়ুর বাইরের দিকে পাইলস বোঝা সহজ। গোটা বের হওয়ার পাশাপাশি হতে পারে ব্যথা, চুলকানি ও রক্তপাতও। পাইলসের ক্ষেত্রে শিরা ফোলাকে ৪টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়।
প্রথম পর্যায়ে শিরা ফুলে গেলেও তা বাইরে বেরিয়ে আসে না। দ্বিতীয় পর্যায়ে শিরা মলত্যাগের সময় বাইরে বেরিয়ে এলেও তা আপনাআপনি ঠিক হয়ে যায়। তৃতীয় পর্যায়ে বেরিয়ে আসা শিরা নিজে নিজে ঠিক না হলেও হাত দিয়ে ঠিক করা যায়। চতুর্থ পর্যায়ে ফোলা শিরাকে আর আগের অবস্থায় ফেরানো যায় না।
পরিণতি কী?
প্রাথমিক অবস্থায় পাইলস তেমন একটা যন্ত্রণাদায়ক বা অস্বস্তিকর না হলেও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নিলে পাইলস বড় হয়ে ঘটাতে পারে নানাবিধ জটিলতা। যেমন- রক্তপাতের ফলে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে, মলদ্বারের বাইরে থাকা ফোলা শিরায় ঘা হয়ে প্রচণ্ড ব্যথা ও চুলকানি হতে পারে। এমনকি ফোলা স্থানে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে জায়গাটি পচেও যেতে পারে।
তবে পাইলস থেকে কোলন বা রেক্টাল ক্যান্সার হয়- এমন একটি ধারণা প্রচলিত থাকলেও হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে পাইলস এই ক্যান্সারগুলো সৃষ্টি বা এগুলোর ঝুঁকি বৃদ্ধি কোনটিরই কারণ নয়।
প্রতিকারে যা করণীয়
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাইলস নিজে থেকেই নিরাময় হয়, চিকিৎসা লাগে না। লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে সহজেই পাইলস নির্মূল সম্ভব।
স্টুল যত শক্ত হবে পাইলসের জন্যে তা ততো খারাপ। তাই স্টুল স্বাভাবিক হওয়ার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এজন্যে ফলমূল ও শাকসবজিসহ এমন খাবার খান যা অধিক আঁশসমৃদ্ধ। পান করুন পর্যাপ্ত পানি। ঝরিয়ে ফেলুন বাড়তি ওজন।
তবে এতেও যদি কাজ না হয় বা অবস্থা জটিল রূপ ধারণ করে তাহলে মেডিকেল ট্রিটমেন্ট নিন।
তবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের পথে হাঁটাই অধিক নিরাপদ
পাইলস প্রতিরোধে সুস্থ খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনাচার জরুরি। এজন্যে কিছু করণীয়-বর্জনীয়ঃ
এক নাগাড়ে লম্বা সময় চেয়ারে বসে থাকলে মলদ্বার সংলগ্ন জায়গাগুলোয় রক্ত চলাচল ব্যহত হয়ে পাইল সৃষ্টি করে। তাই পড়ালেখা বা কাজের ফাঁকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান, হাঁটাহাঁটি করুন। আরো ভালো হয় যদি দাঁড়িয়ে পড়ালেখা বা কাজের পরিবেশ তৈরি করেন;
রিফাইন্ড কার্ব যথাসম্ভব বর্জন করুন। ময়দা ও সাদা আটার বদলে লাল আটা, সাদা চালের বদলে লাল চাল- অর্থাৎ ব্র্যান বা খোসাসমেত খাবার খাওয়া অভ্যাস করুন। ডায়েটে রাখুন পর্যাপ্ত আঁশসমৃদ্ধ ফলমূল ও সবজি।
মেদ ঝরান। চেহারায় লাবণ্য বাড়ার পাশাপাশি কমবে পাইলসের ঝুঁকি। তবে বেশি ভারি বস্তু ওঠানো থেকে বিরত থাকুন।
টয়লেট করার সময় বেশি চাপ দেবেন না। কারণ টয়লেটের সময় মলদ্বারের ওপর যত বল প্রয়োগ করবেন ততো শিরা বাইরের দিকে বেরিয়ে এসে পাইলস সৃষ্টি করবে।
কয়েকটি যোগাসন নিয়মিত চর্চা করার মাধ্যমে আপনি পাইলস প্রতিরোধ করতে পারেন। যেমন- গোমুখাসন, সর্বাঙ্গাসন, শীর্ষাসন, সুপ্ত ভদ্রাসন, অশ্বিনীমুদ্রা (বিপরীত করণীতে/গোমুখাসনে/বজ্রাসনে)। পাইলস প্রতিরোধে আরেকটি কার্যকরী আসন হলো বঙ্গাসন। প্রতিদিনের ঘরোয়া কাজ আপনি বঙ্গাসনে বসে অনায়াসে করতে পারেন।
পাইলসের সমস্যা দূর করবে যে খাবার-
- গোটা শস্য-যারা পাইলসের রোগে ভুগছেন তাদের গোটা-শস্য জাতীয় খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হয়| যেমন-বদামী চাল, ওটমিল, চালের পাস্তা। এই ধরনের তন্তুজ খাদ্য মলকে নরম করে, এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
- সবুজ পাতার সবজি- সবুজ পাতার সবজিতে থাকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পুষ্টি,যা আমাদের হজমে সাহায্য করে| হজম ক্ষমতাক্ষমতাশালী করার জন্য পাইলসের চিকিৎসা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্রোকলি, গাজর, বাঁধাকপি, ফুলকপি, পেঁয়াজ, শসা, টমেটো এই সব সবুজ সবজি পাইলসের রোগীরা খেতে পারেন।
- ফল-ফলে বিশাল পরিমাণে পুষ্টি,খনিজ এবং ভিটামিন থাকে যা অন্ত্র আন্দোলনে সাহায্য করে। আপেল, আঙুর, আলুবোখারা, কিশমিশ ইত্যাদি তন্তুজ ফল গুলি খোসাসহ খাওয়া খুব উপকারী। খোসা ছাড়া যে সব ফল খুব উপকারী সেগুলি হল-কলা,পেঁপে ইত্যাদি।
- বিনস -বিন হল একটি বিশাল তন্তুজ খাদ্য যা একটি পাইলসের রোগীর খাদ্য-তালিকাতে থাকা উচিত। কিডনি,লিমা, লিগামএগুলি ভাল উদাহরণ।
- জল- যদিও জল কোনো খাদ্য নয়, কিন্তু জল পাইলস রোগে চিকিৎসারত রোগীদের কাছে খুব উপকার। চিকিৎসকরা রোজ ৬ থেকে ৭ গ্লাস জল খেতে বলেন, যা খাদ্য- আন্দোলনেসাহায্যকরে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিছু খাবার রয়েছে, যা খেলে বিপদ বাড়তে পারে।
পাইলস এড়িয়ে যেতে যেসব খাবার খাবেন না-
১. স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পাইলসে আক্রান্ত হলে মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত নয়। অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার হজম ক্ষমতাকে দুর্বল করে পাইলসের ব্যথাও বাড়ায়।
২. পাইলসে ভুগলে কফি ও চা জাতীয় পানীয় খাবেন না। এসব খাবার পাইলসের সমস্যা বাড়ায়। আর সুস্থ থাকতে পান করুন গ্রিন টি।
৩. বেকারি খাবার অপরিশোধিত ময়দা ও চিনি দিয়ে তৈরি হয়। এগুলো সহজে হজম হয় না। আর পাচনতন্ত্রের জন্য ভালো নয়। কারণ বেকারির খাবারে ফাইবার একেবারেই থাকে না, যা কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়ায়।
৪. প্যাকেটজাত ও তেলেভাজা খাবার অনেকের পছন্দ। চিকিৎসকদের মতে, পাইলসের রোগীর ভাজা খাবার উচিত নয়। এসব খাবার হজম ক্ষমতাকে দুর্বল করে এবং পাইলসের সমস্যা বাড়ায়।
৫. বিশেষজ্ঞদের মতে, কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগলে রক্তক্ষরণ হলে মাংস খাওয়া বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে রেডমিট খাবেন না। এ ছাড়া দোকান থেকে কেনা মাংসজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।
কেআই//