পাটে ফিরবে সোনালি অতীত
প্রকাশিত : ১৩:০৭, ১৩ মার্চ ২০১৯ | আপডেট: ১৫:৫০, ১৩ মার্চ ২০১৯
জাতীয় পাট দিবস ২০১৯-এর মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন ও ব্যবহারেই সমৃদ্ধি’। এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বাংলাদেশের বহুমুখী পাটপণ্যের ব্যবহার বাড়াতে এবং সম্ভাবনা তুলে ধরতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে পাটের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। পাটসমৃদ্ধ বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সামনে বহুমুখী পাটপণ্যের সম্ভার সাজিয়ে তার সক্ষমতা প্রমাণ করতে পেরেছে।
বাংলাদেশের পাট খাতের এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার নেপথ্যে রয়েছে বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন এবং এর ব্যবহার। পাটপণ্যের পাশাপাশি হরেক, বাহারি, নিত্যব্যবহার্য, ফ্যাশনেবল বহুমুখী পাটসামগ্রীর প্রসার ও বিপণন এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন গতিসঞ্চার করেছে। বাংলাদেশে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯১ দশমিক ৯৯ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদন হয়েছে। কাঁচা পাট রফতানি হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৯ লাখ টন। পাট রফতানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এ খাতে রফতানি আয় ১ হাজার ২৯৪ দশমিক ৬৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের উৎপাদিত প্রচলিত পাটপণ্যের পাশাপাশি সোনালি আঁশের তৈরি বহুমুখী পাটপণ্য নতুন মাত্রায় এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
২০০২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে এ দেশে বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠাকালে মাত্র ২১টি বহুমুখী পাটপণ্য নিয়ে স্থানীয় বাজারে আত্মপ্রকাশ করেন জেডিপিসির ১০ জন উদ্যোক্তা। প্রাথমিক পর্যায়ে গুটিকয়েক বাহারি পাটের ব্যাগই ছিল সম্বল। নান্দনিক সৌন্দর্য ও ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধের কারণে এসব ব্যাগ, বিশেষ করে নারীদের ফ্যাশনেবল ব্যাগ, জুতা ও জুয়েলারি বক্স ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করলেও সিনথেটিক পণ্যসামগ্রীর দাপটে অর্থাৎ এসব পণ্যের সুলভ মূল্য, সহজলভ্যতা ও সৌন্দর্যের কারণে প্রাকৃতিক তন্তুর তৈরি পণ্যসামগ্রীর অভ্যন্তরীণ বাজার প্রসারিত হওয়ার সুযোগ ছিল না।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক তন্তুর প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি, সিনথেটিকের পরিবর্তে প্রাকৃতিক তন্তুর পণ্যসামগ্রী ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাটের বহুমুখী ব্যবহারের সম্ভাবনাকে নতুনভাবে আশার আলো দেখায়। এভাবেই স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলার পাট প্রাকৃতিক তন্তু হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে জেডিপিসির নিবন্ধিত ৭০০ জন উদ্যোক্তা এখন ২৮০ ধরনের বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন করে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিপণনের মাধ্যমে পাট খাতে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন। তাদের উৎপাদিত বহুমুখী পাটপণ্যের স্থানীয় বাজার যেমন ব্যাপক, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারে এ দেশের বহুমুখী পাটপণ্যের চাহিদা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বহুমুখী পাটপণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজারের বিষয়ে আলোকপাত করলে দেখা যায়, ছয়-সাত বছর আগেও অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের তৈরি চালের বস্তা ও সুতলি ছাড়া তেমন কোনো বহুমুখী পাটপণ্যের বাজার গড়ে ওঠেনি। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার বহুমুখী পাটপণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়েছে। পাটপণ্যের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের নান্দনিক ব্যাগ, সেমিনার ফাইল ও প্রমোশনাল পণ্য, নানা ধরনের গৃহস্থালি, বাহারি সাজসজ্জায় ব্যবহূত পণ্যসামগ্রী অন্যতম। উল্লেখ্য, গত পাঁচ-ছয় বছরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধ-বিগ্রহের বিরূপ প্রভাবে প্রচলিত পাটপণ্যের ব্যবহার সংকুচিত ও স্থবির হলেও ধারাবাহিকভাবে বছরে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বহুমুখী পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে গত বছর প্রায় ৭০০ কোটি টাকার বহুমুখী পাটপণ্য রফতানি হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহূত পণ্যসামগ্রী, যেমন বিভিন্ন প্রকার ব্যাগ (ল্যাপটপ, স্কুল, লেডিস স্পোর্টস, ওয়াটারক্যারি, মোবাইল, পাসপোর্ট, ভ্যানিটি, শপিং, গ্রোসারি, সোল্ডার, ট্রাভেল, সুটকেস, ব্রিফকেস, হ্যান্ড ও মানিব্যাগ), হোম টেক্সটাইল (বেড কভার, কুশন কভার, সোফা কভার, কম্বল, পর্দা, টেবিল রানার, টেবিল ম্যাট, কার্পেট, ডোর ম্যাট, শতরঞ্জি), পরিধেয় বস্ত্র (ব্লেজার, ফতুয়া, কটি, শাড়ি) ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় অফিস অ্যাকসেসরিজ হিসেবে ফাইল ফোল্ডার, পেনহোল্ডার, কার্ডহোল্ডার, টিস্যুবক্স, টেলিফোন ইনডেক্স, ডায়েরি, প্যাড, ভিজিটিং কার্ড ইত্যাদির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন দপ্তর/সংস্থায় অফিস ব্যবহার্য হিসেবে পাটের তৈরি পণ্য ব্যবহার হচ্ছে, যা সবার জন্য একটা অনুসরণীয় উদাহরণ হয়ে উঠেছে। সরকারের অন্যান্য দপ্তর/সংস্থাও এ উদাহরণ অনুসরণ করতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি বহুমুখী পাটপণ্যের জনপ্রিয়তা দেশের সীমানা অতিক্রম করে বিদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর আগ্রহ ও চাহিদার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। এসব দূতাবাস বাংলাদেশের জাতীয় দিবস পালনের প্রাক্কালে বিদেশী অতিথিদের বহুমুখী পাটপণ্যের উপহারসামগ্রী প্রদানে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। পাটের তৈরি মানিব্যাগ, টাই, বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ, ফুল, কুশন কভার, অফিস অ্যাকসেসরিজ যেন সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার! দূতাবাসগুলোর এ ধরনের উদ্যোগে সাড়া দিয়ে জেডিপিসি বহুমুখী পাটপণ্যের প্রসার, প্রচার ও ব্র্যান্ডিংয়ে তাদের সহযোগিতা করে আসছে। এরই মধ্যে জার্মানি, চীন ও ডেনমার্কে বাংলাদেশ দূতাবাসে এ ধরনের কর্নার স্থাপন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বহুমুখী পাটপণ্যের সৌন্দর্য অবলোকন করাই নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে এ দেশের বহুমুখী পণ্যের প্রবেশের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
দেশের অভ্যন্তরে পর্যটন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে পরিবেশবান্ধব পাটপণ্যের গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে নিবন্ধিত উদ্যোক্তাদের পণ্যসামগ্রী প্রদর্শন ও বিক্রয়ের জন্য জেডিপিসির কার্যালয়ে একটি প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ কেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ ৯৩ লাখ ১৬ হাজার ৯৬৫ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নানা অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য এ কেন্দ্রের পণ্যসামগ্রী ক্রয়ের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ কেন্দ্রের প্রচার ও প্রসারের জন্য সফটওয়্যার তৈরি করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ সফটওয়্যার চালু হলে কেন্দ্রটি ভার্চুয়ালি পরিদর্শনসহ প্রায় ২০০ ধরনের উৎপাদিত বহুমুখী পাটজাত পণ্য সারা বিশ্বের ক্রেতা ও প্রতিষ্ঠান ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে দেখার সুযোগ পাবে, যা আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বহুমুখী পাটপণ্যের চাহিদা পূরণে জেডিপিসির উদ্যোক্তারা কাজ করে গেলেও তাদের পেশাগত দক্ষতা ও সুপ্ত উদ্ভাবনী প্রতিভা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, আর্থিক বরাদ্দ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অপরিহার্য। জেডিপিসির নিজস্ব ডিজাইন ইনস্টিটিউট, আর অ্যান্ড ডি এবং কম্পোজিট মিল না থাকায় উদ্যোক্তাদের বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল (ফ্যাব্রিকস, ডায়িং ও লেমিনেশন) প্রাপ্তিতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। উল্লেখ্য, বিশ্বে গ্রিন প্রডাক্ট, গ্রিন সলিউশন, গ্রিন গ্রোথ ইত্যাদি বিষয়ে অভাবনীয় সচেতনতা সৃষ্টির কারণে পলিথিন ব্যাগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে ৫৫টি দেশ, ৩১টি দেশে পলিথিন ব্যাগে কর আরোপ করা হয়েছে, ২৬টি দেশের কিছু অঙ্গরাজ্যে আংশিক নিষিদ্ধ, ভল্টারি চার্জ প্রযোজ্য করা হয়েছে ছয়টি দেশে এবং এশিয়ার ১২টি দেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২০২১-এর মাঝামাঝি নিষিদ্ধ কার্যকর হবে ২০টি দেশে। বিশ্বের ৫৫টি দেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করায় এর ব্যবহার ব্যাপক হারে কমে গেছে। গবেষণায় আরো দেখা যায়, ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ইউরোপের ১৮টি দেশের মধ্যে ছয়টি দেশে পাটের ব্যাগের চাহিদা বেড়েই চলেছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে, দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোয় এবং ফিলিপাইন ও আরব আমিরাতে পাটের ব্যাগের চাহিদা আকাশচুম্বী। তাই সারা বিশ্বে বহুমুখী পাটপণ্যের অপার সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার বিকল্প নেই।
এ দেশের বহুমুখী পাটপণ্যের প্রচার, প্রসার ও বিপণনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে এর ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য জেডিপিসি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে । তাই দ্বিধাহীনভাবে বলা যেতে পারে, বহুমুখী পাটপণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহারের মধ্যেই লুক্কায়িত আছে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনা। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ ও উন্নত দেশের তালিকায় উন্নীত করা এবং এসডিজি বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হলে বহুমুখী পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন একান্ত অপরিহার্য।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, জেডিপিসি
এসএ/
আরও পড়ুন