পোশাক শিল্পের মূল্য সংযোজন বাড়ছেনা, প্রয়োজন বিনিয়োগবান্ধব নীতি
প্রকাশিত : ১৬:৫৩, ১৬ মার্চ ২০২০
তৈরি পোশাক শিল্পের প্রকৃত মূল্য সংযোজন সাত অর্থবছর ধরে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশের মধ্যেই আটকে আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব শেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ফেব্রিক কেমিক্যালসহ কাঁচামালের বড় ধরণের আমদানি নির্ভরতাই এ শিল্পের মূল্য সংযোজনকে এক জায়গায় আটকে রেখেছে।
অর্থনীতিবিদ এবং এ খাতের ব্যবসায়ী নেতারা জানান, ‘শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে না পারার কারণেই এখনও আমদানি নির্ভরতা রয়ে গেছে। কিন্তু এ খাতের রপ্তানি আয় বাড়ানোর পাশাপাশি মূল্য সংযোজন কি করে আরও বাড়ানো যায় এবং শিল্পকে কি করে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারি সেই আলোচনাকেও এখন সমান গুরুত্ব দিতে হবে।’
সবশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি ছিল ৩৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার, তবে এজন্য কাঁচামাল আমদানি করতে হয়েছিল ১২ দশমকি ১৭ বিলিয়ন ডলার, ফলে মূল্য সংযোজন হয়েছিল ৬৪ দশমিক ৩২ শতাংশ।
এর আগে ২০১২-১৩ অর্থ বছরে ২১ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল, যার জন্য ৮ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার কাঁচামাল আমদানির কারণে মূল্য সংযোজন হয়েছিল ৬১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
Financial year | RMG Export | Raw materials import(million USD) | Value addition(%) (million USD) |
২০১২-১৩ | ২১৫১৫.৭৩ | ৮২২৬.৯৭ | ৬১.৭৬ |
২০১৩-১৪ | ২৪৪৭১.৮৮ | ৯৬৬৩.৫৩ | ৬০.৫১ |
২০১৪-১৫ | ২৫৪৯১.৪০ | ৯৫৯১.৭২ | ৬২.৩৭ |
২০১৫-১৬ | ২৮০৯৪.১৬ | ১০২১০.৬৩ | ৬৩.৬৬ |
২০১৬-১৭ | ২৮১৪৯.৮৯ | ১০৭৬০.১২ | ৬১.৭৮ |
২০১৭-১৮ | ৩০৬১৪.৭৬ | ১১৯৫৭.৮০ | ৬০.৯৪ |
২০১৮-১৯ | ৩৪১৩৩.২৭ | ১২১৭৮.৩১ | ৬৪.৩২ |
১৯৮৩-৮৪ অর্থবছর থেকে শুরু করে প্রতিবছরই তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ইতিবাচক এবং ধাপে ধাপে এ খাত দেশের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সবশেষ সাত অর্থবছরে এ খাতের মূল্য সংযোজন ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশের মধ্যেই উঠা-নামা করেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে এ খাতের রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ২১ শতাংশ কম। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গোটা অর্থনীতিতে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, শুরুতে সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর হলেও এখন ফেব্রিক, এক্সসরিসসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই দেশে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এখনও আমদানি নির্ভরতা একেবারে কম নয়। এ নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারলে আমদানি ব্যয় কমার পাশাপাশি দেশের প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক লেনদেনের ভারাসাম্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ নিটওয়ার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন- বিকেএমইএ’র ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘নিটওয়ারে ৮৫ শাতংশ পর্যন্ত মূল্য সংযোজন হচ্ছে। কিন্তু ওভেন ফেব্রিকের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশই এখনো আমদানি করতে হচ্ছে। পাশাপাশি রাসায়নিকের প্রায় সবটাই আমদানি নির্ভর। ফলে সামগ্রিকভাবে মূল্য সংযোজন এক জায়গায় আটকে আছে।
সবধরণের বেকওয়ার্ড লিংকেজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারলে আমদানি ব্যয় কমার পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যের লিড টাইম ও খরচ দুটোই কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হতো। এমটাই যোগ করেন তিনি।
তুলা :
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বেশিরভাগই তুলা নির্ভর। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ তুলা আমদানিকারক দেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮২ লাখ বেল তুলা আমদানি হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে যার মূল্য ২ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার।
এই বিপুল পরিমাণে তুলা দেশে উৎপাদন করতে গেলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে। তবে তুলা উন্নয়ন বোর্ড বলছে, খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে না ফেলেও বাৎসরিক তুলার উৎপাদন ৮ থেকে ১০ লাখ বেলে উন্নীত করা সম্ভব। খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু তুলার অনেক জাত রয়েছে, যেগুলো এই ধরণের জমিতে চাষ হচ্ছে।
পাশাপাশি সাথি বা রিলে ফসল হিসাবেও অন্য ফসলের সাথে বা বাগানে তুলা চাষ করা যায়। তুলার পাশাপাশি বিজ থেকে পাওয়া যায় ভোজ্য তেল ও খৈল। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় তুলা চাষে কৃষকের বিঘা প্রতি লাভ হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু তারপরও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে তুলা উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৭১ হাজার বেল।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় খাদ্য উৎপাদনকে, ফলে কৃষি মন্ত্রণালয় অন্য সব বিভাগকে বরাদ্দ দেয়ার পর আমাদের কথা বিবেচনা করে। যে কারণে আমাদের জনবল, বরাদ্দ সবক্ষেত্রে বড় ধরণের ঘাটতি আছে।’
সুতা ও কাপড় :
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএমএ’র তথ্য বলছে, দেশে এখন স্পিনিং মিল আছে ৪৩৩টি যাদের বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা ২৯ কোটি ৬৪ লাখ কেজি। অন্যদিকে ৮০৯টি টেক্সটাইল মিলের বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা ৩৭ কোটি ৬১ লাখ মিটার।
কিন্তু তারপরও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারের সুতা ও ৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারের ফেব্রিক আমদানি হয়েছে। বিটিএমএ বলছে, রপ্তানি মুখী শিল্পের চাহিদা পূরণ করতে না পারার কারণেই এ আমদানি।
এ বিষয়ে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন জানান, ‘একটা ওভেন ফেব্রিক কারখানা করতে কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকার প্রয়োজন, সাথে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ। এ শিল্পে মুনাফার হারও খুব বেশি নয়। ফলে বর্তমানে ব্যাংক ঋণে যে সুদের হার তাতে দেশিয় উদ্যোক্তারা এ ধরণের নতুন বিনিয়োগে যেতে সাহস পাচ্ছেন না।’
এমন পরিস্থিতিতে ওভেন ফেব্রিকে স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে হলে বিদেশী বিনিয়োগের কোনও বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।
ডাইস ও কেমিক্যাল :
২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন ধরণের কেমিক্যাল আমদানি হয়েছে ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারের, পাশাপাশি ৬৯৩ মিলিয়ন ডলারের ডাইং ও ট্যানিং মেটারিয়ালও আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে কত ভাগ পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট তার সুনির্দিষ্ট কোন হিসাব নেই কারো কাছেই।
শুধুমাত্র কস্টিক সোডা ও হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছাড়া আর সব কেমিক্যালই আমদানি করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে এ খাতের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান ডাইজেন-কেম লিমিটেড।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মো. আমানুর রহমান বলেছেন, ‘স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করলে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হয় গার্মেন্টস ও টেক্সটাইলের বন্ডেড সুবিধার আওতায় শুল্ক মুক্তভাবে আমদানিকৃত কেমিক্যালের সাথে। আর স্থানীয় টেক্সটাইলের জন্য কেমিক্যালের চেয়ে কাঁচামালের আমাদানি শুল্কই বেশি পড়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘রপ্তানি মুখী শিল্পের জন্য ডাইস ও কেমিক্যাল উৎপাদন করতে হলে আমাদের তাদের থেকে প্রথমে ইউডি নিয়ে তারপর ইউপি ইস্যু করতে হয়, যে ঝামেলায় কোন টেক্সটাইল বা গার্মেন্স মালিক যেতে চান না। এই সব নীতির পরিবর্তন না হলে ডাইস ক্যামিকাল উৎপাদনে দেশি বা বিদেশী কোন প্রতিষ্ঠানই বিনিয়োগ করবে না।’
এক্সসরিস :
প্রায় চার দশকের যাত্রায় এই একটি বেকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পই সফলভাবে গড়ে উঠেছে। পোশাক শিল্পের এক্সসরিসের ৯৫ শতাংশই এখন দেশে উৎপাদিত হয়। এ খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সসরিস ম্যানুফ্যাকচারাস এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন -বিজিএপিএমইএ’র তথ্য বলছে, গেল অর্থবছরে তাদের মোট রপ্তানি ছিল সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার সরাসরি রপ্তানি।
আর বিজিএপিএমইএর সভাপতি আব্দুল কাদির খান বলেন, ‘এখন অর্ডার দেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেও আমরা এক্সসরিস সরবরাহ করতে পারি, আগে এজন্য কয়েক সপ্তাহ সময় লাগত, খরচও বেশি পড়তো।’
তবে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট-পিআরআই বলছে, এক্সেসরিসের বেশিরভাগই এসএমই প্রতিষ্ঠান হওয়ায় দ্রুতই গড়ে উঠেছে। কিন্তু ওভেন ফেব্রিক বা ডাইস-কেমিক্যালে বড় বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়। বিনিয়োগ বান্ধব নীতি ও অবকাঠামো ছাড়া এগুলো গড়ে উঠবে না।
পিআরআইয়ের পরিচালক বজলুল হক খন্দকার বলেন, ‘চার দশক ধরে পোশাক শিল্পকে বন্ড সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এখন আলোচনা চলছে কি করে অন্য সব শিল্পকেও এ সুবিধার আওতায় আনা যায়। কিন্তু আলোচনা করা উচিত কি করে ধাপে ধাপে সবধরণের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বন্ড সুবিধা থেকে বেরিয়ে আসা যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘পোশাক শিল্পের জন্য বন্ড সুবিধা আপাতত অব্যাহত রেখেই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাইলে এ খাতে ভর্তুকি বা প্রণোদনা দিতে হবে। না হলে এখানে বিনিয়োগের ঝুঁকি কেউ নেবে না।’
এসএ/
আরও পড়ুন