প্রজাপতি ত্বক নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে চায় মেয়েটি
প্রকাশিত : ০৯:১৬, ২০ জানুয়ারি ২০২০
লুসি বেল লোটের বয়স বিশ বছর এবং তার এপিডারমোলাইসিস বুলোসা (ইবি) নামের একটি বিরল রোগ রয়েছে।
এর মানে হলো, তার শরীরের ত্বক সামান্যতম স্পর্শে ছিঁড়ে যেতে পারে এবং ফোস্কা পড়তে পারে। লুসিকে অনেক সময়েই বেদনাদায়ক ক্ষতগুলো বেঁধে রাখতে হয়।
যে তরুণদের ইবি নামের এই বিরল রোগ রয়েছে, অনেক সময় তাদের ডাকা হয় ‘বাটারফ্লাই চিলড্রেন’ বা ‘প্রজাপতি শিশু’ বলে। কারণ তাদের শরীরের চামড়া প্রজাপতির ডানার মতো ভঙ্গুর।
লুস বলেন, বেশিরভাগ সময়ে অনলাইনে আমি যে প্রশ্নের মুখোমুখি হই, সেটা হলো, এটা কি কষ্টকর? আর আমি তখন বলি, হ্যাঁ। ক্ষত বের করা বেশ ভালোই কষ্টকর হতে পারে।
‘এই মুহূর্তে আমার গোড়ালিতে একটি বড় ক্ষত রয়েছে, আমি সত্যিই সেটার ব্যথা অনুভব করতে পারি।’
এটা লুসিকে ভেতর থেকেই আহত করতে পারে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, কিশোরী বয়সে তার গলায় বেশ কয়েকটি অপারেশন করতে হয়েছে, কারণ তার গলার ভেতরেও এরকম ক্ষত দেখা গিয়েছিল। এ ধরণের রোগে আক্রান্ত মানুষজন অল্পবয়সেই মারা যায়।
ইবি রোগটি বংশগত, যার মানে হলো লুসি এই রোগটি পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পেয়েছেন এবং সেটা ধরার কোন উপায় নেই। রোগীরা এ থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয় না।
ধারণা করা হয়, বর্তমানে শুধু যুক্তরাজ্যে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের ইবি রোগটি রয়েছে এবং সারা বিশ্বে এই ধরণের রোগীর সংখ্যা পাঁচ লাখ।
টেক্সাসের অস্টিন থেকে আসা লুসি বর্তমানে স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রু ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছেন।
তিনি বলেন, তার ইবি রোগ প্রথম সনাক্ত করা হয় তার জন্মের সময়ে। কারণ জন্মের সময় তার শরীরের বেশ কয়েকটি জায়গায় কোনও চামড়া ছিল না।
‘যখন একজন সেবিকা আমার শরীর থেকে একটি মনিটরের বাটন সরিয়ে নিতে গেলেন আর শরীরের পুরো চামড়াটি উঠে এলো, তখন তারা বুঝতে পারলো কোনও একটা বড় ধরণের সমস্যা রয়েছে,’ লুসি বলছিলেন বিবিসির রেডিও ওয়ান নিউজবিটকে।
লুসি বলেন, আমার সঙ্গে যেন আমার ছায়ার মতো বেড়ে উঠতে থাকে ইবি রোগটি। যখন আমি আমার নাম জানলাম, একই সময়ে আমি এটাও জানলাম যে, আমি কী অবস্থায় রয়েছি এবং বুঝলাম যে আমি জীবনসীমায় রয়েছি।
কিন্তু নিজের অবস্থার কারণে জীবনকে নেতিবাচকভাবে দেখার পরিবর্তে লুসি বরং ভিন্নভাবে দেখতে শুরু করলেন।
এই রোগে আক্রান্তদের জন্য একজন সোচ্চার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠলেন লুসি এবং সচেতনতা তৈরিতে কাজ শুরু করলেন।
ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকার দেয়া, সচেতনতা তৈরি করা এবং পড়াশোনার পাশাপাশি প্রথম উপন্যাস লেখার কাজও শেষ করেছেন লুসি।
রোগটির কারণে ছোটবেলায় তাকে স্কুলে পড়াশোনা বাদ দিতে হয়েছে, যা তাকে এ বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে শিখিয়েছে।
তিনি বলেন, আমি স্কুল ভালবাসতাম। আমি অদ্ভুত একটা বাচ্চা ছিলাম যে এতটাই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, আমি ভেবেছিলাম, আমি হয়ত কখনোই আর কিছু শিখতে পারব না। কিন্তু আমি দেখলাম ইবি রোগ আমার শেখার কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারল না।
নিজের ছবি ইন্সটাগ্রামেও পোস্ট করেন লুসি। তিনি বলছেন, এই রোগ নিয়ে টিকে থাকা অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সংযোগের জন্য এটা একটি বিশাল মাধ্যম।
লুসি বলেন, একজন কিশোরী হওয়া কঠিন একটি সময়। কিন্তু এ ধরণে একটি রোগ থাকা, যা আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়, সেটাকে আরো কঠিন করে তোলে।
‘সুতরাং কোনও কিশোর-কিশোরী যদি তাদের মতো সমস্যা থাকা কাউকে মিডিয়ায় দেখতে পায়, তাহলে সেটা তাদের সাহায্য করতে পারে।’
এখন তিনি পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষজনের বার্তা পান, যাদের তার মতো একই ধরণের সমস্যা রয়েছে।
‘প্রতিদিন সকালে উঠে আমি মানুষের ‘ধন্যবাদ’ বার্তা পাই, যা আমার হৃদয় পূর্ণ করে তোলে।’
লুসির এই আচরণ ইবি কম্যুনিটিতে একেবারে নতুন নয় বলে বলছেন ক্যারোলিন কলিন্স, ইবি বিষয়ক দাতব্য সংস্থা ডেবরার গবেষণা বিভাগের প্রধান।
তিনি বলেন, আমার দেখা সবচেয়ে ইতিবাচক এবং অগ্রসর তরুণ মানুষদের মধ্যে তারা অন্যতম।
‘যখন আমি দেখি যে, তাদের মধ্যে কতজন স্কুলে যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে, চাকরিবাকরি করছে এবং প্রতিকূলতার মুখোমুখি হলেও সাধ্যমত সেরা জীবনযাপন করছে, সত্যি কথা বলতে আমি অবাক হয়ে যায়।। তারা সবাই চমৎকার মানুষ।’
কিন্তু বাস্তবতা হলো ইবি রোগটি আক্রান্তদের জীবন সংক্ষিপ্ত করে দেয়। এখন রোগটির তিনটি ধরণ রয়েছে। লুসি রোগটির যে ধরণে ভুগছেন, ডিসট্রফিক ইবি, সেটির লক্ষণগুলো ছোট আকার থেকে অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে। সবচেয়ে চরম হলো জংশনাল ইবি- যা সবচেয়ে বিরল।
সামনের সপ্তাহে বিশ্বের ইবি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি বৈঠকের আয়োজন করেছেন ক্যারোলিন, যা এই ধরণের রোগের সম্মেলনে সবচেয়ে বড়। লুসিও সেখানে যোগ দিচ্ছেন।
ক্যারোলিন বলছেন, গত কয়েক বছরে আমরা অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। কিন্তু এই খাতে আরও অনেক গবেষণার দরকার আছে। যেহেতু এটা বংশগত বিষয়, তাহলে হয়ত বংশগত কিছু চিকিৎসা সমাধান আমরা পেতেও পারি- যেসব চিকিৎসার জন্য সবাই স্বপ্ন দেখছেন।
‘ইবি রোগের কিছু ধরণের ক্ষেত্রে, কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যেই মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। অন্য রোগীরা হয়ত বিশ, ত্রিশ বা চল্লিশ বছর পর্যন্ত জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন।’
কিন্তু লুসির কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে নজর দেয়া।
তাদের কাছে অনেক কাজের একটি তালিকা আছে। ‘এ বছরেই সচেতনতা তৈরিতে আমি আরও অনেক বেশি কাজ করতে চাই। অনেকগুলো ইন্টার্নশিপের জন্যই আমার আবেদন করতে হবে এবং সেই সঙ্গে আমার মাস্টার্স ডিগ্রিটাও শেষ করতে চাই।’ এটা যদি আমার ওপর নির্ভর করত, তাহলে সারাজীবন ধরে আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতাম।’
সূত্র: বিবিসি
একে//