ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

কোটা ও চাকরিতে বয়সসীমা

প্রধানমন্ত্রী একবার ভাববেন কি?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৩১, ৩০ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৯:৪৬, ২ এপ্রিল ২০১৮

মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস। এই মাসেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মহান এই নেতার ডাকে বাংলার মানুষ স্বাধীনতার জন্য ঝাপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি হায়েনাদের ওপর। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের আজকের লাল-সবুজের বাংলাদেশ। মহান এ নেতার ডাকে সারা দিয়েছিলেন বাংলার বীররা। তারা জীবনকে তুচ্ছ করে বাজি ধরেছিলেন দেশ মাতৃকাকে রক্ষার জন্য। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকের সোনালী স্বাধীন এ দেশ। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, তাদের ঋণ শোধ করার মতো সাধ্য নেই এই জাতির। তারাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। বাঙালি জাতি তাদের ঋণ কোনো কালেই শোধ করতে পারবে না। আর এ ঋণ শোধ করারও নয়। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে জাতীয় এই বীরদের। তাই ২৬ মার্চ জাতি যথাযোগ্য মর্যাদায়  এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৬ মার্চ জাতীয় স্বাধীনতা দিবস পালন করা হচ্ছে।

আমাদের এই স্বাধীনতা একদিনে অর্জিত হয়নি। দীর্ঘ সংগ্রাম আর ত্যাগের মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছে। জাতীয় এই বীরদের জীবনের বিনিময়ে আমরা যে বাংলা পেয়েছি, সেই বাংলায় জাতীয় এই বীরদের যেনো কোনো অসম্মান না হয় সেদিকে নজর দেওয়া আমাদের সবার কর্তব্য। এখানে আমরা বলতে দেশ-জাতির সবার কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্র তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেবে এটাই কাম্য। দেশের সাধারণ মানুষরা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবেন এটাই নিয়ম হওয়া উচিৎ। কারণ তারা সেই দিন পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে আজও আমাদের পরাধীন জাতি হিসেবে থাকতে হতো এই বাংলায়। সেই দিন জাতির জনক মহান স্বাধীনতার ডাক না দিলে আজও হয়তো স্বাধীন হতো না আমাদের এই মাতৃভূমি। আর মহান এই নেতার আহ্বানে জাতির এই বীর সেনারা সাড়া না দিলে হয়তো কোনো সময়ই দেশ স্বাধীন হতো না। তাই তো তাদের প্রতি সব সময় অজস্র শ্রদ্ধা, লাখো লাল সালাম। তারা দেশের জন্য, জাতির জন্য যুদ্ধ করেছে তাদের সম্মান প্রাপ্য। রাষ্ট্র তাদের সব দায়িত্ব নেবে এটাই কাম্য। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই বীর সেনানীদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া। মর্যাদা বলতে তাদের শুধু পুরস্কার নয়। তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হবে। খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। কারণ তারা দেশের জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। তাই রাষ্ট্রের যত ধরণের সুযোগ রয়েছে সবটাই তাদের প্রাপ্য বলেই মনে করি। শুধু আমি না, আমার মতো সবার-ই এটা মনে করা উচিৎ।

আমদের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা তাইতো বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা যুদ্ধ না করলে আজ দেশ স্বাধীন হতো না। দেশের মানুষ আজ চাকরি করতে পারতো না। পাকিস্তানের গোলামী করতে হতো।

সম্প্রতি তিনি আরও বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু ছেলে মেয়েই নয়, তাদের নাতি পুতিরাও কোটা সুবিধা পাবেন। আমরা দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তাদের বিশেষ সম্মানে সম্মানিত করেছি। কারণ তাদের আত্মত্যাগের জন্য আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। একথা ভুললে চলবে না।

তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আমাদের সম্মান দিতেই হবে। তাদের ছেলে মেয়ে নাতি পুতি পর্যন্ত চাকরিতে কোটার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আর যদি কোটায় তাদের না পাওয়া যায়, তাহলে কোটা শিথিল করা যাবে। সেখানে মেধাবীরা চাকরি পাবে।

প্রধানমন্ত্রীর সব কথায় ঠিক রয়েছে। এ নিয়ে বিতর্ক করার কোনো সুযোগ রয়েছে বলে মনে করি না। কিন্তু এই স্বাধীনতার মাসেই কয়েকদিন থেকে একটি বিষয় চোখে পড়ছে। সারাদেশেই প্রথম শ্রেণির প্রায় সব কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আনন্দোলন করছেন। তাদের দাবি কোটা প্রথার সংস্কার। কেনো তারা এই দাবি করছে। কি তাদের উদ্দেশ্য? এতে লাভবান কারা হবেন? কেউ কি এতে ইন্ধন দিচ্ছেন? এ ধরনের আনন্দোলনে কেনো এই মেধাবী শিক্ষার্থীরা? এ রকম অনেক প্রশ্ন অনেকের মাথায় জাগতে পারে। তাদের এই আনন্দোলন কেনো অনেকে সমর্থন করছেন। আবার অনেকেই কেনো বিরোধীতা করছেন এমন বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়ে ঘোর খাচ্ছে।

যতদূর জানা যায়, আনন্দোলনরত ‍শিক্ষার্থীরা বেশ কয়েকটি দাবি করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সীমিত করা। তাদের দাবি কতটা যৌক্তিক সেদিকে না যেয়ে একটু বলতে চাই প্রধানমন্ত্রী তাদের দাবিটা নিয়ে একবার ভাবা যেতে পারে।

কোট সংস্কার নিয়ে  ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেছেন, কোটা ব্যবস্থা একদম থাকবে না, এমনটা নয়। সর্বসাকুল্যে ১০ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে। এগুলো যেমন- শারীরিক প্রতিবন্ধী, উপজাতি, নারী এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য রাখতে হবে। কোটার জন্য যোগ্য ও মেধাবীরা কোনোভাবেই যেন বঞ্চিত না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মেধাবী ও যোগ্যতাসম্মত লোক বঞ্চিত হলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বলেছেন, বর্তমানে দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি বিশেষ করে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা প্রচলিত। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী কোটায় ১০, জেলা কোটা ১০, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পাঁচ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে এক শতাংশ কোটা। বাদবাকি ৪৪ শতাংশ আসনের জন্য ফাইট দিচ্ছে সংখ্যাগুরু বিপুল সংখ্যক মেধাবী। সংখ্যাগুরু সাধারণ চাকরিপ্রার্থী এবং সংখ্যালগু কোটাধারীদের মধ্যে এত বড় বৈষম্য সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই।

সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ  কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বলেন, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ও দেশের পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ছাড়া কোনো কোটা রাখা উচিৎ নয়। তাদের (প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী) কোটার মধ্যে রাখলেও এক শতাংশের বেশি রাখা উচিৎ হবে না। এর মাধ্যমে এক শ্রেণির লোকজন সুবিধা ভোগ করে আসছে। এর ফলে দেশের সঠিক মেধাবীরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাচ্ছে না। দেশের সার্বিক উন্নয়ন মেধাবীদের সঠিক সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বলেন, কোটা পদ্ধতি একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। সেই কারণেই আমরা এখানে কোটা পদ্ধতি করেছি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নারীদের জন্য কোটা করলেন। অন্যান্য ক্ষেত্রেও কোটা করলেন। পরবর্তীতে সেই কোটার পরিমাণ হয়তো বাড়ানো কমানো হয়েছে, সমাজের বাস্তবতায়। কিন্তু এখন যে পর্যায়ে এসেছে, আমাদের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগ দেওয়ার জন্য এ পদ্ধতি নিয়ে পুনঃমূল্যায়ন করা দরকার। সব ক্ষেত্রেই এখন হয়তোবা কোটার দরকার নেই। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দরকার আছে। তথ্যের ভিত্তিতে এটা পুনর্গঠন করা যেতে পারে। কিন্তু একেবারে বিলুপ্তি এ মুহুর্তে সম্ভব না। এটা ধীরে ধীরে করা যেতে পারে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ২০১৫ সালের এক নিবন্ধে কোটা সংস্কারের কথা বলেছিলেন। তিনি ‘মেধার বিপরীতে কোটা—যৌক্তিক পর্যায়ে হ্রাস করুন’ শিরোনামে কোটা প্রথা সংস্কারের কথা বলেছিলেন। কোটা সংস্কারের জন্য এটাই প্রথম আনন্দোলন নয়। এর আগেও একবার আনন্দোলন করেছিল সাধারণ শিক্ষার্থারা। সেবার সফল হয়নি এবার তারা কতটুকু সফল হবে তা সময় বলে দিবে।

দেখা যাচ্ছে অনেক শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা কোটা সংস্কার নিয়ে কথা বলেছেন। এছাড়া সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য আনন্দোলন করে আসছে। আগামীকাল রাজধানীর শাহবাগে মহাসমাবেশ ডেকেছে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে আনন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। দেশের প্রথম শ্রেণির প্রায় সব কয়েকটি গণমাধ্যমে এমন সংবাদ হয়েছে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করার দাবি জানিয়ে তারা বেশ কিছু দিন থেকে আনন্দোলন করে যাচ্ছে। অপর দিকে একদল শিক্ষার্থী সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য আনন্দোলন করে যাচ্ছে। যারা আনন্দোলন করে যাচ্ছে তাদের দাবিটা নিয়ে একটু ভাবা যায় কি না, একবার ভেবে দেখবেন প্রধানমন্ত্রী। তাদের দাবি যদি যৌত্তিক হয় তাহলে মেনে নিলে মনে হয়, দেশের জন্য, জাতির জন্য, রাজপথের ওই শিক্ষার্থীদের জন্য, সবার জন্যই মঙ্গল হবে, এমনটাই কাম্য।

লেখক: সাংবাদিক।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি