প্রবাসী শ্রমিকদের কান্না শোনার কি কেউ নেই?
প্রকাশিত : ২২:১৫, ২২ নভেম্বর ২০১৯
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে দেশের রিজার্ভ রেকর্ড গড়ছে। আর এই রিজার্ভ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিমাসে সাফল্যের ‘বার্তা’ প্রচার করে থাকে। রেমিটেন্সের অন্যতম মাধ্যম প্রবাসী শ্রমিক। বিদেশে মাথার ঘাম পায়ের ফেলে দেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন যারা সেই প্রবাসীরা কি ভালো আছেন?
ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, মালদ্বীপসহ ইউরোপের বহুদেশে প্রবাসীরা চরম দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। এসব দেশে বন্দী আছে হাজারো শ্রমিক। যারা কাজ করছেন তাদের অনেকেই বৈষম্য আর জুলুম-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। যাদের বাংলাদেশ সরকার রেমিটেন্স যুদ্ধা বলেছেন; সেই রেমিটেন্স যোদ্ধাদের কান্না থামাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?
সম্প্রতি সময়ে সৌদিআরবে প্রতিদিন চলছে ধরপাকড়, একামা (কাজের অনুমতি পত্র) থাকলেও ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে, সৌদিআরব কাজের কর্মক্ষেত্র কমে আসছে দিন দিন, এর মধ্যে আরো নতুন ভিসা নিয়ে আসছেন যারা, যে কাজে আসছেন সেই কাজ না করে অন্য কাজ করছেন, এক পেশায় এসে অন্য পেশার কাজ করলে ঐ কাজে কর্মরত অবস্থায় তাদের পেলে সেইখান থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন সৌদি পুলিশ, কিন্তু কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছেন তা কি আমরা কখনো জানার চেষ্টা করেছি? না করছেন আমাদের সরকার!
সৌদি আরবের বর্তমান সরকারের ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়ন এগিয়ে চলেছে আর কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি জায়গায় সৌদি নিয়োগ করন বাধ্যতামূলক রয়েছে। তাই দিনদিন কমে যাচ্ছে প্রবাসীদের চাহিদা। বর্তমানে সৌদি আরবে ২০ লক্ষেরও বেশি নারী পুরুষ শ্রমিক রয়েছে। কর্ম হারিয়ে বেকার সমস্যায় দিন কাটাচ্ছেন অনেক প্রবাসী। তাদের একামা (কাজের অনুমতি পত্র) নবায়ন, লেবার (শ্রম) ফি, কফিলের (নিয়োগ কর্তা) মাসিক টাকা, নিজের আনুষঙ্গিক খরচ সব মিলিয়ে দুর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছে অনেকে।
আবার অনেকে কফিলের (নিয়োগ কর্তার) কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া, তাদের ভিসা নবায়ন হচ্ছে না। ভিসার উপর হুরুপ (পলাতক) আরোপ দেখাচ্ছে কফিল (নিয়োগ কর্তা)। সেই সমস্ত প্রবাসীরা একে তো আছে পুলিশের ভয়, তদুপরি কাজের সমস্যা কোথাও কাজ পায় না। হুরুপ (পলাতক) একামা ধারি প্রবাসীদের তন্নতন্ন করে খুঁজচ্ছে পুলিশ। ধরতে পারলে জেল জরিমানা তারপর দেশে সফর (ফেরত)। তদুপরি পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা তো আছেই।
অনেক প্রবাসী আছেন যারা সৌদি কফিলের (নিয়োগ কর্তার) নামে ব্যবসা করে আসছেন। কেউ লোক সাপ্লাই করে, আবার কেউ বিভিন্ন ধরনের দোকান, যেমন কাপড়, ইলেকট্রনিক, হার্ডওয়্যার, খাবারের দোকান ও মুদি দোকানসহ নানান ধরনের ব্যবসা করে আসছেন। এই ব্যবসা নাম মাত্র সৌদি নাগরিক সব কিছু প্রবাসী নিজের নামে করে আসছেন। বর্তমানে সব ক্ষেত্রেই সৌদি নাগরিকদের চাকরি বাধ্যতামূলক হবার কারণে সেই সব ক্ষেত্রেই প্রবাসীদের কর্ম হারাতে হচ্ছে প্রতিনীয়ত। এসব ব্যবসায়ও নানান সমস্যার কারণে অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে দেশে চলে যাচ্ছেন।
যারা পরিবার নিয়ে প্রবাসে বসবাস করছেন তাদেরও সমস্যার শেষ নেই। সৌদি সরকারের বর্তমান আইন অনুযায়ী পরিবারের প্রতি জন সদস্যের জন্য বাৎসরিক ফি এবং সেই ফি দিগুন হওয়ার কারণে অনেকেই পরিবার দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। যারা পরিবার নিয়ে আছেন তারাও পরিবার নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। যার কারণে প্রভাব পড়েছে প্রবাসী কমিউনিটি পরিচালিত বাংলাদেশ স্কুলগুলোতেই। ছাত্র-ছাত্রী হারাচ্ছেন দিন দিন। যার ফলে স্কুলগুলো চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। কর্ম হারাচ্ছেন অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মচারী।
এমতাবস্থায় আবার দেশ থেকে নতুন ভিসায় লোক আসছে প্রতিনীয়ত। তবে নতুন ভিসায় যারা কোম্পানির কাজের ভিসা, কাজের ধরণ এবং কন্ট্রাক্ট পেপার বা কাজের চুক্তি করে আসছে তাদের জন্য ভালো। আর যারা না জেনে অথবা দালালের খপ্পরে পড়ে বাসার কাজের ভিসা আমেল ম্যানজলি, হাছ ছোঁয়াগ বা নিজস্ব ড্রাইভার ও ফ্রি ভিসাই আসছেন তাদের পরিস্থিতি অনেক খারাপ।
শুধু তাই নয়, ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আসছে বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ। তন্মধ্যে যারা চুক্তি ও কাজ নিশ্চিত করে আসছেন তারা কাজ পাচ্ছেন কিন্তু যাঁরা ফ্রি ভিসা নামে আসছেন তারা কাজ না পেয়ে অনেকে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
ঘরের কাজের ভিসা- এই ভিসাগুলো সাধারণত ঘরের কাজের কর্মী। এই ভিসাই যারা আসছেন অধিকাংশ মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এসে একামা (কাজের অনুমতি পত্র) পাই না। এমনকি বিদেশে আসার পর দেখা যায় ভিসাই হুরুপ বা পলাতক দেখিয়েছে। আমাদের দেশের ভিতরে গ্রামে গ্রামে কিছু দালাল চক্র রয়েছে যারা লোভে ফেলে নিরীহ মানুষের ভিটেমাটি বিক্রী করে বিদেশ এনে বিপদে ফেলছে।
হাছ ছোঁয়াক বা নিজস্ব ড্রাইভার- এই ভিসার ভালো দিকটা আগে বলি। এই ভিসা বাসার নিজস্ব ড্রাইভার। এতে আসার জন্য কোন টাকা লাগে না। এই ভিসাই আসলে নিশ্চিত হতে হবে আগে কাজ আছে কিনা। আর যে আসবে সেই ড্রাইভার কিনা। যদি দক্ষ ও গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে আসলে ভালো। আর দালালের মাধ্যমে নাম মাত্র ড্রাইভিং ভিসাই এসে বাহিরে কাজ করা মন মানসিকতা থাকে তাহলে আপনি নিশ্চিত বিপদে পড়বেন।
ফ্রি ভিসা- এই ধরনের কোন ভিসা নেই। যদি কেউ বলে থাকে তাহলে আপনার সাথে ধোকা দিচ্ছে। ফ্রি ভিসা লোকজন এসে কাজের ও কফিলের ( নিয়োগ কর্তার) সন্ধান না পেয়ে অনাহারে জীবন যাপন করতে হয় ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দালালরা অনেক সময় ভুয়া কোম্পানির নামে ভিসা পাঠায় বাংলাদেশে। এছাড়াও অনেক কোম্পানির নামে ভিসা দিচ্ছে যাদের কোনো কর্মীর চাহিদা নেই। ওই সব কোম্পানি টাকার বিনিময়ে এসব ভুয়া নিয়োগপত্র দিচ্ছে। ফলে সৌদি আরব এসে আয়-রোজগার করে দেশে পাঠানো তো দূরের কথা নিজেরাই খেতে পারছেন না।
জানা যায়, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যেসব কর্মী নিয়ে আসছে তাদের অনেকের দূতাবাসের সত্যায়ন নেই। ফলে বিপদগ্রস্থ কর্মীদের খুঁজে পাওয়া দূতাবাস ও কনস্যুলেটের জন্য দুস্কর হয়ে পড়ে।
প্রবাসে কর্মরত সৌদি গেজেট এর রিপোর্টার সিনিয়র সাংবাদিক রুমি সাঈদ এর মতে, বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের এক শ্রেণীর দালালচক্রের যোগসাজশে ফ্রি ভিসার নামে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সৌদি আরবে নিয়ে আসছে। দেশে জমি-জমা বিক্রী করে বিদেশে এসে হাজার হাজার শ্রমিক এখনো কর্মহীন। তাই এই ভিসাই যেন বাংলাদেশ থেকে কোন কর্মী না আসে সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। সরকারিভাবে প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে এর সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রবাসে কর্মরতদের দুঃখ দুর্দশার কাহিনী শুনলে চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন। মানুষগুলো পশুর মতো জীবন যাপন করে দেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে এসে ১০ ঘণ্টা থেকে ১৫ ঘন্টা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করছেন। সেই সব শ্রমিক যখন দূতাবাস ও কনস্যুলেটে সেবার জন্য যান, ভালো মতো সেবা পাই না এমন অভিযোগ আমরা শুনে থাকি প্রায়ই ।
এই ব্যাপারে আমরা জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল এফ এম বোরহান উদ্দিন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রিয়াদ দূতাবাস ও কনস্যুলেটের সেবা আগের চেয়ে তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রবাসীদের যাতে কনস্যুলেটে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে না হয় সেজন্য সৌদি আরবের প্রতিটি প্রদেশে আমরা কনস্যুলেট সেবা প্রদান করছি। প্রবাসীদের সমস্যা তাৎক্ষণিক সমাধানের লক্ষ্যে আমরা হট লাইন সেবা চালু করেছি যাতে করে প্রবাসীরা বিনা পয়সায় কল করে কনস্যুলেট সেবা সহ তাদের তাত্ক্ষণিক সেবা পেতে পারে।
তিনি আরো বলেন, কনস্যুলেটের কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে আমাকে সরাসরি জানাতে পারেন। সঠিক তথ্য প্রমাণিত হলে আমি অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। আমি আসার পর থেকে আমার টিম অনেক পরিশ্রম করছেন এবং দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অবশ্য সৌদি নাগরিক খালেদ নাছের আল জাহারানী মতে সৌদি আরবে বাংলাদেশী কর্মীদের প্রচুর সুনাম ও চাহিদা রয়েছে। দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
আমাদের সরকারের উচিত, সৌদিআরবের সরকারের সাথে আলোচনা করা, কেন তারা শ্রমিকদের এইভাবে ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে, তার সমাধান খোঁজে বের করে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা, ভিসা গেলে সঠিক কর্মক্ষেত্র , বেতন ভাতা ও আনুষঙ্গিক যাচাইয়ের মাধ্যমে শ্রমিক প্রেরণ করা, দূতাবাস গুলোকে আরো শক্তিশালী ও দক্ষ কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাধ্যমে পরিচালনা করার আহ্বান প্রবাসীদের, তাহলেই প্রবাসীদের কিছুটা হলেও কষ্ট লাঘব হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রশ্ন হলো যে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখছে; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়াচ্ছে; সেই শ্রমিকরা প্রবাসে নির্বিঘে কাজ করতে পারে সে ব্যাপারে সরকার কি উদ্যোগ নেবে..? সেটাই দেখার বিষয় প্রবাসীদের। বর্তমানে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এর কারণে দেশের জিডিপির শতকরা ১২ ভাগের উপর বৃদ্ধি পেয়েছে। যাদের কারনে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে প্রবাসে থাকা সেই শ্রমিকদের কান্না শোনার কি কেউ নেই..?
আরকে//
আরও পড়ুন