প্রবৃদ্ধির প্রত্যয় আওয়ামী লীগের ইশতেহারে
প্রকাশিত : ২১:৫৫, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮
নিত্যনতুন সরকারি উদ্যোগে দেশে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। তবে প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টির অনুপাত নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনা করে থাকেন। তবে সেই বিতর্ক যে আর বেশি দিন থাকছে না, তা আবারও পরিষ্কার হয়ে উঠলো আওয়ামী লীগের ইশতেহারে।
গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার। এদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিতদের বেকারত্বের হার বেশি। এই তথ্যের উল্লেখ করছি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিচালিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ থেকে।
জরিপে দেখা যায়, জাতীয় বেকারত্বের গড় হার অপরিবর্তিত রয়েছে। এ হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১১ দশমিক ২ শতাংশ। বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারী ও পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। এছাড়া অর্থনীতির রূপান্তরের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেশের কৃষি খাতে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা কমেছে, বিপরীতে বাড়ছে শিল্প ও সেবা খাতের শ্রম শক্তির সংখ্যা। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট শ্রম শক্তির ৫৬ শতাংশ কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে নিয়োজিত রয়েছে, যা সংখ্যায় ৬ কোটি ৮০ লাখ। শ্রম শক্তির বাইরে রয়েছে ৪ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ। আর গত এক বছরে দেশে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে ৩৭ লাখ মানুষের।
তবে নতুন কর্মসংস্থানের সংখ্যা বাড়বে আগামী ৫ বছরে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের অন্যতম বিষয় দক্ষ মানবসম্পদ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি। এই বিষয়টি স্থান পেয়েছে আওয়ামী লীগের ইশতেহারেও। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১০ বছরের মেয়াদে প্রতিটি কর্মসূচি, পদক্ষেপ ও প্রকল্পেই গুরুত্ব পেয়েছে অর্থনীতির প্রসার, নতুন কর্মসংস্থানসহ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের বিষয়গুলো। এর ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠী যেমন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে, তেমনি তা দেশের সার্বিক অর্থনীতির প্রসারেও সহায়ক হয়েছে।
টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগের বড় অবদান বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দেওয়া। ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। যে লক্ষ্যে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করার প্রতিশ্রুতি এসেছে একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে। এতে বলা হয়েছে, টানা তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেলে ‘টেকসই বিনিয়োগ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ নিশ্চিৎ করা হবে। এবারের ইশতেহারের শিরোনাম ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘দিনবদলের সনদ’ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছিল। এবারের ইশতেহারে কয়েকটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ। প্রাধান্য দেওয়া হযেছে তরুণ-যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের বিষয়টি। সঙ্গে রয়েছে সবার জন্য কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে সুষম উন্নয়নের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। আর উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বাড়ানো হবে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ। এ লক্ষ্যে থাকছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। আধুনিক কৃষি-ব্যবস্থার লক্ষ্য যান্ত্রিকীকরণ; দক্ষ ও সেবামুখী জনপ্রশাসন থাকছে এবারের বিশেষ কর্মসূচিতে। ব্লু-ইকোনমি ও সমুদ্রসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন একটা অর্থনীতির সূচনা করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ বলছে, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। ২০৩০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ৫ হাজার ৪৭৯ ডলারেরও বেশি। এখন মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৭৫২ ডলার। প্রতিটি গ্রামকে শহরে উন্নীত করার লক্ষ্যে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হবে প্রতিটি গ্রামে। পাকা সড়কের মাধ্যমে সব গ্রামকে জেলা/উপজেলা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। প্রতিটি উপজেলায় ‘যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপন করা হবে। জাতীয় পর্যায়ে স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের তথ্য সম্বলিত একটি ইন্টিগ্রেটেড ডাটাবেইজ তৈরি করা হবে। আগামী ৫ বছরে ১ কোটি ২৮ লাখ কর্মসৃজন করার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। প্রতি উপজেলা থেকে প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার যুব/যুব মহিলাকে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করার ঘোষণা রয়েছে আওয়ামী লীগের। আর নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে আলাদা ব্যাংকিং ও ঋণ সুবিধাও থাকছে এবারের কর্মপরিকল্পনায়। দারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজনের নিয়মিত রোজগার নিশ্চিত করা হবে। ছোট ও মাঝারি আকারের দুগ্ধ ও পোল্ট্রি খামার প্রতিষ্ঠা এবং মৎস্য চাষের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, প্রয়োজনমত ভর্তুকি, প্রযুক্তিগত পরামর্শ ও নীতি সহায়তা বৃদ্ধি করা হবে। ২০২০ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে ২৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবং ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হবে। পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে আধুনিক শিল্পনগরী গড়ে তোলা হবে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে আইটি শিল্প পার্ক স্থাপন করা হবে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যে ১০০টি উপজেলায় এ ধরনের ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজ চলছে। ইশতেহারের শেষে বলা হয়েছে, ‘আসুন আমরা সবাই মিলে এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি যেখানে মানুষের মৌলিক সব চাহিদা পূরণ নিশ্চিত হবে, গড়ে উঠবে সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার, যার যার ধর্ম পালনে স্বাধীনতা ও সম-অধিকার, নারীর অধিকার ও সুযোগের সমতা, তরুণদের শ্রম ও মেধার সৃজনশীল বিকাশ, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন, শহর ও গ্রামের বৈষম্য দূরীকরণ, দূষণমুক্ত পরিবেশ। গড়ে উঠবে এক অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনস্ক উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ-রাষ্ট্র।’
অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে এই ইশতেহারে। ‘কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষতা’, যা সবার জন্য যথোপযুক্ত কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ ও মাথাপিছু রেমিট্যান্স বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা কর্মসূচির কথাও বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির (বেজা) আওতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১০০টি ইকোনমিক জোন তৈরি করছে। এসব জোনে ১ কোটি দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ইকোনমিক জোনসমূহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা পালন করবে। ইকোনমিক জোনসমূহের মানবসম্পদ ও দক্ষতা চাহিদা বাড়াতেও অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা থাকছে এবারের প্রতিশ্রুতিতে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি, উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা রূপকল্প-২০২১ ও রূপকল্প-২০৪১-এর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার সুদূরপ্রসারী এবং কর্মসংস্থানবান্ধব। এটি সময়োপযোগী। যা উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন ও অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নে সহায়ক হবে। এই ইশতেহার বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা আগামী কয়েক বছরেই পাল্টে যাবে দেশের চালচিত্র।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশ যেমন এগিয়েছে, তেমনি তিনি পেয়েছেন ‘গ্লোবাল লিডার’ এর ভূমিকা। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাপী অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই, দেশের স্বার্থেই উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। কাজেই, রোববারের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করার বিকল্প নেই। তাই বলা যেতে পারে, তারুণ্যের কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির ধারা বাড়াতে এই সরকারের ধারাবাহিকতা রাখতে হবে। আমাদের প্রতিপাদ্য হোক, ‘তারুণ্যের প্রথম ভোট, উন্নয়নের স্বার্থে নৌকায় হোক।’
লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, এফবিসিসিআই।
এসএইচ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।