তারকালাপে মেসবাহ আহমেদ
প্লিজ না জেনে গজল গাইবেন না
প্রকাশিত : ১৫:৫৯, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৭:৩৯, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
গজলের উৎপত্তি আরব থেকে হলেও ফার্সি ভাষায় এটি বিশেষ বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে উর্দু ভাষায় এটি সমধিক জনপ্রিয়তা পায়। আরবি, ফার্সি, পশতু, উর্দু ছাড়াও হিন্দি, পাঞ্জাবী, মারাঠি, বাংলা, এমনকি ইংরেজিতেও গজল লেখা হয়। প্রাথমিক দিকে ইমাম গাযালী, মওলানা জালালুদ্দিন রুমী, হাফীজ সীরাজী, ফারুখউদ্দীন আত্তার, হাকীম শানাঈ প্রমুখ গজল লিখে বেশ নাম করেন। পরবর্তিতে আমির খশরু, মীর তাকী মীর, ইব্রাহীম জক, মীর্জা গালিব, দাগ দেলবী এবং আধুনিক কালে আল্লামা মহাম্মদ ইকবাল, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, ফিরাক গোরখপুরী গজল লেখক হিসাবে নাম করেন।
গজল হালকা মেজাজের লঘু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। আবার হালকা-গম্ভীর রসের মিশ্রণে সিক্ত আধ্যাত্মিক গান। গজল প্রেমিক-প্রেমিকার গান হলেও এ গান এমন একটি শৈলী- যাতে প্রেম ও ভক্তির অপূর্ব মিলন ঘটেছে। পার্থিব প্রেমের পাশাপাশি গজল গানে আছে অপার্থিব প্রেম, যে প্রেমে স্রষ্টার প্রতি আত্মার আকূতি নিবেদিত।
বাংলাদেশেও এই গজল সঙ্গীতের প্রচুর শ্রোতা রয়েছেন। তবে তাদের মনের খোরাক মেটাতে দেশীয় শিল্পী খুব বেশি নেই। দু’একজন যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে জনপ্রিয় গজলশিল্পী মেসবাহ আহমেদ। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র গজলশিল্পী, যিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত গজল ব্যক্তিত্ব জগজিৎ সিংয়ের শিষ্য। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই শিল্পী সঙ্গীতের এ ধারাটি দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। দেশের সেরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ নিয়াজ মুহাম্মদ চৌধুরীও মেসবাহ আহমেদের গুরু।
একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইনের একান্ত সাক্ষাৎকারে গজল সঙ্গীত নিয়ে কথা বলেছেন জনপ্রিয় এই তারকা। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন- সোহাগ আশরাফ
ইটিভি অনলাইন : মাঝে একটি দুর্ঘটনা গেলো। কেমন আছেন এখন?
মেসবাহ আহমেদ : আপনাদের দোয়াতে মোটামুটি ভালো আছি। মেডিসিন চলছে।
ইটিভি অনলাইন : যা হোক সুস্থ হয়ে উঠেছেন এটাই অনেক বড় বিষয়। সেদিন ঘটনাটি কি হয়েছিলো?
মেসবাহ আহমেদ : ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছিলাম। দিনটি ছিলো রবিবার (২৮ জানুয়ারি)। রাজধানীর নটরডেম কলেজের সামনে ঘটনাটি ঘটে। এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে বের হওয়ার সময় একদল ছিনতাইকারী আমাকে ঘিরে ধরে। অস্ত্রের মুখে ছিনতাইকারীরা মানিব্যাগ ও মোবাইল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের বাধা দেই। এ সময় ছিনতাইকারীরা আমাকে হিট করে পালিয়ে যায়। পরে পথচারীদের সহযোগিতায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। আসলে দেশে এখনও এমন ঘটনা ঘরে ভাবলে কষ্ট হয়। আমরা কার কাছে নিরাপত্তা চাইবো!
ইটিভি অনলাইন : সঙ্গীত চর্চা কেমন চলছে?
মেসবাহ আহমেদ : চলছে। কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হয়েছে। এখন মোটামুটি সুস্থ। আবারও কাজে মন দিচ্ছি।
ইটিভি অনলাইন : আপনি আমাদের দেশের প্রখ্যাত গজলশিল্পী। গজল সঙ্গীত নিয়ে কিছু বলেন?
মেসবাহ আহমেদ : গজল আসলে গানের বাইরের কিছু না। গজলও একটা মিউজিক, নজরুল সঙ্গীত, সূফীইজম, কাওয়ালী, রবীন্দ্র সঙ্গীত, লালনও একটা মিউজিক। কিন্তু প্রত্যেকাটার আলাদা আলাদা একটা গায়কি আছে। একটা আলাদা স্টাইল আছে। গজল কিন্তু ফার্সি, উর্দু ভাষায় গাওয়া হয়। আসলে এই ভাষাগুলো না জেনে গজল গাওয়াটা ঠিক নয়। আপনি গজল গাইছেন কিন্তু সঠিক উচ্চরণ যদি করতে না পারেন তবে ওই ভাষার মানুষগুলো এটা শুনলে হাসবে, লজ্জা পাবে। আমাদের দেশে অনেক ভালো ভালো কণ্ঠ আছে কিন্তু ভালো গজল গায়ক নেই।
ইটিভি অনলাইন : গজল, কাওয়ালী, সুফী সঙ্গীতের মধ্যে পার্থক্যটা আসলে কি?
মেসবাহ আহমেদ : গজল হচ্ছে পদ্য কবিতা। নজম হচ্ছে গদ্য কবিতা। কাওয়ালী হচ্ছে আধ্যাতিক সঙ্গীত। আর সূফী তো সূফীই। তবে গজলের মধ্যেও সুফীইজম আছে। এমন কোন কথা নেই যে গজল মানেই সূফী মিউজিক। গজলের মধ্যে প্রেমের বর্ণনা আছে, সুন্দরী রমণীর বর্ণনা আছে, কারও কোন আসক্তির বর্ণনা আছে।
ইটিভি অনলাইন : সূফী সঙ্গীত বলতে আমরা কি বুঝি?
মেসবাহ আহমেদ : সূফী মানে আধ্যাত্মবাদ। এটা কখনও কখনও গজলে আসে বটে, তবে সব সময় না।
ইটিভি অনলাইন : আমাদের দেশে গজল চর্চাটা কেমন চলছে?
মেসবাহ আহমেদ : এক কথায় বলবো- নাই। কেউ কেউ এই খালি ময়দানে গোল দেওয়ার চেষ্টা করে। দেখুন যিনি শিক্ষিত তিনি শৈল্পিক। যিনি শৈল্পিক তিনি শিক্ষিত। এটা কাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি। তবে এটা স্বমন্বয় নেই। গজল গাইতে হলে আপনাকে প্রথাগত তালিম নিতে হবে। আপনি যদি বলেন আমি বাঙালী আমার উচ্চরণ হয় না। আমার কথা হচ্ছে তাহলে আপনি গেয়েন না। আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত ভুল উচ্চরণে গাই এটা যেমন অপরাধ একই ভাবে এই গজলের ক্ষেত্রেও তাই। যদি না পারেন তবে না গাওয়াই ভালো। কিছু গজল শিল্পী আমরা দেখি কিন্তু তারা কাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে একেবারেই না।
তবে ভালো শিল্পী একে বারে যে নেই তা কিন্তু নয়। আমার গুরুজি নিয়াজ মুহাম্মদ চৌধুরী। রুণা লায়লা, শাহনাজ রহমতুল্লাহ অসাধারণ গাইছেন তারা। রুণা লায়লা যখন গজল গায় আমরা অবাক হয়ে যাই। এতো সুন্দর, এতো হাই কোয়ালিটি কল্পনাই করা যবে না।
ইটিভি অনলাইন : গজলের চর্চাটা কেনো এতো কম?
মেসবাহ আহমেদ : কষ্ট সাধ্য যে, তাই। আপনাকে গুরু ধরতে হবে। অনেক দিন সাধনা করতে হবে। অনেক খরচ করতে হবে। ডলারে পে করতে হবে। তাছাড়া সহজেই যদি জনপ্রিয়তা পাওয়া যায় তবে কেনো আমি কষ্ট করে এগুলো করব? নিজেকে প্রকাশের ধান্দা মাথায় ঢুকে গেছে সবার। শেখার জন্য বা সাধনার জন্য গান গাইছি খুব কম। সারাক্ষণ যদি আপনি অনুষ্ঠানের ধান্দায় থাকেন তবে কখন রেওয়াজ করবেন? আসলে এই বিষয়টিতে আমরা আহত।
ইটিভি অনলাইন : দৈনন্দিন ব্যস্ততা কি নিয়ে?
মেসবাহ আহমেদ : সব সময় আমি একই রকম থাকি। ব্যবসা-বাণিজ্য করি। মিউজিকতো করিই। বেছে বেছে অনুষ্ঠান করি। একটা মিউজিক ভিডিওর কাজ করছি। কাজ চলছে। হলে ইউটিউবে আপলোড করা হবে। এটা আধুনিক বাংলা গান। আমার লেখা ও সুরে। আমার তিনটি অ্যালবাম রয়েছে-নিজের লেখা ও সুরে।
ইটিভি অনলাইন : সাধারণত গজল কোন ভাষায় হয়ে থাকে?
মেসবাহ আহমেদ : গজল কিন্তু বাংলাতে হয় না। যেমন জাপানি ভাষায় নজরুল সঙ্গীত হয় না! তাই যদি হতো তাহলে রবীন্দ্রনাথ লিখতেন। বাংলায় গজল আঙ্ঘিকের গান আছে, তবে ওটা গজল না। গজল লেখার কিছু কায়দা-কানুন আছে।
একবার আমাকে বলা হয়েছিলো আপনি কিছু গজল বাংলা লিখে দিবেন, সুর করবেন এবং গাইবেন। আমি তখন ১৬টি গজল করে দিয়ে ছিলাম। তবে চেষ্টা করলে হয়। সেই সুযোগটা দিতে হবে।
ইটিভি অনলাইন : কেউ যদি গজল সঙ্গীতে নিজেকে প্রকাশ করতে চায় তবে আপনার উপদেশ কি থাকবে?
মেসবাহ আহমেদ : আমি তাদের সাজেশন দিতে পারবো কি না জানি না। তবে একটাই কথা বলবো যে- প্লিজ না জেনে গজল গাইবেন না। সিডি বা ক্যাসেট থেকে তুলে গজলশিল্পী হওয়া যায় না। আপনি খেয়াল করে দেখবেন রমজান মাস আসলে যিনি কোন দিন গজল গায়নি তাকেও ফোনলাইভ করতে দেখা যায়। আমি চাইলেই একক ভাবে লালন সন্ধ্যা করতে পারিন না যদি কিনা আমার লালন গীতির সেই চর্চাটা না থাকে। আপনি শুধু নিজেকে ফেমাস করার জন্য, কয়টা টাকার জন্য, নিজেকে আরও একটু বেশি জনপ্রিয় করার জন্য আপনি গজল গেলে ফেললেন এটা কি ঠিক? একজন শিল্পী হিসেবে আপনার কমিটমেন্টটা কোথায়? আপনি হুট করেই সিডি বা ইউটিউব থেকে তুলে গজল গাইতে পারে না। আপনিতো এগুলোর চর্চাই করেননি তবে কোথা থেকে আসলেন?
অনেক কিছু বলে ফেললাম, সে জন্য দু:খিত। কিন্তু ভাই বাস্তবতা এটাই।
ইটিভি অনলাইন : আপনি গজল ছাড়া অন্য কোন গান কি করেন?
মেসবাহ আহমেদ : হ্যাঁ। আমি আধুনিক বাংলা গান গাই। আমার লেখা ও সুরে অ্যালবাম আছে। আমি লিখতে পছন্দ করি। আমি গাইতে পছন্দ করি। আমি সুর করি, কম্পোজ করি। অন্যদের জন্যও সুর করি।
ইটিভি অনলাইন : অনেক ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
মেসবাহ আহমেদ : আমি মন থেকে বলছি একুশে টেলিভিশনের প্রতি অনেক অনেক কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ আপনাকেও। ধন্যবাদ সবাইকে।
এসএ/