বঙ্গবন্ধুর আগমনেই স্বাধীনতার বিচ্ছুরণ হয়
প্রকাশিত : ১০:৫৩, ১৫ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৭:১৩, ১৫ জানুয়ারি ২০২০
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ফাইল ছবি
বর্তমানে একুশে টেলিভিশন’র নিজস্ব প্রতিবেদক। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক, ডেইলি নিউএইজ, এনটিভি’র কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ছিলেন ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি’র নেতৃত্ব দিয়েছেন। একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৭’তে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘আসমত আলীর অনশন’ প্রকাশিত হয়। তার বহু গবেষণা প্রবন্ধ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।
বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশের আত্মপ্রকাশ হলো। স্বাধীনতার দাপুটে হাওয়া চারপাশে যেমন বহমান তেমনি প্রাণের উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বাসিত প্রতিটি মানুষ। তবে ঐ উচ্ছ্বাসে নেই হৃদয়ের কোমলতার পরশ। পাখপাখালির ডাকেও বিরহের সুর, অপূর্ণতা যেন ভর করেছে সদ্য স্বাধীন হওয়া গোটা দেশের উপর। দীর্ঘ সংগ্রাম, দীর্ঘ লড়াই, অগণিত আত্মহুতি, বিশাল অশ্রু ও রক্তের ধারার পথ বেয়েই এ স্বাধীনতা। কিন্তু কাঙ্খিত স্বাধীনতাও নেই আলোক রশ্মির বিচ্ছুরণ!
একি স্বাধীনতার প্রায় এক মাস পর কেন সবাই ছুটছেন রাজধানীর তেঁজগাও বিমানবন্দরে, আবার লাখ জনতার স্রোত বইছে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। আজই যেন স্বাধীনতার বান ছুটেছে। রাজধানীর প্রতিটি রাজপথ সরগরম হয়েছে। ছুটছেন সবাই। কিন্তু কেন?
আজ আসছেন মহান নেতা, আসছেন স্বাধীনতার পিতা, জাতির পিতা। ভালোবাসার চূড়ান্ত মানুষ, একটাই নাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দিনটি ছিল সোমবার। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। দেশটির নাম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।
সে দিন বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু আগমন উপলক্ষে নিজেদের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে শ্রেষ্ঠ আয়োজন করেছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলেও বঙ্গবন্ধু তখনো বন্দি ছিলেন পাকিস্তানি হায়েনাদের কারাগারে। দেশ-বিদেশে তখনও চলছিল বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু আদৌ বেঁচে আছেন কিনা কিংবা পাকিস্তান তাঁকে ফিরিয়ে দেবে কিনা- সেসব নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মাহুতি ও চার লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনার্ত ইতিহাস- সবকিছু অসম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি, শনিবার, বিলেতের শীতের সকাল, বাইরে বৃষ্টি, কিন্তু ব্রিটেন প্রবাসী হাজার হাজার বাংলাদেশি কিছুই তোয়াক্কা করছেন না। ছুটে চলছেন, গন্তব্য সেন্ট্রাল লন্ডনের ক্ল্যারেজ হোটেল। শুধুমাত্র লন্ডন নয় বার্মিংহ্যাম, ম্যানচেস্টার থেকেও লোকজন ছুটে আসছিলেন।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি সেন্ট্রাল লন্ডনের ক্ল্যারেজ হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন বঙ্গবন্ধু- সংগৃহীত
বৃষ্টির পানি আর চোখের পানি সেদিন একাকার হয়ে গিয়েছিল। বেদনার অশ্রু নয় সেই চোখের অশ্রু ছিল আনন্দের আর বিজয়ের। কণ্ঠে জয়বাংলা। কারণ, বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছেন, জাতির জনক ফিরে এসেছেন।
আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ একটি গণমাধ্যমে লেখেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অক্টোবর মাসে জাতির জনকের ফাঁসির আদেশ হয়। কিন্তু ষোলোই ডিসেম্বর আমরা বিজয়ী হলে, ইয়াহিয়া খান সেই আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। পাকিস্তানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর, ইয়াহিয়া খানকে অপসারণ করে ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে আবেদন করেছিল, “আমার একটি স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে, সেটি হলো শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো, আমাকে সেই সুযোগ দেওয়া হোক।” যে কারণে ভুট্টো মিয়ানওয়ালী কারাগারের জেল সুপার হাবীব আলী-র কাছে বার্তা পাঠায় এবং বঙ্গবন্ধুকে মিয়ানওয়ালী কারাগার থেকে চশমা ব্যারাজের হাবীব আলী-র বাসভবনে নিয়ে রাখা হয়। এরপর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুনয়-বিনয় করে পাকিস্তানের সাথে একটি সম্পর্ক রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করে। বঙ্গবন্ধু ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
ভুট্টো ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধু লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে পৌঁছান। পরদিন অর্থাৎ ৯ জানুয়ারি লন্ডনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু একটি বিবৃতি দেন। ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বাংলার মুক্তি সংগ্রামে স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য অনুরোধ জানাবে।”
পরিশেষে তিনি বলেন, “আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’’ বিবৃতির শেষে সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যে আপনার বাংলাদেশে ফিরে যাবেন সেই দেশ তো এখন ধ্বংসস্তূপ?’ তখন জাতির জনক উত্তর দিয়েছিলেন, আমার বাংলার মানুষ যদি থাকে, বাংলার মাটি যদি থাকে, একদিন এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবো।”
১০ জানুয়ারি যেদিন তিনি ফিরে এলেন সেদিনটি ছিল সোমবার। সকাল থেকেই লক্ষ লক্ষ মানুষ ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে দশদিক মুখরিত করে মিছিল নিয়ে বিমান বন্দর অভিমুখে। রণক্লান্ত যুদ্ধজয়ী মুক্তিযোদ্ধা, শ্রদ্ধাবনতচিত্তে সংগ্রামী জনতা, অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে সন্তানহারা জননী, স্বামীহারা পত্নী, পিতৃহারা পুত্র-কন্যা সব দুঃখকে জয় করে স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথা ভুলে গর্বোদ্ধত মস্তকে সকলেই অধীর আগ্রহে আজ অপেক্ষমান দু’হাত বাড়িয়ে জাতির জনককে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করার জন্য।
ঢাকায় যখন সাজ সাজ রব, তখন সকাল হতেই দিল্লীর রাজপথ ধরে হাজার হাজার মানুষের মিছিল পালাম বিমানবন্দর ও প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। দিল্লীর জনসাধারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে এক অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট জেটটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবতরণ করলে তাঁর সম্মানে একুশবার তোপধ্বনি করা হয়। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পর পূর্বেই উপস্থিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ তাঁকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন।
দিল্লিতে রাষ্ট্রীয় সম্বর্ধনার পর এক মঞ্চে ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু, ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২- সংগৃহীত
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, “আপনার জন্য আমি গর্বিত। ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ আপনার জন্য গর্ব অনুভব করে। শেখ মুজিবকে আমাদের মাঝে পেয়ে ভারতের জনগণ আজ আনন্দে আত্মহারা। শেখ মুজিব তাঁর জনগণকে নূতন জীবন দান করেছেন। তার স্বাধীনতার স্বপ্ন আজ সার্থক।”
দিল্লীতে সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতিকালে লক্ষ মানুষের সমাবেশে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ভারতবাসীর উদ্দেশে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেন, “আমার জন্য এটা পরম সন্তোষের মুহূর্ত। বাংলাদেশে যাবার পথে আমি আপনাদের মহতী দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কারণে যে, আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী-যিনি কেবল মানুষের নন, মানবতারও নেতা। তাঁর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার ন্যূনতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারবো। এ অভিযাত্রা সমাপ্ত করতে আপনারা সবাই নিরলস পরিশ্রম করেছেন এবং বীরোচিত ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দীদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায়। অবশেষে আমি নয় মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি।”
অভ্যর্থনার আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় বঙ্গবন্ধু একান্তে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলেন, “ম্যাডাম প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আমি ঋণী। আপনি আমার বাংলার মানুষকে অস্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছেন; আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দিনগুলিতে আপনি পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আপনার কাছে আমরা চিরঋণী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার নিকট আমার একটি অনুরোধ। আপনি কবে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করবেন?”
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী মহানুভবতার স্বরে বলেছিলেন, “আপনি যেদিন চাইবেন।” বঙ্গবন্ধু এমন বিচক্ষণ নেতা ছিলেন যে, এরকম একটি অবস্থার মধ্যেও রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যার্পণের বিষয়টি আলাপ করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি আদায় করে নেন।
দিল্লী থেকে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট বিমানটি ঢাকার আকাশ সীমায় দেখা দিতেই জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। দুপুর ১টা ৫১ মিনিটে ঢাকা বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। বিমানে সিঁড়ি স্থাপনের সাথে সাথে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য নেতারা, মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, কেন্দ্রীয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা অভ্যর্থনা জানান।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকা বিমানবন্দরে বিমানের সিঁড়ি থেকে হাত নাড়ছেন বঙ্গবন্ধু- সংগৃহীত
জাতির জনককে মাল্যভূষিত করার সাথে সাথেই তার সংযমের সকল বাঁধ ভেঙে যায়, তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। সে এক অবিস্মরণীয় ক্ষণ, অভূতপূর্ব মুহূর্ত। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন। তার চোখে তখন স্বজন হারানোর বেদনা-ভারাক্রান্ত অশ্রুর নদী, আর জ্যোতির্ময় দ্যুতি ছড়ানো মুখাবয়ব জুড়ে বিজয়ী বীরের পরিতৃপ্তির হাসি। বিমানের সিঁড়ি বেয়ে জাতির জনক তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সাথে সাথে একত্রিশবার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়।
এরপর বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। চারদিক থেকে তার উপর পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে। বাংলাদেশ সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী রাষ্ট্রপ্রধানকে গার্ড অব অনার দেয়। মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ করেন। এসময় বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণী ওসমানী, লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ্ এবং বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র লেফটেন্যান্ট শেখ কামাল জাতির জনকের পাশে ছিলেন। গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতারা, ঢাকাস্থ বিদেশি মিশনের সদস্যরা, মিত্র বাহিনীর পদস্থ সামরিক অফিসার, বাংলাদেশ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে করমর্দন করেন।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ভালোবাসায় সিক্ত বঙ্গবন্ধু, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, ঢাকা- সংগৃহীত
এরপর রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যাওয়ার জন্য জাতীয় নেতাদেরসহ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অপেক্ষমান ট্রাকে উঠে রওয়ানা দেই। সুদৃশ্য তোরণ, বাংলাদেশের পতাকা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দিয়ে সজ্জিত রাজপথের দুই পাশে দাঁড়ানো জনসমুদ্র পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দুই ঘণ্টা তেরো মিনিট পর ময়দানে পৌঁছাই। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকাল সাড়ে চারটা। চারদিকে লক্ষ লক্ষ অপেক্ষমান জনতা, কোনদিকে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মুহূর্মুহূ করতালিতে চারদিক মুখরিত।’
‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ রণধ্বনিতে সবকিছু যেন ডুবে গেল। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠে চতুর্দিকে তাকালেন এবং রুমালে মুখ মুছলেন। বঙ্গবন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে কেবলই মনে হয়েছে, জাতির জনক জীবনভর এমন একটি দিনের অপেক্ষায়ই ছিলেন। দীর্ঘ কারাবাসের ক্লান্তিতে মলিন মুখটি তবু সমুজ্জ্বল। উন্নত ললাট, প্রশান্ত বদন, দু চোখ তখনও অশ্রুসিক্ত, কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। সে অবস্থায়ই চিরাচরিত ভঙ্গিতে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশে নিবেদন করলেন তার ঐতিহাসিক বক্তৃতা।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটের সূত্রে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যটি তুলে ধরা হলো, ‘আমি প্রথমে স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবি জনগণকে, হিন্দু মুসলমানকে যাদের হত্যা করা হয়েছে আমি তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করি।
আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারবো না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম, ফাঁসি কাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে দাবায় রাখতে পারবে না। আমি আমার সেই যেই ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি খোলা জীপে ঢাকার রাজপথে বঙ্গবন্ধু- সংগৃহীত
আজ প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলা হয়ে হয়েছে ২য় বিশ্ব যুদ্ধে ১ম বিশ্ব যুদ্ধেও এত মানুষ এত সাধারণ জনগণকে মৃত্যু বরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই যা আমার ৭ কোটির বাংলায় করা হয়েছে। আমি জানতাম না আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসবো আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও কোন আপত্তি নাই, মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙ্গালির কাছে দিয়ে দিও এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।
আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে, আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের জনগণকে আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের সামরিক বাহিনীকে,আমি মোবারকবাদ জানাই রাশিয়াকে, আমি মোবারকবাদ জানাই জার্মানি, ব্রিটিশ, ফ্রান্স সব জায়গার জনগণকে তাদের আমি মোবারকবাদ জানাই যারা আমাকে সমর্থন করেছে।
আমি মোবারকবাদ জানাই আমেরিকার জনসাধারণকে, মোবারকবাদ জানাই সারা বিশ্বের মজলুম জনগণকে যারা আমার এই মুক্ত সংগ্রামকে সাহায্য করেছে। আমার বলতে হয় ১ কোটি লোক এই বাংলাদেশ থেকে ঘর বাড়ি ছেড়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতের জনসাধারণ মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাদের আশ্রয় দিয়েছেন তাদের আমি মোবারকবাদ না দিয়ে পারি না। যারা অন্যরা সাহায্য করেছেন তাদের কেউ মোবারকবাদ দিতে হয়।
তবে মনে রাখা উচিত বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি যাবার আগে বলেছিলাম ও বাঙালি এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে সংগ্রাম করছো, আমি আমার সহকর্মীদের মোবারক বাদ জানাই। আমার বহু ভাই বহু কর্মী আমার বহু মা-বোন আজ দুনিয়ায় নাই তাদের আমি দেখবো না।
ঢাকার বাসায় রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২- সংগৃহীত
আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি বোধহয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।
আমি আশা করি দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন আমার রাস্তা নাই আমার ঘাট নাই আমার খাবার নাই আমার জনগণ গৃহহারা সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারী। তোমরা আমার মানুষ কে সাহায্য করো মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সকল রাষ্ট্র এর কাছে আমি সাহায্য চাই। তোমরা আমার বাংলাদেশকে তোমরা রিকোগনাইজ করো। জাতিসংঘের ত্রাণ দাও দিতে হবে, উপায় নাই দিতে হবে। আমি আমরা হার মানবো না আমরা হার মানতে জানি না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-
‘সাত কোটি বাঙ্গালির হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করো নাই’
কবিগুরু আজ মিথ্যা কথা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি আমায় দাবায় রাখতে পারবা না।
আজ থেকে আমার অনুরোধ আজ থেকে আমার আদেশ আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ তোমাদের মোবারকবাদ জানাই তোমরা গেরিলা হয়েছো তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।
একটা কথা আজ থেকে বাংলায় যেন আর চুরি ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়। বাংলায় যারা অন্য লোক আছে অন্য দেশের লোক, পশ্চিম পাকিস্তানের লোক বাংলায় কথা বলে না তাদের বলছি তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। আর আমি আমার ভাইদের বলছি তাদের উপর হাত তুলো না আমরা মানুষ ,মানুষ ভালোবাসি।
তবে যারা দালালি করছে যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করছে তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। তাদের বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন, একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশে স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আমি দেখিয়ে দিতে চাই দুনিয়ার কাছে শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।
আমায় আপনারা পেয়েছেন আমি আসছি। জানতাম না আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোড়া হয়েছিলো। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, বলেছিলাম আমি বাঙালি আমি মানুষ, আমি মুসলমান একবার মরে ২ বার মরে না। আমি বলেছিলাম আমার মৃত্যু আসে যদি আমি হাসতে হাসতে যাবো আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাবো না তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না।
এবং যাবার সময় বলে যাবো জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙ্গালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।
ভাইয়েরা আমার যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে আমার সকল জনগণকে দরকার যেখানে রাস্তা ভেঙে গিয়েছে নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দাও। আমি চাই জমিতে যাও ধান বুনো, কর্মচারীদের বলি একজন ও ঘুষ খাবেন না। মনে রাখবেন তখন সুযোগ ছিলো না,আমি অপরাধ ক্ষমা করবো না।
ভাইয়েরা আমার যাওয়ার সময় আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তাজউদ্দীন, নজরুলেরা আমাকে ছেড়ে যায়, আমি বলেছিলাম ৭ কোটি বাঙালির সাথে মরতে আমার ডেকো না। আমি আশীর্বাদ করছি ওরা কাঁদছিল আমি বলি তোরা চলে যা আমার আস্থা রইলো আমি এই বাড়িতে মরতে চাই। এটাই হবে বাংলায় জায়গা এখানেই আমি মরতে চাই ওদের কাছে মাথানত করে আমি পারবো না।
ড. কামালকে নিয়ে ৩ মাস জেরা করছে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দাও কয়েকজন বাঙালি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে তাদের আমরা জানি চিনি এবং তাদের বিচার ও হবে। আপনারা বুঝতে পারেন-
‘নম নম নম সুন্দরী মম জননী জন্মভুমি গঙ্গার তীর সিন্ধ সুমীর জীবনও জুড়ালে তুমি’
আজ আমি যখন এখানে নামছি আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষ কে আমি এত ভালোবাসি, যে জাত কে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কিনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।
পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের বলি তোমরা সুখে থাকো। তোমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা যা করেছে আমার মা বোনদের রেপ করেছে, আমার ৩০ লক্ষ লোককে মেরে ফেলে দিয়েছে, যাও সুখে থাকো। তোমাদের সাথে আর না শেষ হয়ে গেছে তোমরা স্বাধীন থাকো, আমিও স্বাধীন থাকি।
তোমাদের সাথে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বন্ধু হতে পারে তাছাড়া বন্ধু হতে পারে না। তবে যারা অন্যায়ভাবে অন্যায় করেছে তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হবে। আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চাই আমি আরেকদিন বক্তৃতা করবো একটু সুস্থ হয়ে লই। আপনারা চেয়ে দেখেন আমি সেই মুজিবর রহমান আর নাই। আমার বাংলার দিকে চেয়ে দেখেন সমান হয়ে গেছে জায়গা, গ্রাম এর পর গ্রাম পুড়ে গেছে এমন কোন পরিবার নাই যার মধ্যে আমার লোককে হত্যা করা হয় নাই।
কতবড় কাপুরুষ যে নিরপরাধ লোককে এভাবে হত্যা করে এভাবে সামরিক বাহিনীর লোকেরা, আর তারা বলে কি আমরা পাকিস্তানের মুসলমান সামরিক বাহিনী ঘৃণা করা উচিত। দুনিয়ার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পরে বাংলাদেশই ২য় মুসলিম দেশ, ভারত ৩য়, পাকিস্তান ৪র্থ।
আমরা মুসলমান, মুসলমান মা বোনদের রেপ করে। আমার রাষ্ট্রে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র এই বাংলাদেশে হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। যারা জানতে চান আমি বলে দিবার চাই আসার সময় দিল্লিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথা হয়েছে আমি আপনাদের বলতে পারি তাকে জানি আমি তাকে আমি শ্রদ্ধা করি সে পন্ডিত নেহেরুর কন্যা সে মতিলাল নেহেরুর ছেলের মেয়ে। তারা রাজনীতি করেছে ত্যাগ করেছে তারা আজকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে যেদিন আমি বলবো সেদিন ভারতের সৈন্য বাংলার মাটি ছেড়ে চলে যাবে এবং তিনি আস্তে আস্তে কিছু সরিয়ে নিচ্ছেন।
যে সাহায্য তিনি করেছেন আমি আমার ৭ কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে তাকে, তার সরকার কে ভারতের জনগণকে শ্রদ্ধা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে মোবারকবাদ জানাই।
ব্যক্তিগতভাবে এমন কোন রাষ্ট্র প্রধান নাই যার কাছে তিনি আপিল করেন নাই শেখ মুজিব কে ছেড়ে দিতে। তিনি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রে কাছে বলেছেন তোমরা ইয়াইয়া খান কে বল শেখ মুজিব কে ছেড়ে দিতে একটা রাজনৈতিক সমাধান করতে। ১কোটি লোক নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য দেশে চলে গেছে? এমন অনেক দেশ আছে যেখানে লোক সংখ্যা ১০ লাখ, ১৫ লাখ, ২০ লাখ, ৩০ লাখ, ৪০ লাখ, ৫০ লাখ। শতকরা ৬০ ভাগ দেশে লোকসংখ্যা ১ কোটির কম আর আমার বাংলা থেকে ১ কোটি লোক মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে ভারতে স্থান নিয়েছিলো কত অসুস্থ হয়ে মারা গেছে, কত না খেয়ে কষ্ট পেয়েছে, কত ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এই পাষাণদের দল।
ক্ষমা করো আমার ভাইয়েরা ক্ষমা করো আজ আমার কারো বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা নাই একটা মানুষকে তোমরা কিছু বলো না অন্যায় যে করেছে তাকে সাজা দিবো আইন নিজের হাতে তুলে নিও না। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তোমরা আমার সালাম গ্রহন করো, ছাত্রসমাজ তোমরা আমার সালাম গ্রহন করো, শ্রমিকসমাজ তোমরা আমার সালাম গ্রহন করো, বাংলার হতভাগ্য হিন্দু-মুসলমান আমার সালাম গ্রহন করো।
আর আমার কর্মচারী পুলিশ, ইপিআর যাদের উপর মেশিনগান চালিয়ে দেয়া হয়েছে, যারা মা বোন ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছে তার স্ত্রীদের ধরে কুর্মিটোলা নিয়ে যাওয়া হয়েছে তোমাদের আমি সালাম জানাই, তোমাদেরকে আমি শ্রদ্ধা জানাই।
নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা,বাংলার মানুষ হাসবে বাংলার মানুষ খেলবে বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে এই আমার সাধনা এই আমার জীবনের কাম্য আমি যেন এই কথা চিন্তা করেই মরতে পারি এই আশীর্বাদ এই দোয়া আপনার আমাকে করবেন। এই কথা বলে আপনাদের কাছে থেকে বিদায় নিবার চাই। আমার সহকর্মী দের আমি ধন্যবাদ জানাই যাদের আমি যে কথা বলে গিয়েছিলাম তারা সকলে একজন একজন করে প্রমাণ করে দিয়ে গেছে মুজিব ভাই বলে গিয়েছে তোমরা সংগ্রাম করো, তোমরা স্বাধীন করো, তোমরা জান দাও বাংলার মানুষ কে মুক্ত করো।
আমার কথা চিন্তা করো না আমি চললাম যদি ফিরে আসি আমি জানি আমি ফিরে আসতে পারবো না আজ আল্লাহ আছে তাইআজ আমি আপনাদের কাছে ফিরে এসেছি। তোমাদের আমি মোবারকবাদ জানাই আমি জানি কি কষ্ট তোমরা করছো। আমি কারাগারে ছিলাম ৯ মাস আমাকে কাগজ দেয়া হয় নাই। এ কথা সত্য আসার সময় ভুট্টো আমায় বললেন শেখ সাব দেখেন ২ অংশের কোন একটা বাঁধন রাখা যায় নাকি আমি বললাম আমি বলতে পারি না আমি বলতে পারবো না আমি কোথায় আছি বলেত পারি না আমি বাংলায় গিয়ে বলবো আজ বলছি ভুট্টো সাহেব সুখে থাকো বাঁধন ছিঁড়ে গেছে আর না। তুমি যদি কোন বিশেষ শক্তির সাথে গোপন করে আমার বাংলার স্বাধীনতা হরণ করতে চাও মনে রেখ দলের নেতৃত্ব দিবে শেখ মুজিবুর রহমান মরে যাব স্বাধীনতা হারাতে দিবো না।
১৯৭২ সালে ৮ জানুয়ারি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- সংগৃহীত
ভাইয়েরা আমার, আমার ৪ লক্ষ বাঙালি আছে পাকিস্তানে আমি অনুরোধ করবো তবে একটা জিনিস আমি বলতে চাই ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে জাতিসংঘের মাধ্যমে অথবা ওয়ার্ল্ড জুরির পক্ষ থেকে ১টা ইনকোয়ারি হতে হবে কি পাশবিক অত্যাচার কিভাবে হত্যা করা হয়েছে আমার লোকেদের এ সত্য দুনিয়ার মানুষকে জানতে হবে। আমি দাবী করবো বাংলাদেশ জাতিসংঘ কে বাংলাদেশ কে আসন দাও এবং ইনকোয়ারি করো। ভাইয়েরা আমার যদি কেউ চেষ্টা করেন ভুল করবেন আমি জানি ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই সাবধান বাঙালিরা ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই।
একদিন বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলো,একদিন বলেছিলাম যার যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধ করো,বলেছিলাম এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এ জায়গায় ৭ মার্চ। আজ বলছি তোমরা ঠিক থাকো একতাবদ্ধ থাকো,কারো কথা শুনো না।
ইনশাল্লাহ স্বাধীন যখন হয়েছি স্বাধীন থাকবো একজন মানুষ এই বাংলাদেশে বেঁচে থাকতে এই সংগ্রাম চলবে। আজ আমি আর বক্তৃতা করতে পারছি না একটু সুস্থ হলে আবার বক্তৃতা করবো। আপনারা আমাকে মাফ করে দেন আপনারা আমাকে দোয়া করেন আপনারা আমার সাথে সকলে একটা মুনাজাত করেন।’’
লাখ লাখ মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো ইতিহাসের মহামানব জাতির জনকের বক্তৃতা শুনেছেন এবং পরম পরিতৃপ্ত হয়েছে এই ভেবে যে, আজ থেকে আমরা প্রকৃতই স্বাধীন। সভামঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ধানমণ্ডির ১৮ নং বাড়িতে গেলেন। যেখানে পরিবারের সদস্যবৃন্দ অবস্থান করছিলেন। সেই বাড়ির সামনে আর একটি বাড়ি তখন তার জন্য রাখা হয়েছিল। কেননা ধানমণ্ডি ৩২ নং বাসভবনটি শত্রুবাহিনী এমনভাবে তছনছ করে দিয়েছিল যা বসবাসের অনুপযুক্ত ছিল। প্রিয় সহকর্মীদের সাথে ১১ জানুয়ারি বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন এবং আবু সাইদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করলেন। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। যে ভাষণের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্ভবপর হয়েছে। এখন ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিশ্বসভায় স্বীকৃত। আব্রাহাম লিঙ্কনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’ তিন মিনিটের লিখিত বক্তৃতা; মার্টিন লুথার কিংয়ের ১৭ মিনিটের লিখিত বক্তৃতা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হৃদয়ের গভীরতা থেকে সেদিন ‘ভাইয়েরা আমার’ সম্বোধন করে যে অলিখিত বক্তৃতা করেছিলেন, সেটা বিশ্ববিখ্যাত বক্তৃতা।
এবার এক নতুন প্রেক্ষাপটে ১০ জানুয়ারি হাজির হয়েছিল। এ বছরটি জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার বছরটিকে ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে দেশে এবং জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো বিশ্বজুড়ে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে।
এমএস/