ঢাকা, বুধবার   ২০ নভেম্বর ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের লোকায়তিক মাত্রা

মফিদুল হক

প্রকাশিত : ১৬:০৭, ২৭ আগস্ট ২০১৯

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বিকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন রেসকোর্স ময়দানের বিশালে সমাবেশের মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন, তখন জাতীয় জীবনে টানটান উত্তেজনার গবীরতম যে সঙ্কটের পটভূমিতে তার অবস্থান সেটা নানা সময়ে নানাভাবে আলোচিত হয়েছে।

সাড়ে সাত কোটি মানুষকে জাতীয় চেতনায় উদ্বেলিত ও ঐক্যবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের এমন এক সন্ধিক্ষণে তিনি নিয়ে এসেছিলেন, যেখানে বর্বর সামরিক শক্তির মুখোমুখি হয়ে আগামীর পথে অগ্রসর হওয়ার শক্তি ও সম্ভাবনা সম্পূর্ণই নির্ভর করছিল তার ওপর। একদিকে ছিল স্বাধীনতার জন্য অধীর বিপুল শক্তিধর বিশাল জনতা, বাংলার মানুষকে যে শক্তির যোগান তিনিই দিয়েছিলেন। আরেক দিকে ছিল অস্ত্রের আঘাতে গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চিরতরে নস্যাৎ করতে উদ্যত পাক সামরিক চক্র, সামান্য ভ্রান্তি কিংবা শৈথিল্যের দেখা পেলে হিংস্র পশুর মতো যারা ঝাঁপিয়ে পড়বে এদেশের মানুষের ওপর। 

আমরা জানি বঙ্গবন্ধু সেই ঐতিহাসিক দায় কী ভাবে মোচন করেছিলেন এবং অবিস্মরণীয় এক ভাষণের মধ্য দিয়ে কীভাবে মুক্তিপথে এমন সংহত করে দাঁড় করিয়ে দিলেন বাংলার মানুষকে, যার ফলে সামনের দিনগুলোতে যা-ই ঘটুক না কেন, অনন্য দৃঢ়তায় ঐক্যবদ্ধ জাতি তা মোকাবিলায় হয়ে উঠেছিল ক্ষমতাবান। এই ভাষণের তাৎপর্য বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, বহুভাবে গুণীজন সেই ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, তারপরও এর ঐতিহাসিকতা আরো নানা কোণ থেকে পর্যালোচনা করা সম্ভব।

ধর্মকে হীনস্বার্থে ব্যবহার করে যে তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্র তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে জাতীয়তাবোধে বাঙালি জনসমষ্টিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন তিনি। জনতাকে সঙ্গে নিয়ে গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত হয়েছিল তাঁর সংগ্রাম।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ প্রদানের জন্য তিনি যখন সভামঞ্চে এসে দাঁড়ালেন তখন শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে বড় হয়েছিল আশু সঙ্কটময়তা, গণতান্ত্রিক রায় পদদলনকারী পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর কবল থেকে মুক্তির জন্য কী হবে চূড়ান্ত পদক্ষেপ তা জানতে সবাই ছিলেন উদগ্রীব। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ছত্রে ছত্রে সেই জাতীয় কর্তব্যের রূপরেখা মেলে ধরা হয়েছিল। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় মুক্তির গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ভবিষ্যৎমুখী আন্তর্জাতিক মাত্রা ও গ্রহণযোগ্যতা জুগিয়েছিলেন উচ্চকণ্ঠে সংগ্রামের গণতান্ত্রিক অধিকার ও দাবি উত্থাপন করে। তিনি কথা বলেছিলেন কেবল বাংলার প্রতিনিধি হয়ে নয়, পাকিস্তানের ইতিহাসের ২৩ বছরে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দলের নেতা হিসেবে।

তিনি বলেছিলেন, ‘আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে (ইয়াহিয়া খানকে) অনুরোধ করলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না’।

আরেকবার তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে’। গণতন্ত্র ও শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের প্রত্যয় ব্যক্ত করেই বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন সম্ভাব্য সশস্ত্র আঘাত মোকাবিলায় উপযুক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার। অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে তার এমনি ঘোষণায়, যার ফলে বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রাম স্নায়ুযুদ্ধপীড়িত বিশ্বে কোনো এক পক্ষের সংগ্রাম না হয়ে অর্জন করে সর্বজনীন সমর্থন, যে সমর্থনের বীজ নিহিত ছিল ৭ মার্চের ভাষণে। তৎকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে এমনি সমর্থন সরকারিভাবে প্রদানের কোন সুযোগ ছিল না, কিন্তু দেশে দেশে মুক্তিকামী মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে ছিল সোচ্চার, আর এর প্রভাব পড়েছিল অনেক দেশের সরকারের ওপর।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের লোকায়তিক দিক আমরা বিবেচনায় নিতে চাই। আমরা এটাও স্মরণ করি, আন্তর্জাতিক ও লোকায়তিক এই দুইয়ের সমন্বিত বিচারের মধ্য দিয়ে এ ভাষণের গভীরতা ও ব্যাপ্তির পরিচয় আমরা পেতে পারি। লোকজীবন সঞ্জাত যে দর্শন ও শিল্প প্রকাশের পরিচয় আমরা পাই, তাকে আধুনিক ফোকলোর চর্চায় লোকায়তিক অভিধায় চিহ্নিত করা হয়। রূপগতভাবে এর রয়েছে প্রকৃত চরিত্র, প্রকৃতি ও সমাজের সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবে সংলগ্ন থেকে লোকায়তিক এসব প্রকাশ কোনো জড়বৎ ধারণা নয়, আধুনিক জীবনজিজ্ঞাসার মোকাবিলায় নিশ্চিতভাবে সক্রিয় ও সক্ষম, কিন্তু সেই রূপসনাতনকে চিহ্নিত করতে অনেক সময় আমরা ব্যর্থ হই। তার একটি বড় কারণ দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে শিক্ষিত নাগরিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রোথিত সমাজ-বিচ্ছিন্নতা, বিশেষভাবে যেসব প্রপঞ্চ ব্যবহার করে তারা সমাজ, রাজনীতি ও শিল্প বিশ্লেষণের চেষ্টা নেন, অনেক ক্ষেত্রে তা আরো বেশি করে তাদের সমাজ-বিযুক্ত করে ফেলে। এই সঙ্কট জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেও প্রভাব ফেলে। দেখা গেছে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম যুগের প্রবক্তারা অনেকেই শিক্ষাগ্রহণ করেছেন পশ্চিমা দুনিয়ায়, রপ্ত করেছেন ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর ভাষা ও জীবনরীতি, পরে হতাশ ও পীড়িত হয়েছেন বাস্তবের রূঢ়ভাবে। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও দর্শনে প্রতিফলিত স্বাধীনতা ও মানবতার বাণী এবং ঔপনিবেশিক শাসনের নিষ্ঠুর বাস্তবতার দ্বন্দ্বে তারা ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন।

৭ মার্চের ভাষণে প্রতিরোধ আন্দোলনের এই লোকায়ত রূপ মেলে ধরার পাশাপাশি প্রত্যাঘাতের ডাক এমন এক লোকভাষায় ব্যক্ত করলেন বঙ্গবন্ধু যে তিনি উন্নীত হলেন অনন্য লোকনায়কের ভূমিকায়, যার তুলনীয় নেতৃত্ব জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের কাফেলায় বিশেষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বাংলার লোকঐতিহ্য ও জীবনধারার গবীর থেকে উঠে আসা ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃত্ব ভূমিকায়। জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তিনি যে কতটা সার্থকনামা হয়ে উঠেছিলেন, তার পরিস্ফুটন ঘটেছিল সঙ্কটময় মার্চ মাসে তার অবস্থান ও ভূমিকা এবং ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্যে। তিনি বক্তব্যে যেমন গভীরভাবে জাতীয়তাবাদী, তেমনি আন্দোলনের স্বাদেশিক রীতির নবরূপায়ণ এবং প্রসার ঘটালেন সার্বিক ও সক্রিয় অসহযোগের ডাক দিয়ে, যে অসহযোগে শামিল ছিল ব্যাপক জনতা এবং সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। অসহযোগ আন্দোলন ও ৭ই মার্চের ভাষণের আবেদন উপচে পড়েছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোতে সামরিক আধা-সামরিক প্রতিষ্ঠান কর্মরত সব বাঙালি সদস্যের ওপর এবং এর প্রতিফল জাতি লাভ করল মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকেই। বক্তৃতার রূপ হিসেবেও প্রচলিত রাজনৈতিক ভাষণের কাঠামো সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে বঙ্গবন্ধু এমন এক সৃজনশীলতার পরিচয় দিলেন, যা দেশের মাটির গভীরে শেকড় জড়িত করা ও গণসংগ্রামের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া অনন্য নেতার পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল।

তিনি বক্তৃতা শুরু করেছিলেন ‘ভাইয়েরা আমার’ সম্বোধন দিয়ে, সব রকম পোশাকি রীতি ও আড়ম্বর বর্জন করে লাখো মানুষের মুখোমুখি হয়ে এমন অন্তরঙ্গ, প্রায় ব্যক্তিগত সম্বোধন যে সম্ভব, তা কে কখন ভাবতে পেরেছিল! ভাষণের প্রথম বাক্যটিও একান্ত ব্যক্তিগত ভঙ্গিতে বলা যায়, যেন ঘনিষ্ঠজনের কাছে মনের নিবিড়তম অনুভূতির প্রকাশ, ‘আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি’। এরপর তিনি যখন বাংলার মানুষের আত্মদানের কথা বললেন, তাদের মুক্তি-আকুতির প্রকাশ ঘটালেন, তখন সেই অন্তরঙ্গ ভঙ্গি রূপ পেল জনসভার ভাষণের; কিন্তু তারপরও হারালো না বিষয়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পৃক্তি। তিনি বললেন, ‘আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়’।

এ অনন্য সূচনা বেঁধে দিয়েছিল বক্তৃতার সুর, তিনি সত্যোচ্চারণ করলেন অন্তরের সবটুকু আকুতি ঢেলে এবং নিবিড় ভালবাসার বন্ধনে শ্রোতৃমণ্ডলীকে, যেন তার রক্ত সম্পর্কের ভ্রাতৃপ্রতিম সবাইকে একাত্ম করে তুললেন। গভীর প্রেমভাব উৎসারিত এই একাত্মতা নেতা ও জনতার মধ্যে আর কোনো ফারাক রাখল না। দেখা গেল ভাষণে যখনই বলেছেন মানুষের কথা সেখানে আর কোনো নৈর্ব্যক্তিকতার অবকাশ থাকেনি, এই মানুষেরা যে তারই মানুষ, একান্ত আপনজন। বুকভরা ভালবাসা ও বেদনা নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘৭ই জুনে আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে’। ‘আমার পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার দেশের গরীব, দুঃখী, আর্তমানুষের মধ্যে, তাদের বুকের ওপর হচ্ছে গুলি’। ‘কার সঙ্গে বসব, যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসব’?

‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে’। ‘আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়’,- এভাবে বার বার তিনি উচ্চারণ করেছেন আমার মানুষ, আমার দেশের গরিব-দুঃখী, আমার লোক। এসব উচ্চারণ উৎসারিত হয়েছে মানুষের সঙ্গে নিবিড় একাত্মতার মধ্য দিয়ে এবং প্রায় তিন দশকের দীর্ঘ ও কঠিন গণসংগ্রামের পথ বেয়ে বঙ্গবন্ধু অর্জন করেছিলেন গণমানুষের সঙ্গে এই বিশেষ সম্পৃক্ততা।
নিবিড় প্রেমভাব থেকে স্রষ্টা অথবা দেশমাতার সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রকাশ ঘটাতে বাংলার লোকমানসে সম্বোধনের পরিবর্তনময়তা আমরা লক্ষ্য করি, স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা নিবেদনে লোকসমাজে যেমন আপনি, তুমি বা তুই ব্যবহৃত হয় অনুভূতির স্তর অথবা তীব্রতর প্রকাশ হিসেবে, তেমনি বঙ্গবন্ধুও ভাষণের উচ্চকিত মুহূর্তে আপনি থেকে অনায়াসে চলে গেছেন তুমি বা তোমরা সম্বোধনে।

বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’, যা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রিয় এক গান এবং ১৯৫৪ সালে সাহিত্য সম্মেলনে সনজীদা খাতুনকে যে গান গাওয়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলেন, সেখানেও আমরা দেখি গানের কথায় সম্বোধনসূচক সর্বনামে এমনি পরিবর্তন ঘটে যাওয়া। স্বদেশকে তুমি সম্বোধন করে যে ভালবাসার কথা বলা হয়েছে তা একপর্যায়ে হয়ে ওঠে তুই। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ওমা, আমার যে ভাই তারা তারা সবাই, তোমার রাখাল, তোমার চাষী/ওমা তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে’। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করতে হয় এখানে কেবল সম্বোধনের পরিবর্তনময়তা নয়, বক্তব্য বিচারেও ৭ই মার্চের ভাষণের অনুরণন যেন খুঁজে পাওয়া যায়।

বক্তৃতার একেবারে শেষে, বাংলার লোকায়ত ইসলামে সুফিবাদের প্রভাবে যে উপাসনা পদ্ধতি বিশেষ স্থান পেয়েছে, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মিলনে যে ফানা বা পরম উপলব্ধি সঞ্চারিত হয়, যে নিবিড় সম্পৃক্তি-আকাঙ্ক্ষা লৌকিক ধর্মে আরো নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে, তেমনিভাবে নেতা ও জনতা একীভূত হয়ে পড়েন বক্তৃতাকালে, উপলব্ধির নিবিড়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝি অন্তরের কোষে কোষে, রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে অনুভব করেছিলেন নেতা ও জনতার একাত্ম হয়ে ওঠার গভীর ব্যঞ্জনা। তাই তো অসাধারণ ও অনন্য বাক্যবন্ধ রচনা করে তিনি বলেন, ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’। এখানে কেবল সম্বোধনের রূপ বদল নয়, ঘটে যায় সত্তার রূপান্তর, মনে রাখার আহ্বান নিশ্চয়ই জনতাকে জানিয়েছেন নেতা; কিন্তু পরবর্তী উচ্চারণ ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব’, এটা নেতা ও জনতার সম্মিলিত উচ্চারণ, উভয়ের সত্তা একীভূত হয়ে যায় যেখানে, তারপর আবার ফিরে আসে নেতৃরূপ, ঘোষিত হয় প্রত্যয়, ‘এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব’। এক নিঃশ্বাসে ভবিষ্যৎবাদী প্রত্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্রষ্টার মহিমাকীর্তন করে তিনি উচ্চারণ করেন ‘ইনশাআল্লাহ’, লোকধর্ম ও লোকরীতি সহজাত প্রকাশ পায় তার উচ্চকিত রাজনৈতিক ভাষণে। এমন অসাধারণ বাক্য কেউ শিখে-পড়ে-লিখে বা বক্তৃতার পয়েন্ট হিসেবে নিয়ে আসতে পারে না, জীবনব্যাপী সাধনার মধ্য দিয়ে এমন বাক্যোচ্চারণের শক্তি অর্জন করতে হয়। আর তাই বক্তৃতার শেষে অমোঘ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের শেষ আহবান জানানোর দৃশ্যকেও সেভাবে চিহ্নিত করে বলা যায়, সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত থেকে বাংলাদেশ হয়ে গেল স্বাধীন, যদিও আইনগত ও বস্তুগত ভিত্তি রচনা তখনও ছিল বাকি। তবে সর্বজনের মানসলোকে স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করে সেই পথ তো উন্মোচন করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

ব্যতিক্রমী লেখক আহমদ ছফা বঙ্গবন্ধুকে বলতেন বাংলার ভীম, মধ্যযুগের বাংলার লোকায়ত যে নেতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বাধীন রাজ্যপাট, নির্মাণ করেছিলেন মাটির দুর্গ, ভেতর গড়ে যে দুর্গ প্রাচীর এখনো দেখতে পাওয়া যায়, মাটির হলেও পাথরের মতো শক্ত। বাংলার ইতিহাসের এমন অনন্য নির্মাণ-কীর্তির তুলনীয় আর কিছু যদি আমাদের খুঁজতে হয়, তবে বলতে হবে ৭ মার্চের ভাষণের কথা। যেমন ছিল মধ্যযুগের বাংলার রাজা ভীমের গড়া পাথরের মতো শক্ত মাটির দুর্গ, তেমনি রয়েছে বিশ শতকের বাংলার লোকনেতা মুজিবের ভাষণ, যেন বা মাটি দিয়ে গড়া, তবে পাথরের মতো শক্ত।

(লেখাটি বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম গ্রন্থ থেকে নেওয়া)

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি