ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৫ নভেম্বর ২০২৪

বঙ্গবন্ধু, বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন

মো. তাজুল ইসলাম

প্রকাশিত : ০০:০০, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ০০:০১, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

মো. তাজুল ইসলাম

মো. তাজুল ইসলাম

বর্তমানে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস‘র বিচারক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি আইন বিষয়ে গবেষণা করছেন এবং বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় আইন ও বিচার সম্পর্কে নিয়মিত কলাম লেখেন।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যে কোনো গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য অতীব জরুরি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সদ্যস্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে পায় নতুন সংবিধান। সেই সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনা ছিল সুদূরপ্রসারী এবং জনগণের আশা-আকাঙ্খা ও চাহিদার প্রতিফলন। বিচার বিভাগ স্বাধীন না হলে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয় না। বঙ্গবন্ধু, বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন তিনটি শব্দ সংবিধানে তথা বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসে একাকার হয়ে মিশে আছে। একটি বাদ দিলে অপরটি অসম্পূর্ণ। সে কারণে আইনের ছাত্র হিসাবে (বঙ্গবন্ধুও আইনের ছাত্র ছিলেন) কেন লেখার জন্য এই বিষয়টি বেছে নিলাম তার যথার্থতা প্রমাণের চেষ্টা করবো।

লেখার শুরুতে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের, যাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ও জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছি আমরা।

বাংলাদেশের সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থা এগিয়ে চলেছে, অপরাধী যেই হোক তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এই স্লোগানে বা প্রতিপাদ্যে। শুদ্ধি অভিযান চলছে ঘরে বাইরে সবখানে। আরও চলুক অপরাধীদের শিকড় উপড়ে না ফেলা অবধি। অপরাধ করলে তার বিচার না হওয়া বা না করা এক ধরনের অভিশাপ ও ব্যাধি। অপরাধীর বিচারের মুখোমুখি করা সময়ের দাবি। রাষ্ট্র এখানে সোচ্চার। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ১২ বছর বা এক যুগ পেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মামলা নিষ্পত্তির পরিসংখ্যান হতে দেখা যায় শুধু জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ৮৮ লক্ষাধিক মামলা। মামলা নিষ্পত্তি হার গড়ে ৯৫ শতাংশের বেশি। ১৯৯০-২০০৭ পর্যন্ত শাসন বিভাগ দ্বারা পরিচালিত ম্যাজিস্ট্রেসির নিষ্পত্তির হার ছিল ৮৭ শতাংশের কাছাকাছি। তবে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ হতে পৃথক হওয়ার দিন থেকে আজ পর্যন্ত মামলা নিষ্পত্তির হার কোনো কোনো বছর ১০০ শতাংশ অতিক্রম করেছে।

বর্তমান ফৌজদারী বিচার বিভাগে মামলা নিষ্পত্তির হার শতভাগ হওয়ায় এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, অপরাধ করে বিচারের মুখোমুখি না হওয়ার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশ বের হতে সক্ষম হয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ন্যায়বিচার দর্শন কাজে লাগতে শুরু করেছে। যে কোনো দেশের সভ্যতার মানদণ্ড বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্য সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে দায়-দায়িত্ব রয়েছে। তেমনি জনগণের আস্থার প্রতিও বিচার বিভাগের দায়ভার রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে হলে আপিলের স্তর কমাতে হবে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন আপিলের স্তর বাড়লে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। মানুষ হয়রানির শিকার হয়। মামলার বয়স ও দীর্ঘসূত্রিতা বাড়ে কিন্তু বিচার প্রার্থীর আয়ু কমে। সে কারণে তিনি বিচার বিভাগকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে পারলে দেশে বিচারহীনতা কমবে। আদালতের ওপর মানুষের আস্থা বহুগুণে বাড়বে। ভবিষ্যত প্রজন্ম ন্যায়বিচার পাবে। 
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে জাতির পিতার স্বপ্ন বিভিন্ন সময়ে তার রাজনৈতিক সভার ভাষণে প্রত্যক্ষ করা যায়। ১৯৭২ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথককরণের (Separation of Power) উদ্যোগ নেন।

১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি দৈনিক বাংলা পত্রিকা’র ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করা যাক-
বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘আমি হাইকোর্ট ও অধস্তন আদালতগুলো যাতে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আমি এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত করতে চাই যে, দুর্নীতি ও কালক্ষেপণ উচ্ছেদ করার প্রেক্ষিতে বিচার ব্যবস্থার কতকগুলো মৌলিক ত্রুটি সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রশাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের নীতি সূক্ষ্মভাবে পর্যলোচনা করা হবে।’

দেশ ও জাতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সরকারের তিনটি অঙ্গ- শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হয়। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র তাই করে। অন্যান্য বিভাগের ওপর শাসন বিভাগের আধিপত্য, যা ব্রিটিশ আমল থেকে দৃশ্যমান, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই কাম্য নয়। দীর্ঘদিনের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে নয়, বরং স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্র তৈরি করার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আমরা সকলেই জানি, পয়লা নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথককরণ দিবস। ২০০৭ সালের বাংলাদেশে শাসন বিভাগ থেকে আলাদা করা হয় বিচার বিভাগ। এক যুগ পার হয়েছে সেই পৃথককরণের। এটি বিচারক তথা বিচার বিভাগের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিবস। 

বিচার বিভাগের পৃথককরণ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বর্তমান সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তবে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতাকেন্দ্রিক আধিপত্য কমে যেতে পারে- এ আশঙ্কায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে কিছুটা গড়িমসিও দেখা যায়। যা হোক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা এবং বর্তমান সরকার ও তার আইনমন্ত্রী সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কনসেপ্টটিতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

আইনের ব্যাখ্যা দান ও বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিচারকদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতাকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বোঝায়। তবে বিচারকদের এ ধরনের স্বাধীনতার অর্থ কোনভাবে তাদের অবাধ কিংবা যা খুশি তা-ই করার ক্ষমতাকে বোঝায় না। বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পাশাপাশি সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিচারকদের দায় বহুলাংশে বেড়ে গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংবিধানে বিচার বিভাগকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানবিরোধী বিধি-বিধানকে অবৈধ ও বিধিবহির্ভূত ঘোষণার ক্ষমতা দিয়েছে। সংবিধানের ৭ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের অভিপ্রায়ে পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছে।

সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে অর্থাৎ রাষ্ট্র্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অনুচ্ছেদ ২২-এ বলা হয়েছে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার  বিভাগের পৃথককরণের বিধান সম্পর্কে। ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন। (Article 22 of the Constitution provides that the State shall ensure the separation of judiciary from the executive organs of the State.)।

সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অংশের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ সংবিধান প্রবর্তন থেকে সে সকল আইন ততখানি বাতিল হবে।’ অর্থাৎ সংবিধান আমাদের বিচার বিভাগকে স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

বিচারকদের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে সংবিধানের ১১৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ ও ম্যাজিস্ট্রেট বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন। (116A. Subject to provisions of the Constitution, all persons employed in the judicial service and all magistrates shall be independent in the exercise of their judicial functions.) অর্থাৎ সংবিধানের বিধানমতে বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন।

তাদের নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে- ‘বিচারবিভাগীয় পদে বা বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উক্ত উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধিসমূহ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন।’ বলার অপেক্ষা রাখে না যদি কোনো রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তবে বিচারকার্যে নানা রকমের জটিলতার সৃষ্টি ও ন্যায়বিচার প্রলম্বিত হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতা চলে যায় স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে এবং সামরিক শাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সংবিধান বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়। ২০০৭ সালের আগে পর্যন্ত ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ইচ্ছামতো বিচার বিভাগকে সাজাতে চেয়েছে। অবশেষ স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর অরাজনৈতিক ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সিদ্ধান্তে আপন পথ ফিরে পায় বিচার বিভাগ। জাতির জনকের সময়ে প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদের এই বাস্তব রূপদান ছিল এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, যাকে দেশের বিচারাঙ্গনসহ সব স্তরের জনগণ সাধুবাদ জানায়।

বিচার বিভাগ স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে ২০০৭-২০০৮ সালে বেশ কিছু আইন সংশোধন ও নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়, যেখানে ১৯৭২ সালের সংবিধানে উল্লেখিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটে। যেমন- বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা ২০০৭, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পে স্কেল-২০১৬ ইত্যাদি। এ ছাড়া অধস্তন আদালতগুলোর শৃঙ্খলা বিধানসহ একটি আলাদা ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।

সবচেয়ে যুগান্তকারী সংশোধনী আনা হয় ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এ। এই আইনের ০৬ ধারায় দুই ধরনের ম্যাজিস্ট্রেটের পদ সৃষ্টি করা হয়। এক পক্ষে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যপক্ষে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭-১৪৮ ধারা, ১৭৬ ধারাসহ আরও কিছু ধারা যেমন ২৯(বি) ধারায় কার্যক্রম পরিচালনা ও দ- প্রদানের ক্ষমতাসহ মোবাইল কোর্ট ২০০৯ এর অধীনে বাংলাদেশে প্রচলিত ১১৯টি (২০১৯ পর্যন্ত) আইনে নির্বাহী ম্যাজিস্টেটরা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।

বিচার বিভাগের হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা মূলত বিচার বিভাগ পৃথককরণ নীতির বাস্তবায়ন। জনগণ ইতোমধ্যে বিচার বিভাগ পৃথককরণের সুফল টের পাচ্ছে। এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিতে নিষ্পত্তি হয়েছে এবং হচ্ছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে।

বিশ্বের মধ্যম আয়ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমাদের দেশে নির্বাচিত সরকার, আইন পরিষদ ও জাতির পিতার হাতে গড়া দেশ ও বিচার ব্যবস্থার নিরিখে দেশে গণতন্ত্রকামী জনগণের আকাঙ্খা ও চাহিদা পূরণ করার উপযোগী পরিবেশ বিদ্যমান। তার পরও বাস্তবে আইনের শাসনের প্রতিফলন ঠিক সে রকম ফলাও করে লেখার মতো নয়। বোধ করি সে কারণে এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে জাতির জনক বলেছিলেন, ‘আমরাও বিচার বিভাগকে একই উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই।’ তিনি মনে করেন, আমাদের মতো দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব যাদের কাছে থাকে, তারা প্রায়শই ভুলে যান যে তাদের সে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেশের প্রচলিত আইন ও আইন প্রতিষ্ঠানের অধীন।

যদি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়, তবে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন শক্তিশালী ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সেদিক বিবেচনায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সার্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা শুধু স্বাধীন বিচার বিভাগের একার পক্ষে সম্ভব নয়। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক (Separation of Power) হওয়াটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সবচেয়ে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ  ধাপ অতিক্রম মাত্র। বিচার বিভাগের কাছে ন্যায়বিচার পাওয়া যেসব উদ্যোগ ও অনুষঙ্গের ওপর নির্ভর করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বিচারকদের সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত মানসিকতা। তারা যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংকল্পে শক্ত অবস্থান নেন তবে পৃথককরণের সুফল মিলবে তাতে সন্দেহ নেই।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষহীন। জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে বিচার বিভাগের পৃথককরণ নীতি তাঁর সরকারের আমলে বাস্তবায়ন হবে। তারা আরও আশা করে, বিচার বিভাগ যাতে সামগ্রিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বদা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে সে ব্যাপারে সরকার সার্বিক সহযোগিতা এবং বিচার প্রশাসনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (Sustainable Development Goal) অর্জনে বদ্ধপরিকর।

সুতরাং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সব সরকার, রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের এক মঞ্চে আসা দরকার। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ন্যায়বিচারের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্য সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে।

লেখক: মো. তাজুল ইসলাম, বিচারক (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ), বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস।

এমএস/এসি
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি