ঢাকা, শুক্রবার   ২৪ জানুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশি রোগীদের জন্য চীন হচ্ছে কলকাতার বিকল্প, আশঙ্কায় ভারত

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:৫৭, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সঙ্কটে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। একের পর এক ইস্যুতে সেই সম্পর্ক ক্রমেরই খারাপের দিকেই এগিয়েছে। এমনি কি বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়াও বন্ধ রেখেছে ভারত। গুরুতর অসুস্থতার প্রমাণ দিতে পারলে দিচ্ছে ‘মেডিক্যাল ভিসা’, কিন্তু বন্ধ রয়েছে ‘ট্যুরিস্ট ভিসা’। 

এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য চীনের কুনমিং কলকাতার বিকল্প হয়ে উঠছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কলকাতার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশিদের জন্য কি ভারতীয় ভিসার পরিবর্তে চীনের ভিসার চাহিদা বাড়ছে?

দৈনিক আনন্দবাজার অনলাইন তাদের সেই  আশঙ্কা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, কলকাতার বদলে কুনমিং! বাংলাদেশিদের স্বাস্থ্যোদ্ধারে ভারতীয় ভিসার বদলে কি এ বার চিনা ভিসার চাহিদা বাড়তে চলেছে? সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। ঢাকার একটি সূত্রের দাবি, বাংলাদেশি নাগরিকদের উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতার ‘বিকল্প’ ব্যবস্থা করে দিতে চীনকে অনুরোধ করেছেন তিনি। সেই সূত্রে দাবি, অনুরোধ পেয়ে চীনের সরকার কুনমিং শহরের ৩ থেকে ৪টি হাসপাতালকে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের রোগীদের যাতায়াতে কলকাতার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল (মূলত ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস সংলগ্ন) তাদের বাণিজ্য বাড়িয়েছে। শুধু হাসপাতালই নয়, হাসপাতালসংলগ্ন এলাকায় চালু হয়েছে বিভিন্ন ‘লজ’, ট্র্যাভেল এজেন্সি, খাবারের দোকান ইত্যাদি, যাকে বলা হয়ে থাকে ‘স্বাস্থ্য পর্যটন’। তাহলে, চীনের কারণে কি মুখ থুবড়ে পড়ছে কলকাতার স্বাস্থ্য পর্যটনের অর্থনীতি?

গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশিরা এখন ভারতীয় ভিসা পাচ্ছেনা। গুরুতর অসুস্থতা বা আপদকালীন পরিস্থিতির প্রমাণ দিতে পারলে ‘মেডিক্যাল ভিসা’ মিলছে। বন্ধ রয়েছে ‘ট্যুরিস্ট ভিসা’। ফলে কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কলকাতার বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর হিসেব বলছে, বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ!

কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলো প্রথমে ভেবেছিল এই ধাক্কা ‘সাময়িক’। দ্রুত বাংলাদেশে স্বাভাবিকতা ফিরবে বলে আশা করেছিল তারা। তারা ভেবেছিল, আবার ট্যুরিস্ট ভিসা দেওয়া শুরু হবে এবং আগের মতই থাকবে রোগীর সংখ্যা। কিন্তু সেখানে নতুন মোড় এনেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের চীন সফর। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে নিজ দেশের নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য সহায়তা চান তৌহিদ। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রের দাবি, তৌহিদের অনুরোধে সাড়াও দিয়েছে চীন। চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের সামনে কলকাতার ‘বিকল্প’ হিসেবে কুনমিং শহরের কথা বলেছে চীন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এমনই লেখা হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে এই বাজার কলকাতার পরিবর্তে কুনমিংয়ের নিয়ন্ত্রণে যাবে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশিদের চিকিৎসার জন্য কোনো শহরই কলকাতার বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে না। কলকাতা তাদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক শহর বলেই বাংলাদেশিরা এখানে আসেন। ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি— সব দিক দিয়ে কলকাতা বাংলাদেশিদের কাছে সুবিধাজনক। খাদ্যাভ্যাস, ভাষা ইত্যাদি প্রায় হুবহু মেলে বলেই চিকিৎসার জন্য অনেক দিন থাকতে হলেও বাংলাদেশিদের কোনো অসুবিধা হয় না। বাংলাভাষী চিকিৎসকদের নিজের সমস্যা বোঝাতেও অসুবিধা হয় না। কুনমিংয়ে চিকিৎসা করাতে গেলে সে সব হবে কি?’

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে কলকাতায় স্বাস্থ্য খাতের বাণিজ্য বড় ধরণের ধাক্কা খেয়েছে বলে স্বীকার করেছেন আরেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গৌতম খাস্তগির। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা আবার আগের জায়গায় ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে।’

কিন্তু চীনের কুনমিং শহর বাংলাদেশিদের কাছে কলকাতার বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করেন না এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশি রোগীরা চীনের কুনমিং সিটিতে গিয়ে চিকিৎসা করাবেন, এটা বাস্তবসম্মত নয়। কলকাতায় যতটা সহজে সব হয়, কুনমিংয়ে সেই সুবিধা মিলবে না। ফলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলো তাদের বাংলাদেশি বাজার যে আবার ফিরে পাবে, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।’

কলকাতার চিকিৎসকদের এমন মনে করার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বিদেশ থেকে রোগী আনার ব্যবস্থাপকরা, যাদের ‘কো-অর্ডিনেটর’ বা ‘কমপ্লায়েন্স অফিসার’ বলা হয়। এদের মূল কাজ দালালদের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রেখে নিজ নিজ হাসপাতালে বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি রোগী নিশ্চিত করা। স্বভাবতই তারা তাদের নাম প্রকাশে ইচ্ছুক নন। কিন্তু তারা জানান, ‘থ্রি-লেয়ার কমিউনিকেশন’ এর কথা। কাজ হয় ত্রিস্তরে। প্রথমে রোগী বা তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় ঢাকায়। অনেক ক্ষেত্রে সেখানেই স্থির হয় হাসপাতাল বা চিকিৎসকের নাম। নাহলে বেনাপোল পৌঁছনোর পর দেখা মেলে দালালদের সঙ্গে। সেটি দ্বিতীয় স্তর। সেখানেও ব্যবস্থা না হলে তৃতীয় স্তর কলকাতার মির্জা গালিব স্ট্রিট-কিড স্ট্রিট এলাকায়। বাংলাদেশি রোগীরা বা তাদের পরিবার ওই এলাকার বিভিন্ন হোটেলে ওঠেন। বিভিন্ন হাসপাতালের এজেন্টরা দিনভর সেখানেই ওত পেতে থাকেন।

কলকাতার বেশ কয়েকটি বড় বেসরকারি হাসপাতাল এবং বেশ কয়েক জন নামী চিকিৎসক ঢাকায় নিজেদের ‘আউটডোর’ খুলে রেখেছেন বলেও এই ‘কো-অর্ডিনেটর’রা জানাচ্ছেন। সেই সূত্রেই তাদের অভিমত, ঢাকা-কলকাতার মধ্যে চিকিৎসা আদানপ্রদানের এই ‘সুপ্রতিষ্ঠিত’ বন্দোবস্ত ঢাকা-কুনমিংয়ের মধ্যে তৈরি হওয়া সহজ নয়।

বেঙ্গালুরুভিত্তিক এক হাসপাতাল চেইনের ‘কমপ্লায়েন্স অফিসার’ বলছেন, ‘ভারতের সবকিছু বর্জন করতে হবে বলে এখন বাংলাদেশে স্লোগান তোলা হচ্ছে। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতেই স্বাস্থ্য পর্যটনে কলকাতার বিকল্প গন্তব্য দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ অনেক স্মার্ট। তারা জানেন কোথায় তাদের সুবিধা, আর কোথায় অসুবিধা।’

বাংলাদেশের জন্য কুনমিংয়ে চিকিৎসা করানোয় ‘অসুবিধা’ আরও আছে। ঢাকা থেকে কলকাতা সড়কপথ বা রেলপথে আসা যায় কয়েক ঘণ্টায়। কুনমিংয়ে সেভাবে পৌঁছনো অসম্ভব। একমাত্র মাধ্যম আকাশপথ। তাও সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে কুনমিং যাওয়ার কয়েকটি ফ্লাইট রয়েছে। এছাড়া ঢাকা থেকে চীনের পিকিং বিমানবন্দর বা গুয়াংঝো বিমানবন্দরে যেতে হবে এবং সেখানে ৭ ঘণ্টা বা ১০ ঘণ্টার বিরতির পর কুনমিংয়ে যেতে হবে। আর অসুস্থ রোগীর জন্য এই যাত্রা ‘সুবিধাজনক’ নয়। ফলে নতুন স্বাস্থ্য পর্যটনস্থল খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু সেই ভয়ে ভীত নয় কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলো।

এমবি//


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি