ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

অগ্নিঝরা মার্চ

বাংলাদেশের পতাকা উৎসব

প্রকাশিত : ০৮:১৭, ২৩ মার্চ ২০১৯

১৯৭১-এর ২৩ মার্চ ছিল মঙ্গলবার। লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের ২২তম দিবস। বঙ্গবন্ধুর ডাকে উত্তাল অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের গণতরঙ্গের আঘাতে পাকিস্তান দিবসের বিপরীতে আজ সারা বাংলাদেশে পালিত হয় `লাহোর প্রস্তাব দিবস`। আর স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে দিনটি পালিত হয় `প্রতিরোধ দিবস` হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আজ ছিল সাধারণ ছুটির দিন। ঢাকাসহ সারাদেশের প্রতিটি বাড়িতে, যানবাহনে, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার ভবনগুলোর শীর্ষে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিষদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালসহ সব প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত বাংলার মানুষের প্রাণের পতাকা উত্তোলিত হয়।

রাজধানী ঢাকা পরিণত হয় পতাকার নগরীতে। স্বাধীনতাকামী প্রতিটি বাঙালির মুখ যেন নবসূর্যের নব আলোকে উদ্ভাসিত। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য! সুবিপুল আগ্রহ আর উদ্দীপনায় সমগ্র বাঙালি জাতি এদিন মেতে ওঠে পতাকা উৎসবে। কড়া প্রহরাবেষ্টিত প্রেসিডেন্ট ভবন, গভর্নর হাউস এবং ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি। আজকের কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে বাংলার সংগ্রামী জনতা স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গত ২২ দিন ধরে স্বাধিকারের দাবিতে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনে যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছে, বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসার আগে পর্যন্ত সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র জনতার যে লড়াই, সে লড়াইয়ে জয়ী হয়েছে বাংলার জনগণ। সামরিক শাসনের হুমকি-ধমকি, তর্জন-গর্জন, বুলেট-বেয়নেট কোনো কিছুই কাজে আসেনি। বরং সব ধরনের অবৈধ নির্দেশ অমান্য করে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত নেতার নির্দেশ পালন করে সংগ্রামের পথে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সূচিত আন্দোলনের চাপে ও তাপে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ঢাকা এখন পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক শহরে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে ছুটে আসতে হয়েছে ঢাকায়। দেশের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ দলনেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছে সকলে। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক তথা নৈতিক বিজয়। গণশক্তির বলে বলীয়ান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জয়। সর্বাত্মক অহিংস-অসহযোগের বিজয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়। এ বিজয়ের সামনে সম্পূর্ণ বিকল হয়ে পড়েছে পিন্ডির শাসনযন্ত্র, ব্যর্থ হয়ে গেছে সামরিক বাহিনীর বর্বর বন্দুকের ব্যবহার।

আজ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের যৌথ উদ্যোগে `প্রতিরোধ দিবস` পালন উপলক্ষে পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন। দুপুর ১২টায় মুক্তিপিপাসু হাজার হাজার নর-নারীর আনন্দোচ্ছল কিন্তু বজ্রকঠোর শপথের দীপ্তিতে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনটি যেন দ্যুতিময় হয়ে ওঠে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বাংলার তরুণ-যুবাদের চেতনায় আত্মপ্রত্যয়ের এক অনির্বাণ শিখা প্রোজ্জ্বলিত হয়। গতকাল পত্রিকায় প্রেরিত এক বিশেষ বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, `আমাদের আন্দোলনের বৈধতার কারণে বিজয় এখন থেকে আমাদেরই।` গতকাল বিদেশি টেলিভিশনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, `দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচিত বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করার নৈতিক বৈধতা কেবলমাত্র আমারই রয়েছে, অন্য কারও নয়। আমার জনগণ তাদের সুমহান আত্মত্যাগ ও কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে বিগত ২১ দিনের অসহযোগ আন্দোলনে বিশ্বের ইতিহাসে নূতন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।` এ সাক্ষাৎকারে তিনি ঘোষণা করেন, `আমরা সঠিক পথেই আছি। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। আমাদের জনগণ অবৈধ ও অন্যায় যে কোন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ন্যায্যতা এবং বৈধতা প্রতিষ্ঠায় যখন রক্তদান করতে শিখেছে, তখন কোন অবৈধ শক্তিই আর তাদের পদানত করে রাখতে পারবে না।`

আজ সাধারণ ছুটি থাকায় বিক্ষুব্ধ বাংলার দশদিগন্তে সর্বাত্মক মুক্তিসংগ্রামের পটভূমিতে ২৩ মার্চের অবিস্মরণীয় দিনে ঢাকা শহর ও শহরতলির বিভিন্ন দিক থেকে বন্যার স্রোতের মতো অজস্র জনতার স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে। কাকডাকাভোর থেকে গভীর রাত অবধি ঢেউয়ের মতো একের পর এক শান্তিপূর্ণ ও নিয়মানুগ মিছিলের পর মিছিল। সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ আজ প্রাণের পতাকার টানে বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমাগত। মিছিলকারী সকলের হাতেই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এ সময় বাম হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরে ডান হাত জনতার উদ্দেশে বাড়িয়ে দিয়ে মুক্তিকামী মানুষের মিছিলের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, `বাংলার মানুষ কারও করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতা বলেই তারা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনবে। জয় বাংলা, বাংলার জয় অনিবার্য।` সকাল থেকে ৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে প্রায় ৬০-৭০টি মিছিলের উদ্দেশে বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, `বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগ ও আমাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত করেছে। সুতরাং শাসন করার বৈধ অধিকার কেবল আমারই আছে। বুলেট এবং বেয়নেটের মাধ্যমে যত ষড়যন্ত্রই চলুক না কেন সমগ্র বাংলাদেশ আজ জাগ্রত, বাঙালি জাতি আজ একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অবিচল ও ঐক্যবদ্ধভাবে ধাবমান। সুতরাং জয় আমাদের সুনিশ্চিত।` সমবেত জনতার উদ্দেশে বাংলার সর্বাধিনায়ক ৭ মার্চের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে বলেন, `এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। বাংলার মানুষকে আর পরাধীন করে রাখা যাবে না। আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। যদি তা সম্ভব না হয়, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম আমাদের চলতে থাকবে। এ সংগ্রামের কর্মপন্থা কী হবে, তা আমি ঠিক করে দিব, সে ভার আমার উপরই ছেড়ে দিন। আজ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধু ও প্রেসিডেন্ট উভয়ের উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে দু`দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম বৈঠক দুপুর ১২টা থেকে ১টা- এক ঘণ্টা এবং দ্বিতীয় দফা বৈঠক সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৮টা- দু`ঘণ্টা স্থায়ী হয়।

দু`দফা বৈঠকে আলোচ্য বিষয়ের বিস্তারিত জানতে চাইলে তাজউদ্দীন আহমদ কিছু বলতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। এদিকে আজ বিকেলে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ৩২ নম্বরে পশ্চিম পাকিস্তানের ৬ জন নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা মিয়া দৌলতানা, ন্যাপ (ওয়ালী) প্রধান ওয়ালী খান, জমিয়তে ওলামায়ে পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা মাওলানা শাহ আহমেদ নূরানী, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মুফতী মাহমুদ, পাঞ্জাব কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সরদার শওকত হায়াত খান এবং বেলুচিস্তান ন্যাপের সভাপতি গাউস বক্স বেজেঞ্জো। আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এ আলোচনায় তাঁর সহকর্মীবৃন্দের মধ্যে ছিলেন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও ড. কামাল হোসেন। আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের মিয়া দৌলতানা বলেন, `আমরা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা ইতিপূর্বে যৌথ বৈঠকে মিলিত হয়েছি এবং আজকের এই বৈঠক তারই পরবর্তী পর্যায়মাত্র।` সংকট নিরসনে কোনো ফর্মুলা সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, `কোন নির্দিষ্ট প্রস্তাব সম্পর্কে আলোচনা হয় নাই।` বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আর কতদিন আলোচনা চলবে এরূপ প্রশ্নের জবাবে বলেন, `দেশের মঙ্গলের জন্য সবকিছু কয়েক মিনিটের মধ্যে মিটে যাক, আমরা সেটিই চাই।` পাশে থাকা ওয়ালী খান এ সময় বলেন, `আমরা আশাবাদী।` তখন বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে নিজ বক্তব্য যোগ করে বলেন, `আপনারা ভালো আশা করুন, খারাপটার জন্যও প্রস্তুত থাকুন।`

এসব বৈঠকেই ২৫ মার্চ গণহত্যার জন্য প্রণীত `অপারেশন সার্চলাইট` নীলনকশাটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। আজ সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে মি. ভুট্টো বলেন, `বর্তমানে দেশে ক্ষমতার ৩টি উৎস বিদ্যমান। পিপলস্‌ পার্টি, আওয়ামী লীগ এবং সেনাবাহিনী।` মি. ভুট্টোর এহেন বিবৃতিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ বলেন, `মি. ভুট্টো আপনি এবং আপনার দোসররা এটা জেনে রাখুন যে, দেশের জনসাধারণ যখন তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অপেক্ষা করছে, তখন সেই উদ্দেশ্যকে বানচাল করে দেওয়ার জন্যই এ ধরনের ভণ্ডামিপূর্ণ বিবৃতি প্রদান করা হচ্ছে।` পরিস্থিতি যেদিকেই যাক না কেন, বাংলার মানুষ আজ চূড়ান্ত আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রতি ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে আমরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াসহ পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দকে সাফ জানিয়ে দিয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনে আমরা বদ্ধপরিকর।


টিআর/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি