বাংলাদেশের সংবিধানের সংস্কার জরুরি
প্রকাশিত : ১৫:৫৯, ২০ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ২২:৫১, ২০ নভেম্বর ২০১৭
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন `সংবিধান`। এটি একটি লিখিত দলিলও বটে। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল মাত্র ৯ মাসে জাতিকে একটি সুলিখিত ও যথোপযুক্ত সংবিধান উপহার দেয়া। অথচ ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত দুই বছরে সংবিধান রচনা করলেও পাকিস্তানের ৯ বছর সময় লেগেছে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান থেকে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। গণপরিষদের একমাত্র কাজ ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবর এ কমিটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কাজ শেষ করে।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে এ সংবিধান গৃহীত হয় এবং একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে সংবিধান কার্যকর হয়। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় সংবিধান রচিত হয়েছে। তবে বাংলাকে মূল ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এ সংবিধানে ১টি প্রস্তাবনা, ১১টি ভাগ, ১৫৩টি অনুচ্ছেদ ও ৪টি তফসিল ছিল। সংবিধানের প্রথমভাগে প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ, দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ, তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারসমূহ, চতুর্থ ভাগে নির্বাহী বিভাগ, পঞ্চম ভাগে জাতীয় সংসদ, ষষ্ঠ ভাগে বিচার বিভাগ, সপ্তম ভাগে নির্বাচন, অষ্টম ভাগে মহাহিসাব নিরীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রক, নবম ভাগে কর্মকমিশন, দশম ভাগে সংবিধান সংশোধন ও একাদশ ভাগে বিবিধ বিষয়াবলী স্থান পেয়েছে। গণপরিষদে সংবিধানের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন বলেছিলেন, “এই সংবিধান শহিদের রক্তে লিখিত। এ সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে।”
সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধান মান্য করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। তবে কর্তব্যপালনের পূর্বশর্ত হলো সে-ই কর্তব্য সম্পর্কে জানা বা পরিস্কার ধারণা অর্জন করা। কিন্তু আমাদের সংবিধান রচিত হয়েছে সাধু ভাষায়– যার প্রচলন বর্তমানে নেই বললেই চলে। দেশের শিক্ষিত জনসমাজের পারস্পরিক ভাববিনিময় ও কথোপকথনের উপযুক্ত বাহন হচ্ছে চলতি ভাষা। সাধু ভাষা একটি অপরিবর্তনীয় ভাষা। তাই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তনশীল ভাষা হিসেবে বর্তমানে চলতি ভাষা বেশ সমাদৃত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে পত্র-পত্রিকাসহ সর্বত্র চলতি ভাষা অনুসরণ করা হয়। সাধু ভাষা যেহেতু বেশ প্রাচীন, সেহেতু আধুনিক ভাষা হিসেবে চলতি ভাষা-ই এখন সর্বক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে।
দীর্ঘ ৪৫ বছর আগে সাধু ভাষায় রচিত বাংলাদেশের সংবিধান পড়ে পাঠকেরা সহজে এটি বোঝতে পারে না। ভাষাগত জটিলতার কারণে সংবিধান পাঠের ইচ্ছেপোষণ করলেও পাঠকেরা পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আমাদের সম্মানিত সংসদ সদস্যরা এ বিষয়টি উপলব্ধি করেন কি না- করলেও এ নিয়ে কোনো আইনপ্রণেতাকে কোনো উচ্চবাচ্য করতে কখনো শুনিনি। তাই রাষ্ট্রের এ সর্বোচ্চ আইনটি সকলের জন্যে সহজ-সরল, সাবলীল, সুন্দর ও বোধগম্য ভাষায় সংস্করণ করা এখন সময়ের দাবী। আমাদের পূর্বসূরি রাজনীতিকেরা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, স্বাধীনতা অর্জনের এক বছরের মাথায় একটি শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান উপহার দিয়ে গেছেন। অথচ বর্তমান রাজনীতিকেরা আমাদের সংবিধানকে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নিতে পারছেন না। বর্তমানে জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলছে। জাতীয় সংসদে এ ব্যাপারে একটি বিল উত্থাপন করে আমাদের সংবিধানকে চলতি ভাষায় রচনার সিদ্ধান্ত নেয়া অতীব জরুরি।
লেখক : প্রধান-সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী
/ডিডি/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।