দেশে ৫ ব্যক্তির শরীরে ‘রিওভাইরাস’ শনাক্ত, যা জানা গেল
প্রকাশিত : ১৪:৪৭, ১২ জানুয়ারি ২০২৫ | আপডেট: ১৭:০৯, ১২ জানুয়ারি ২০২৫
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো রিওভাইরাস নামে একটি ভাইরাসের অস্তিত্ব শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা আইইডিসিআর পরীক্ষায় দেশের পাঁচ ব্যক্তির শরীরের এই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
তবে আক্রান্ত পাঁচজনের কারও ক্ষেত্রে তেমন কোনো জটিলতা দেখা যায়নি। চিকিৎসা শেষে তারা সবাই বাড়ি ফিরে গেছেন বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেছেন, “খেজুরের কাঁচা রস খেয়ে প্রতি বছর অনেকে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। সেরকম লক্ষণ দেখে কয়েকজনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল। তাদের নমুনায় রিওভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে।”
নিপাহ ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে আসা ৪৮ জনের নমুনা সংগ্রহ করে পাঁচজনের শরীরে রিওভাইরাস শনাক্ত হয়। আক্রান্তদের থেকে যখন নমুনা সংগ্রহ করা হয়, তখন তাদের নিপাহ ভাইরাস নেগেটিভ ছিল। অন্য ভাইরাস আছে কি না দেখতে গেলে রিওভাইরাস পজেটিভ পাওয়া যায় ওই পাঁচজনের নমুনায়।
আইইডিসিআর বলছে, মূলত নতুন রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর ওপর নিয়মিত গবেষণার অংশ হিসেবে এই নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।
ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যে লক্ষণগুলো হয় তা অন্যান্য ভাইরাসের মতোই অনেকটা।
ভাইরোলজিস্ট ও বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেছেন, "এই ভাইরাসগুলো অনেক দিন থেকে আমাদের মধ্যে আছে। ইনফেকশন করলেও সে তেমন ক্ষতিকারক না। এমন পৃথিবীতে অনেক ভাইরাস আছে যারা প্রতিনিয়ত ইনফেক্ট করে কিন্তু কোন ধরনের বড় ক্ষতির কারণ না"।
চিকিৎসকদের মতে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত তেমন গুরুত্বর কোন লক্ষণ দেখা যায় না। যে কারণে এর জন্য আলাদা কোন চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। সেই সাথে আতঙ্কিত না হওয়ারও পরামর্শ তাদের।
রিওভাইরাস কি?
রিওভাইরাস মূলত একটি রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (আরএনএ) ভাইরাস। রিওভাইরাস রিও-ভাইরিডি গ্রুপের ভাইরাস। এই ভাইরাস গোত্রের মধ্যে পরিচিত একটি ভাইরাস হলো রোটা ভাইরাস।
চিকিৎসকরা বলছেন, এই ভাইরাসের আলাদা কোন লক্ষণ নেই। অন্য ভাইরাসের মতোই স্বাভাবিকভাবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জ্বর, সর্দি, মাথায় ব্যথা, হাঁচি কাশির মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কখনো কখনো আক্রান্ত হলে ডায়েরিয়ার মতো লক্ষণও দেখা দিতে পারে বলে জানাচ্ছেন তারা।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, "এই ভাইরাস আগেও হয়তো ছিল। কিন্তু কখনো এটা শনাক্তের জন্য কোন ধরনের পরীক্ষা করা হয়নি।”
ভাইরোলজিস্টরা মনে করেন, এই ভাইরাসে যদি কেউ আক্রান্ত হয়ও তাতে এমন কোন লক্ষণ দেখা দিবে না, যা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে।
ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, “এই ভাইরাসটা অনেক আগে থেকেই আমাদের মাঝে আছে। নতুন কিছু না। ধরেন যদি ১০০ জনকে পরীক্ষা করা হয় তাহলে ৫০ জনের মধ্যেই এটা পাওয়া যাবে।”
সেটি কিভাবে পাওয়া যাবে তার একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন মি. মুন্সী। তিনি বলেন, "ধরুন কোন এক সময় একজন আক্রান্ত হয়েছিল, এখন ঠিক এই ভাইরাসের এন্টিবডি পরীক্ষা করবেন, দেখা যাবে সেটা পজিটিভ"।
তার মতে, কেউ যদি এই ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে থাকেন তার ঠাণ্ডা জ্বর থেকে শুরু করে পেট খারাপ, প্রদাহসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশে যেভাবে শনাক্ত হলো
বাংলাদেশে সাধারণত শীতকালে কাঁচা খেজুরের রস খেয়ে অনেকে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
আইইডিসিআরের কর্মকর্তারা জানায়, নিপাহ ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে আসা এমন ব্যক্তিদের পরীক্ষা করার পর তাদের নিপাহ ভাইরাস নেগেটিভ পাওয়া যায়। ওই ব্যক্তিদের প্রায় সবাই খেজুরের রস খেয়েছিলেন। পরে গবেষণার জন্য তাদের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
আইইডিসিআর বলছে, ওইসব রোগীদের যেহেতু নিপাহ ভাইরাস নেগেটিভ এসেছে, অন্য কোন ভাইরাসে তারা আক্রান্ত হয়েছে কী না সেটি দেখার জন্য তারা এই নমুনা সংগ্রহ করেছিল।
পরে পরীক্ষার পর কয়েকটি স্যাম্পলের মধ্যে ব্যাট-রিও ভাইরাস কিংবা যেখানে বাদুড়ের সংস্পর্শে ভাইরাস ছড়িয়েছে এমন তথ্য পান আইইডিসিআরের কর্মকর্তারা।
আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন বলেন, "খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া যাদের ইতিহাস ছিল তাদের শরীরে এটা পাওয়া গেছে। তারা সাসপেক্টেড নিপাহ ছিল, তারা হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছিলেন"।
আইইডিসিআর বলছে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাদুড় থেকে অন্য কোনো ভাইরাস খেজুরের রসের মাধ্যমে আসে কি না সেটি ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।
অধ্যাপক শিরীন বলেন, “এই পর্যন্তই আমরা জানি। এটা নিয়ে আমাদের আরো গবেষণার করা প্রয়োজন। গবেষণা শেষে এটা নিয়ে আরো বিস্তারিত বলা যাবে।”
চিকিৎসা ও সতর্কতা
শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, জ্বর, মাথাব্যথা, বমি ও ডায়রিয়া রিওভাইরাসের সাধারণ কিছু লক্ষণ বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। তবে যেহেতু বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এই ধরনের ভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে তাই বাড়তি কিছু সতর্কতার কথাও বলছেন তারা।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, “আমাদের পরীক্ষায় যারা রিওভাইরাস পজেটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন তাদের সবারই কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ার হিস্টোরি ছিল। এই ভাইরাস এড়িয়ে চলতে হলে খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়াই ভালো।”
চিকিৎসকরা একদিকে যেমন সতর্ক থাকার কথা বলছেন। অন্যদিকে, এটি নিয়ে একেবারের আতঙ্কিত না হওয়ারও পরামর্শ দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের গবেষণায় নতুন এই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়ায় এখনো পর্যন্ত চিকিৎসকদের কাছে এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নতুন কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক শিরীন বলেন, “এই ভাইরাসের আলাদা কিংবা নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা কো ব্যবস্থা নেই।”
চিকিৎসক ও গবেষকরা রিওভাইরাস ইস্যুতে এক বাক্যে বলেছেন, এই ভাইরাস নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার মতো কোন পরিস্থিতি কিংবা কারণ নেই।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এএইচ
আরও পড়ুন