বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসবের ১৪তম দিনে অস্টক পালা
প্রকাশিত : ২০:৩৪, ১৬ জানুয়ারি ২০২০
জাতীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টির উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রসারের মাধ্যমে শিল্প-সংস্কৃতি ঋদ্ধ সৃজনশীল মানবিক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বহুমূখী সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করে চলেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ৩ থেকে ২৩ জানুয়ারি ২০২০ দ্বিতীয়বারের মতো ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব ২০২০’ আয়োজন করেছে।
শের ৬৪টি জেলা, ৬৪টি উপজেলা এবং জাতীয় পর্যায়ের পাঁচ হাজারের অধিক শিল্পী ও শতাধিক সংগঠনের অংশগ্রহণে ২১ দিনব্যাপী একাডেমির নন্দনমঞ্চে এই শিল্পযজ্ঞ পরিচালিত হবে। ঐহিত্যবাহী লোকজ খেলা, লোকনাট্য ও সারাদেশের শিল্পীদের বিভিন্ন নান্দনিক পরিবেশনার মাধ্যমে সাজানো হয়েছে এই উৎসবের অনুষ্ঠানমালা। উৎসবে প্রতিদিন ৩টি জেলা, ৩টি উপজেলা, জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী ও সংগঠনের পরিবেশনা থাকবে। এছাড়াও একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রতিদিন রাত ৮টা থেকে একটি লোকনাট্য পরিবেশিত হবে।
১৬ জানুয়ারি উৎসবের ১৪তম দিন বিকাল ৪টায় নন্দনমঞ্চে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার শুরুতেই জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। এরপরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরিবেশনায় অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়। আজহারুল হক আজাদের পরিচালনায় বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশন করে ‘বাক শিল্পাঙ্গন।
ভোলা জেলার পরিবেশনায় জেলা ব্রান্ডিং ভিডিও তথ্যচিত্র প্রদর্শনী, জেলার ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক এবং উন্নয়নের গানের কথায় সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে শিল্পী মঞ্জুর আহমেদ, রেহানা ফেরদৌস, উত্তম ঘোষ, মৃদুল, শ্যামলী, মিতু, রূপা, সুমাইয়া, আমিরুল ও পলাশ। দেশাত্ববোধক গানে 2টি সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে শিল্পী মুনা, তানজিন, অথৈ, দোলা, হোসেন, হাসিব, চিন্ময়, শাওন ও অভি।একক সঙ্গীত পরিবেশন করে জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী মঞ্জুর আহমেদ এবং উপজেলা পর্যায়ের শিল্পী রেহানা ফেরদৌস। দেশের গানে যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করে শিল্পী ভাস্কর চন্দ্র মজুমদার, মীর আনোয়ার, নিলয় ও ইমন। জেলার অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি নাসির আহমেদ।
সুনামগঞ্জ জেলার পরিবেশনার শুরুতে জেলা ব্রান্ডিং ভিডিও তথ্যচিত্র প্রদর্শনী, লিয়াকত আলী লাকী’র কথা ও সুরে ‘এ মাটি নয় জঙ্গিবাদের এবং অনীষ তালুকদারের কথা ও দেবদাস চৌধুরী রঞ্জন এর সুরে ‘এখন পদ্মা মেঘনা সুরমা বহমান’ গানের কথায় 2টি সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে শিল্পী দীপু, সুবির বনিক, সুমন, মনির, রেদোয়ান, বৃষ্টি, কাকলী, বাবলী, শিপা ও ঝর্ণা। তুলিকা ঘোষ চৌধুরী’র নৃত্য পরিচালনায় ‘কোন গাঙ্গে আইলো পানি’ এবং ‘বাইজ্যোনারে শ্যামের বাঁশি’ গানের কথায় 2টি সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে শিল্পী সমির পল্লব, অমিত বর্মণ, আশীষ বর্মণ, আমজাদ হোসেন, দিবারতি ঐশি, অংকিতা দিয়া, মৌলি, প্রমি ও মৌমিতা। একক সঙ্গীত পরিবেশন করে জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী পাগল হাসান পরিবেশন করে ‘আমি এক পাপিষ্ঠ বান্দা এবং উপজেলা পর্যায়ের শিল্পী মাকসুদুর রহমান দিপু পরিবেশন করে ‘গ্রামের নওজোয়ান’। যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করে শিল্পী রশিদ উদ্দিন, আলী আকবর, কপিল ঋষি ও অমিত বর্মণ। জেলার অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. শামছুল আবেদীন।
সাতক্ষীরা জেলার পরিবেশনার শুরুতে জেলা ব্রান্ডিং ভিডিও তথ্যচিত্র প্রদর্শনী, আঞ্চলিক এবং দেশাত্ববোধক গানে ২টি সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে শিল্পী শ্যামল সরকার, কুমার ইন্দ্রজিত, শুভেন্দ্র সরকার, পার্থ, শহিদুল ইসলাম, সুস্মিতা সাহা, পূজা, তনিমা, শিরিনা ও দেবশ্রী। ২টি সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে শিল্পী নুসরাত জাহান, অনন্যা সরকার, আখি, রিয়া, সাকিব, দেবাশিষ, দীপ্ত, রেজাউল ও মুক্তা। এছাড়াও জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী ও উপজেলা পর্যায়ের শিল্পীর পরিবেশনায় একক সঙ্গীত, সমবেত যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশিত হয়।
সবশেষে ঝিনাইদহ জেলার পরিবেশনায় জেলা ব্রান্ডিং ভিডিও তথ্যচিত্র প্রদর্শনী, সমবেত সঙ্গীত, সমবেত নৃত্য, জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী ও উপজেলা পর্যায়ের শিল্পীর পরিবেশনায় একক সঙ্গীত এবং যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশিত হয়।
একাডেমি প্রাঙ্গণে রাত 8টায় দর্শনীর বিনিমেয়ে মঞ্চস্থ হয় সুকলাল মন্ডল এর পরিচালনায় এবং আলালপুরের রাজবাগ অষ্টকদলের পরিবেশনায় অষ্টক পালা ‘চন্ডিদাস রজকীনি, অভিমন্যু বর, হালই গান’। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন রতন বাসার- চন্ডিদাস, মঞ্জিলা গোলদার- রজকিনী, দোহার- দিরেণ বাওয়ালী, নৃত্য- কমলেশ বাশার, অনুপম বিশ্বাস, দোলা বাশার, বন্যা মল্লিক, সাগরিকা মল্লিক, নয়ন। যন্ত্রে সহযোগিতা করেছেন ত্রিশান বিশ্বাস- হারমনিয়াম, স্বপন মল্লিক- ঢোল, সমর মল্লিক- কর্নেট (বাঁশি) এবং সাগর দাস বাশার- মন্দিরা।
অস্টক পালা: অষ্টক গান বা অষ্টক নাচ বাংলাদেশের প্রাচীন লোকজ সংস্কৃতির একটি অন্যতম প্রধান ধারা। এটি সাধারনত বাঙালি হিন্দু সমাজ চৈত্র সংক্রান্তির নানাবিধ আচার-অনুষ্ঠানের সময় আয়োজন করে থাকে। অষ্টক নামক গীত বা নৃত্যের উদ্ভব সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও এ বিষয়ে নানা ধরনের মতামত প্রচলিত আছে। কেউ বলেন এতে আটটি বৈষ্ণবীয় প্রসঙ্গ থাকায় কেউ বলেন প্রতি দলে আট জনে মিলে রাধা কৃষ্ণের উক্তি নাট্যধর্মী গীত পরিবেশন করায় অষ্টক গীত বা নৃত্যের উদ্ভব ঘটে। বিভিন্ন অঞ্চলে একে বিভিন্ন নামে চিহ্নিত করা হয়। যেমন বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলে অষ্টক গান, ফরিদপুর/বরিশাল অঞ্চলে অষ্টক গীত/নৃত্য নামে পরিচিত। অষ্টক গীত বা নৃত্যে গানের ভাষা আটপৌরে ও অতি সাধারণ হলেও এর আবেগ ও ভাবের প্রকাশ খুব হৃদয়গ্রহী ও মনমুগ্ধকর। এই গান সাধারণত খেয়ালের ঢংয়ে গাওয়া হয়। এবং গানে স্থায়ী ও অন্তরা নামক দুটি স্তবক থাকে, যাতে অন্তরাগুলি ভগ্ন ত্রিপদির আঙ্গিকে রচিত।
আগামীকাল ১৭ জানুয়ারি ২০২০ বিকেল ৩টায় একাডেমি প্রাঙ্গণে ঐতিহ্যবাহী কাবাডি খেলা, বিকাল ৪টা থেকে একাডেমির নন্দনমঞ্চে পরিবেশিত হবে হবিগঞ্জ, খুলনা, দিনাজপুর ও নেত্রকোনা জেলার সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং রাত ৮টায় একাডেমি প্রাঙ্গণে দর্শনির মিনিময়ে অনুষ্ঠিত হবে ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য ‘গাজী কালুর কিচ্ছা’।
বাংলাদেশ হাজার বছরের বর্ণিল ও বিচিত্র সংস্কৃতির অপরূপ লীলাভূমি। হাজার বছরের সেই ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে আজও নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে দেশব্যাপী পরিচালিত হচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ। লোকজ সংস্কৃতি আমাদের অন্যতম শক্তি যা বিশ্বব্যাপী আমাদের স্বাতন্ত্রকে জানান দেয়। বাঙালি সংস্কৃতির রূপ, নির্মিত ও পরিবেশনা কৌশল আসলে মিশ্র প্রকৃতির; বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত বিভিন্ন শাসনব্যবস্থা, ভাষা ও প্রকরণের সমন্বয় ঘটে আমাদের সংস্কৃতি আজকের জায়গায় পৌঁছেছে।
২১ দিনব্যাপী বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসবের পরিবেশনার মধ্যে রয়েছে সমবেত সংগীত, যন্ত্রসংগীত, ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা, পালা, একক সংগীত, বাউল সংগীত, ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য, যাত্রা, সমবেত নৃত্য, অ্যাক্রোবেটিক, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা, পুতুল নাট্য, একক আবৃত্তি, শিশুদের পরিবেশনা, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগীত ও নৃত্য, নাটকের কোরিওগ্রাফি, বৃন্দ আবৃত্তি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি সম্প্রদায়ের পরিবেশনা, আঞ্চলিক ও জেলা ব্রান্ডিং বিষয়ক সংগীত ও নৃত্য এবং জেলার ঐতিহ্যবাহী ভিডিও চিত্র প্রদর্শনী।’
আরকে//