বাঙালির রক্তে রাঙানো মাস ফেব্রুয়ারি
প্রকাশিত : ০০:৫৬, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
বছর ঘুরে আবারও এলো ভাষার মাস; বাঙালি জাতি হওয়ার ঐতিহাসিক ফেব্রুয়ারি মাস। ১৯৫২ সালের এই ফেব্রুয়ারি মাসে পৃথিবীর বুকে একমাত্র জাতি হিসেবে ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে অর্জন করতে হয়েছে ‘বাঙালি জাতি’ হতে পারার অধিকার। দিনটি ছিল ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ।
গল্পটা একটু পিছন থেকেই শুরু করা যাক। ভারতীয় উপমহাদেশ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের নিগড় থেকে আলাদা হয়ে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম অংশ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ‘দ্বি-জাতি’ তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে গঠিত পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে এক ধর্ম ছাড়া আর অন্য কোনো মিল ছিল না।
সেই অমিলের তালিকা আরও বেড়ে যায় ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র সমাজে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। তাৎক্ষণিকভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখায় সেসময়ে ছাত্র সমাজ।
আন্দোলনে ফুসে ওঠে পুরো দেশ। বিভিন্ন সময় আন্দোলন চলতে চলতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিলের ডাক দেয় আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীরা। আর পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন জারি করলেন ১৪৪ ধারা।
কিন্তু সব বাধা ভেঙ্গে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” দাবিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে মিছিল বের করে ছাত্র জনতা। পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে সেই মিছিলে নির্মমভাবে গুলি বর্ষণ করে পুলিশ। আর তাতে শহীদ হন সালাম, রফিক, বরকত, শফিক, জব্বারসহ আরও অনেকে। অহিউল্লাহ নামের ৯ বছরের শিশুও সেই গুলি থেকে রেহাই পায়নি। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। আর এতে আরও বেগমান হয় আন্দোলনের ধারা। নিন্দার ঝড় ওঠে পুরো পাকিস্তান জুড়েই।
শারীরিক আন্দোলনের পাশাপাশি শুরু হয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য গণমাধ্যমে নিয়মিতভাবে সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। কলম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন কবি-সাহিত্যিক-গীতিকার ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গও। ভাষার এ আন্দোলনকে ঘিরে প্রথম কবিতা লেখেন ভাষা সৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী। “এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষচূড়ার নিচে...সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি...আমি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি”। গীতিকার আবদুল গাফফার চৌধুরী লেখেন চিরস্মরণীয় “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কী ভুলিতে পারি”? আন্দোলনের সেসময়ে আন্দোলনকারীদের সাহস জোগাতে এসব গান-কবিতাই হয়ে ওঠে বাঙালির মূল অনুপ্রেরণা।
এক পর্যায়ে প্রবল আন্দোলনের মুখ নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে দেওয়া হয় ‘রাষ্ট্র ভাষা’র মর্যাদা।
১৯৫৪ সালের ৭ মে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন যুক্তফ্রন্টের উদ্যোগে পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি প্রস্তাব পাশ করা হয়। আর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সর্বপ্রথম সংবিধান প্রণয়ন করা হলে তাতেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সে বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রেখে সংবিধান পাশ করা হয়। আর তা কার্যকরী হয় মার্চ ৩ তারিখ থেকে। আর এর মাধ্যমে ‘মায়ের ভাষায় কথার বলা’র অধিকারের দাবিতে তমুদ্দিন মজলিসের শুরু করা আন্দোলন সার্থকতা পায়।
এ আন্দোলন শুধু ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং এ আন্দোলনই পরবর্তীতে স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা হিসেবে কাজ করে। বাঙালি জাতি বুঝতে পারে যে নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই তাদের জন্য। আর আন্দোলন সংগ্রাম ছাড়া তা সম্ভব নয়। মূলত ভাষা আন্দোলনই ছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল অস্ত্র।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পর থেকেই প্রতি বছর ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে দিনটিকে উদযাপিত করছে বাঙালি জাতি। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো এ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সাল থেকে এটি সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে।
বাঙালি জাতির জন্য গৌরবের এই ফেব্রুয়ারি মাস উদযাপন করতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের উদ্যোগে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হল বাংলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত “অমর একুশে গ্রন্থমেলা”। ২১ ফেব্রুয়ারির সেই ভাষা শহীদ ও ভাষা সৈনিকদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৮৩ সাল থেকে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে এ মেলা উদযাপিত হয়ে আসছে।। ১৯৮৩ সাল বাদ দিয়ে এখন পর্যন্ত প্রতি বছর আয়োজিত হচ্ছে এই মেলা।
এসএইচএস/টিকে