‘বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চাই’
প্রকাশিত : ১৫:৩০, ৬ অক্টোবর ২০১৭ | আপডেট: ১৬:৫৫, ৭ অক্টোবর ২০১৭
মেয়েটি ছোটবেলা থেকেই সুন্দরী। সেই সঙ্গে মেধাবী ও চঞ্চল। এই সুন্দরী হয়ে জন্ম নেওয়াটাই তার বড় অপরাধ। পাড়ার মানুষের নজর আর পারিবারিক চাপের কাছে সে হয় পরাজিত। লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছা থাকা সত্যেও স্কুলের গণ্ডী পার হাওয়ার আগেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। এক কথায় বাল্যবিবাহ। কিন্তু সে চায় তার মেধাকে কাজে লাগিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে, নিজেকে প্রকাশ করতে। তাই বিয়ের পর পরই পালিয়ে যান তিনি। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুরু হয় কঠিন জীবন। যে যাত্রায় সঙ্গী ছিলো না কেউ, শুধু প্রবল ইচ্ছা শক্তি ছাড়া। একাকী জীবনে কঠিন সংগ্রামে নিজেকে তৈরি করতে কি পরিমান কষ্ট করতে হয়েছে সেই কথাই জানালেন- মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার প্রথম মুকুট বিজয়ী জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল। ইটিভি অনলাইনের হয়ে টেলিফোনে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন- সোহাগ আশরাফ।
একুশে টেলিভিশন : কেমন আছেন এভ্রিল?
জান্নাতুল নাঈম : আপনাদের সকলের দোয়া অনেক ভালো আছি।
একুশে টেলিভিশন : আমরা জানতে চাই আপনার সংগ্রামী জীবনের কথা। কীভাবে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন?
জান্নাতুল নাঈম : অনেক কষ্ট করেছি। একাই পথ চলেছি। আমি যেটাকে বিয়ে বলি না, সেই বিয়ের আসর থেকে আমি পালিয়েছি। এরপরই আমার সংগ্রাম শুরু। আজ সাফল্যের মুকুট পড়েও আমাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
একুশে টেলিভিশন : বিয়ের আসর থেকে সুন্দরীর মুকুট; মাঝে খানের সময়টা কেমন ছিল।
জান্নাতুল নাঈম : আমি ওখান থেকে পালিয়ে কক্সবাজার চলে যাই। সেখানে আমার খালা বাড়িতে ছিলাম। খালাই আমাকে তখন সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু আমার বাবা খালাকেও চাপ দেয়। যদি আমাকে খালার বাড়িতে রাখা হয় তাহলে তাদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবে না বলে বাবা হুমকি দেয়। তাই সেখান থেকে আমাকে চলে যেতে হয়। দুই বছর ছিলাম খালা বাড়ি। তখন আমি নিজে পড়ালেখা শুরু করি। আর টিউশন করে আয় করি। আমি এসএসসিতে ৪.৪৪ পেয়েছিলাম। এইচএসসিতে গোল্ডেন (এ+) পেয়েছি। কক্সবাজার থেকে চলে আসি চট্টগ্রামে। একাই থাকি। কিছুদিন পর ২০১৬ সালে চলে আসি ঢাকাতে। আমি ঢাকাতে দেড় বছর। একাই সাবলেট থাকা শুরু করি। এরপর ঢাকার সংগ্রাম শুরু হয়।
একুশে টেলিভিশন : ঢাকায় এসে নিজেকে তৈরি করা এবং মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার কথাগুলো যদি বলতেন?
জান্নাতুল নাঈম : আমি ভালো বাইক চালাতে পারি। ১৪ বছর বয়সে বাবার বাইকেই আমার হাতেখড়ি হয়। বাবা বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখতেন না। এরপর মামার কাছ থেকে বাইক চালানো শিখি। ঢাকায় আসার পর আমার মনের মধ্যে একটা ইচ্ছে জাগে আমি বাংলাদেশের হাইস্পিড লেডি বাইক রাইডার হতে চাই। সেই থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাই। আমার বাইক চালানোর ভিডিও ও ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের চিফ বিজনেসম্যান সুব্রত রঞ্জন দাস আমাকে খুঁজে বের করে কোম্পানিতে কাজ করার প্রস্তাব দেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, নারী বাইক রাইডারদের আইকন হিসেবে তারা কাজে লাগাতে চান। তার মাধ্যমেই হাইস্পিড বাইকের প্রতি নারীদের আগ্রহী করতে চান। প্রথমদিকে প্রস্তাবে রাজি না হলেও পরে নারীদের এগিয়ে নেয়ার চিন্তা থেকে ওই কোম্পানিতে কাজ শুরু করি। সুব্রত দাদার কাছে আমি অনেক অনেক কৃতজ্ঞ। এরপর একদিন দেখি মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার জন্য রেজিষ্ট্রেশন আহ্বান করা হয়েছে। আমি সুযোগটা কাজে লাগাই।
একুশে টেলিভিশন : যে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক, এই প্রতিযোগিতায় তো একটা নিয়ম আছে আপনি কেন তথ্য গোপন করলেন?
জান্নাতুল নাঈম : প্রতিযোগিতায় এ প্রসঙ্গটি কখনও আসেনি। তাছাড়া আমি নিজেকে কখনও ভাবিনি যে আমি বিবাহিতা। যেখানে বাংলাদেশের আইনে ১৬ বছরের নিচে বিয়ে হলে তা বিয়ে বলে গণ্য হবে না। সেখানে আমার এটাকে কেন আপনি বিয়ে বলবেন? আর প্রতিযোগিতায় শর্ত ছিল প্রতিযোগীকে সিঙ্গেল হতে হবে। আমিতো সিঙ্গেলই।
একুশে টেলিভিশন : যাহোক, এখন মুকুট হারিয়ে কেমন লাগছে?
জান্নাতুল নাঈম : আমার উদ্দেশ্য ছিল একটা ম্যাসেজ দেওয়া। আমি মনে করি সেই ম্যাসেজ দেওয়ার সময় আমার এসেছে। আমি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চাই। আলোচনা-সমালোচনা অনেক হয়েছে তাতে আমার মুকুট হারালেও দুঃখ নাই। কারণ আমার মুকুট আমি পেয়ে গেছি। অন্তত সবাই বুঝতে পেরেছে একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের মনের কষ্ট ও অনুভুতিগুলো কি হতে পারে। যারা আমার মত এই সমস্যার মুখে প্রতিনিয়ত পড়ছেন তারাতো কিছু বলতে পারে না। আমি তাদের হয়ে ম্যাসেজ পৌঁছে দিতে চাই।
বর্তমানে যাকে মুকুট দেওয়া হয়েছে সে অনেক ভালো মেয়ে। ও পারবে। ওর প্রতি আমার শুভ কামনা। যেন সে বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারে এটাই চাই।
একুশে টেলিভিশন : খুবই অল্প সময়ে আপনি কঠিন অবস্থা সামলে উঠতে পেরেছেন। সামনের দিনগুলো নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কি?
জান্নাতুল নাঈম : আমরা একটা টিম তৈরি করেছি। যে টিমটি আমাকে অনেক সাপোর্ট দিচ্ছে। আমরা বাল্যবিবাহ রুখতে কাজ করবো। ইতোমধ্যে আমি মিডিয়াতে কাজ করার জন্য অনেক ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে অফার পাচ্ছি। নিয়মিত কাজ করবো। আর সেই কাজ থেকে যে আয় হবে তার ৭৫% আমি আমার এই কাজে ব্যয় করবো। আমি বিজয়ী হওয়ার পর লাভেলোর সঙ্গে একটা চুক্তি হয়েছিল- আমার আয়ের একটা অংশ তাদের চ্যারিটি ফান্ডে জমা দিতে হবে। যেহেতু আমার মুকুট নিয়ে নেওয়া হয়েছে আমার সেই চুক্তিটা বাতিল হয়ে গেছে। এখন আমি স্বাধীনভাবে কাজ করবো। আর সেই আয় থেকে নির্ধারিত টাকা এ কাজে ব্যয় করা হবে।
একুশে টেলিভিশন : অনেকেই আপনাকে উৎসাহ দিচ্ছে। প্রেরণা দিচ্ছে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক কথা বলছে। তাদের উদ্দেশ্যে আপনি কি বলবেন?
জান্নাতুল নাঈম : আমি তাদের প্রতি অনেক অনেক কৃতজ্ঞ। যে সময়টাতে আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি ঠিক তখন মিডিয়ার অনেক মানুষ, সাংবাদিক ভাইয়েরা আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে এখনও দিচ্ছে তাদের কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ।
একুশে টেলিভিশন : কেউ কেউ আপনার বিরোধিতা করেছে সমালোচনা করেছে। হিউমার ছড়িয়েছে যে আপনি আত্মহত্যা করেছেন। তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চান?
জান্নাতুল নাঈম : আসলে কিছু বলার নাই। জান্নাতুল নাঈম এমন মেয়ে নয় যে সে ভেঙ্গে পড়বে। সে শত বিপদেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম। তার প্রমাণ আমি রেখেছি। কিছু হলুদ সাংবাদিকতার কারণে এমন হিউমার ছড়ায়। আমার ফ্যানদের জন্য বলবো আমি যে ম্যাসেজ দিতে এসেছি তা অব্যাহত থাকবে। আপনারা আমার পাশে থাকবেন।
একুশে টেলিভিশন : আপনার প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইনের পক্ষ থেকে শুভ কামনা।
জান্নাতুল নাঈম : একুশে টেলিভিশন অনলাইনকেও অনেক ধন্যবাদ।