ঢাকা, রবিবার   ১৬ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বিজিবি, র‍্যাব, এসএসএফ ও আনসার নিয়ে আমার যত অভিজ্ঞতা

জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূঁইয়া

প্রকাশিত : ১২:৩৭, ১৬ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বিজিবিতে ডেপুটেশনে যাওয়া অনেক অফিসার শেষ পর্যন্ত অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন। তবে সৌভাগ্যক্রমে বেশিরভাগ অফিসার এখনো তাঁদের নীতিবোধ অটুট রেখে চলেন। আগে সাধারণত পদোন্নতি-বঞ্চিত বা কম গুরুত্বপূর্ণ অফিসারদেরই সেখানে পাঠানো হতো। কিন্তু একসময় সবাই বুঝে যায়, বাহিনীটিকে ভালভাবে চালাতে যোগ্য অফিসারও দরকার। কিছুদিন সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। তবে মেজর জেনারেল (পরে জেনারেল ও সেনাপ্রধান) আজিজ দায়িত্ব নেওয়ার পর এবং পরবর্তীতে মেজর জেনারেল শাফিন আসায়, এসব অফিসার সত্যিকারের চাপের মুখে পড়েন।

তাছাড়া আনসারে কিছু সিনিয়র অফিসার পাঠানো হয় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য, কিন্তু মূল আনসার ক্যাডাররা এ নিয়ে প্রবল অসন্তোষ দেখায়। আগে সেখানে একটি বিদ্রোহ হয়েছিল, যেটি ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন কঠোর হস্তে দমন করে। অফিসারদের বিরুদ্ধে সাধারণত কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি—শুধু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। আমি যখন সেনাপ্রধান ছিলাম, তখন জানতে পারি যে ওই সময়ের ডিজির বিরুদ্ধে আনসারের নারী সদস্যদের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক এবং অত্যধিক দামে শটগান কেনার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু আমি কিছু করতে পারিনি, কারণ নিরাপত্তা উপদেষ্টার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কারণে তিনি কার্যত “আমার এখতিয়ারের বাইরে” ছিলেন।

যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দিত, তা ছিল র‍্যাব-এ প্রেষণে থাকা আমাদের অফিসারদের দ্বারা সাধারণ নাগরিক, রাজনৈতিক কর্মী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অপহরণ ও হত্যা। তরুণ, ক্যারিয়ারমুখী অফিসারদের র‍্যাবে পাঠানো হতো, সেখানে কিছুদিন কাজ করে তারা এমন এক চরিত্র নিয়ে ফিরত যেন তারা পেশাদার খুনি। একই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছিল জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও), নন-কমিশন্ড অফিসার (এনসিও) এবং সৈনিকদের মধ্যেও। আমি সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই প্রধানমন্ত্রীকে জানাই যে, পুলিশের সাথে মিশে কাজ করতে গিয়ে আমাদের অফিসাররা কীভাবে নৈতিক বিচ্যুতির শিকার হচ্ছেন। আমি চাইছিলাম তাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা হোক। প্রধানমন্ত্রী আমার কথায় সম্মতিসূচক ইঙ্গিত দিলেন, এমনকি বললেন র‍্যাব জাতীয় রক্ষীবাহিনী থেকেও খারাপ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বাস্তবে রূপ নেয়নি।

কয়েক দিন পর আমি কর্নেল (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও ডিজি এসএসএফ) মুজিবকে—যিনি তখন র‍্যাবের এডিজি (ADG) ছিলেন—ডেকে বলি যেন তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (এখন মেজর জেনারেল) জিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন এবং আর যেন কোনো “ক্রসফায়ার” না ঘটে। কর্নেল মুজিব এ ব্যাপারে আমাকে কথা দেন এবং বিদায় নেওয়ার সময় তাঁকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হয়। পরের কয়েক দিন পত্রপত্রিকা লক্ষ্য করলাম, নতুন কোনো ক্রসফায়ারের খবর নেই—এতে মানসিকভাবে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। এরপর কর্নেল মুজিব একাধিকবার আমাকে এসে জানিয়েছিলেন, সত্যিই ক্রসফায়ারের ঘটনা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পর আমি বুঝতে পারি ঘটনা ঠিকই ঘটছে কিন্তু সেগুলোর খবর চাপা দেয়া হচ্ছে। পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে যখন কর্নেল মুজিব র‍্যাব ছেড়ে অন্যত্র বদলি হয়ে যান, আর কর্নেল জিয়া—যিনি আগে র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার দায়িত্বে ছিলেন—নতুন ডিজি বেনজীর আসার সঙ্গে সঙ্গেই এডিজি র‍্যাব হিসেবে দায়িত্ব নেন।

এরপর আর্মি নিরাপত্তা ইউনিট (ASU) সূত্রে খবর পাই যে কর্নেল জিয়া নিজের আবাসিক টাওয়ারে একজন গার্ড রেখেছেন, বাসায় অস্ত্র রাখছেন এবং পুরো ফ্ল্যাটে সিসিটিভি বসিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বলা হয় গার্ড সরিয়ে নিতে, ক্যামেরাগুলো খুলে ফেলতে, বাসায় অস্ত্র রাখা থেকে বিরত থাকতে এবং অফিসিয়াল কোয়ার্টারে যে সামরিক নিয়ম-কানুন আছে, সেগুলো মেনে চলতে। পরবর্তীতে তাঁর আচরণ আরও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠে। ডাইরেক্টার মিলিটারি ইন্টালিজেন্স (DMI) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জগলুল তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতে কর্নেল জিয়া কোন কর্নপাত করেন নি। পরে আর্মি নিরাপত্তা ইউনিটের (ASU) কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজল তাঁকে আলাপের জন্য ডাকেন। পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজল আমাকে জানান, জিয়ার সাথে কথা বলতে গিয়ে মনে হয়েছে যেন সে এমন একজনের সাথে কথা বলছে যার মস্তিষ্ক পাথর বা ইটের টুকরো দিয়ে ঠাসা —বোঝানোর কোনো উপায় নেই।

এক পর্যায়ে, নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল তারেক সিদ্দিকী, এমএসপিএম (MSPM), আর তাঁর কোর্সমেট এএমএসপিএম(AMSPM) কর্নেল (এখন মেজর জেনারেল) মাহবুবের ঘনিষ্ঠতার সুবাদে কর্নেল জিয়া আমার নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করা শুরু করেন। আমার আর কোনো উপায় ছিল না—আমি তাঁকে রেললাইনের পশ্চিম পাশের ক্যান্টনমেন্টে “পারসোনা নন গ্রাটা” (PNG)/অবান্ছিত ঘোষণা করি। তবে পূর্ব পাশের আবাসনটিতে উনাকে থাকতে তাঁকে ছাড় দিয়েছিলাম। লজিস্টিকস এরিয়া কমান্ডার (LOG AREA COMD)মেজর জেনারেল মিজানকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে বলি (যার ফলস্বরূপ, আগে জানানো হয়নি বলে তাঁকেও নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিরাগভাজন হতে হয়েছিল)।

কর্নেল জিয়া পরিস্থিতির গুরুত্ব তখনই পুরোপুরি বুঝলেন, যখন মিলিটারি পুলিশ তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে সেনানিবাসের ভিতরে সিএমএইচে যাওয়ার পথে চেকপোস্টে আটকে দেয়। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই এমএসপিএম আমাকে ফোন করে জানতে চাইলেন, একজন চাকুরিরত অফিসারকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে কিনা, না এটা বিশেষ কোন পদক্ষেপ। আমি বললাম, “এটা ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা। যদি তুমিও চিফের আদেশ অমান্য কর, তাহলে তোমাকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হবে।” পরদিন তিনি আবার ফোন করে জিয়ার ওপর থেকে এই বিধি তুলে নেওয়ার অনুরোধ করলেন। এ ঘটনার পর কর্নেল জিয়া কিছুটা নিয়মের মধ্যে আসেন, বুঝতে পারেন তিনি এখনো সেনাবাহিনীর অধীনে আছেন। তবু আমি তাঁকে আমার অফিসে ঢুকতে দিইনি, কারণ জানতাম, তিনি শুধু এসে নিজের কাজের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিয়ে আমার সময় নষ্ট করবেন।

সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর, আমি নির্দেশ দিলাম—ডিজিএফআই, বিজিবি, কিংবা র‍্যাবে বদলি পেয়ে যারা যাচ্ছেন অথবা সেখান থেকে ফিরে আসছেন, সবাই যেন নতুন জায়গায় যোগ দেওয়ার আগে কিংবা সেখান থেকে ফেরার পর আমার সঙ্গে দেখা করে। মেজর জেনারেল আনোয়ার (এম এস - মিলিটারি সেক্রেটারি), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জগলুল (ডি এম আই - ডাইরেক্টর অব মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স) আর আমার পিএস লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদও তাঁদের ব্রিফ বা ডিব্রিফ করতেন। আমি বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করলাম, মাত্র বিশ-একুশ বছরের অফিসারদের এমনসব দায়িত্বে টেনে নেওয়া হয়েছে, যার সঙ্গে তাঁদের আসল সামরিক সেবার কোনোই মিল নেই। তাঁরা কী করছেন বা কেন করছেন—তা নিজেরাও স্পষ্ট জানতেননা। এটি ছিল বিএমএ(বাঙলাদেশ মিলিটারি একাডেমি) কর্তৃক ক‍্যাডেটদের ‘থিংকিং লিডার’ হিসাবে গড়ে তোলার সম্পূর্ণ ব্যর্থতা। এসব অফিসারের কাছে যখন নানান হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা শোনা শুরু করলাম, তখন সেনাবাহিনীর সামগ্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার মনে সংশয় জন্ম নিলো।

নতুনভাবে বদলী পাওয়া অফিসারদের আমি যথাসাধ্য বোঝানোর চেষ্টা করতাম, যেন তারা অমানবিক অপরাধে না জড়ায়। বলতাম—যারা শেখ মুজিব বা জিয়াকে হত্যা করেছে, কিংবা অস্ত্র পাচারে জড়িত ছিল, শেষ পর্যন্ত তারা ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করেছে। কারও হাত-পা বেঁধে তাকে হত্যা করাটা চরম কাপুরুষতা। সত্যিকারের সাহসিকতা হল শত্রুর হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে সামনাসামনি মোকাবিলা করা। কিন্তু কয়েক দিন পর ডিএমআই জানালেন, আমাদের এই চেষ্টা কোন কাজে আসছেনা। অফিসাররা র‍্যাবে নুতন কর্মস্থলে আসামাত্র জিয়া নাকি কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে তাদের ‘হত‍্যা করতে’ উৎসাহ দিচ্ছেন।

তবে এর মধ্যে ব্যতিক্রম যে ছিলনা তাও নয়। দুজন অফিসার, র‍্যাবে যোগ দেওয়ার প্রথম রাতেই হত্যার নির্দেশ পেয়ে তা অস্বীকার করেন এবং আদেশ না মেনে এমপি (মিলিটারি পুলিশ) চেকপোস্টে চলে আসেন। ডিএমআই বিষয়টি জানালে আমি তাঁদের সেনাবাহিনীতে সম্মানের সাথে পুনর্বাসিত করি।

একজন মেজর , যিনি আমি এসআই অ্যান্ড টিতে (SI&T) কমান্ডান্ট থাকাকালে স্পেশাল ওয়ারফেয়ার উইংয়ে প্রশিক্ষক ছিলেন, র‍্যাবে যোগ দেওয়ার পর সেনাভবনে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। জানতে পারি, তিনি রেডিসন হোটেলের এক কর্মীকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে সন্দেহভাজনদের ‘বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে’ জড়িয়ে পড়েছেন। আমি তাঁকে সাবধান করে দিই, যেন তিনি নিজ হাতে “বিচার” তুলে না নেন। তিনি বললেন, আর করবেন না। কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখি, তিনি নিজেই ফেসবুকে একটা ছবি পোস্ট করেছেন—সেখানে তিনি শাপলা চত্বরের ধোঁয়াটে পটভূমিতে জিয়ার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন।

একদিন সেনাপ্রধানের কার্যালয়ে বোমা আতঙ্ক দেখা দেয়। অফিসে কার্যরত সবাইকে তাদের অফিস থেকে বের করে দেয়া হয়। ডাইরেক্টর মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জগলুল বোমা-নির্নয় যন্ত্রপাতি সহ তার টিম নিয়ে দৌড়ে আসেন। পরবর্তী আধা ঘন্টা অফিসটিতে তন্ন তন্ন করে বোমা খোঁজা হয়। আমাদের ভাগ‍্য প্রসন্ন যে কোন বোমার অস্তিত্ব মেলেনি এবং একটা লম্বা অপেক্ষার পর বিল্ডিংটিকে বোমা মুক্ত ঘোষণা করা হয়। আমি জগলুলকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? জগলুল জানালেন তিনি তার এক অফিসার মেজর সুমনের কাছে জানতে পেরেছেন যে কর্নেল জিয়াকে আমাকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শুনে আমার মেরুদণ্ড দিয়ে একটি শীতল স্রোত বয়ে যায় এবং সিদ্ধান্ত নেই যে এখন থেকে আমাকে আরো বেশি সতর্ক থাকতে হবে- বিশেষ করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সময়। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জগলুলও আমার নিরাপত্তার জন‍্য অন‍্য‍ান‍্য আনুসঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বিশেষ করে প্রতি সকালে আমার অফিস ও বাসা পুংখানুপুংখ ভাবে সার্চ করার ব্যবস্থা করা হয় ।

আমি এরপর ফরমেশন অফিসারদের এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণার্থীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্যে এসব “অপারেশন বা ক্রসফায়ার”-এর বর্বরতা ও এতে জড়িতদের সম্ভাব্য পরিণাম সম্পর্কে সরাসরি বলতে শুরু করি। বিশেষ করে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে কোর্সে আসা অনেক অফিসারকে একসঙ্গে সতর্ক করার সুযোগ পাই। তবু দেশজুড়ে পত্রিকায় ক্রসফায়ারের খবর আসতে থাকায় আমি বিরক্ত হয়ে উঠি। এক পর্যায়ে সিদ্বান্ত নেই র‍্যাব , ডিজিএফআই আর বিজিবিতে আর কোনো অফিসারকে Posting দেবনা।

ডিজি বিজিবি মেজর জেনারেল আজিজ ও কর্নেল জিয়া প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে অভিযোগ করেন এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে বলেন। ডিজি ডিজিএফআই মেজর জেনারেল আকবর বারবার অনুরোধ করলে শেষ পর্যন্ত আমি নিজে একটি ১০-১২ জনের অফিসার দলের তালিকা তৈরি করে তাঁকে দিই। এদিকে কর্নেল জিয়া আরও ‘লবিং’ চালিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা, এমএসপিএম (MSPM), আর নিজের কোর্সমেট এএমএসপিএমের (AMSPM) সহায়তায় আমার ডিএমআইকে (DMI) অপসারণ করেন। কারণ তিনি ভাবতেন, ডিএমআই-ই আমাকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে। স্বাভাবিক নিয়মে সেনাপ্রধানই (CAS) ডিএমআই আর সিও এএসইউ (CO ASU) নিয়োগ দেন। কিন্তু আমার আপত্তি সত্ত্বেও ডিএমআইকে সরিয়ে দেওয়া হয়—যা আমাকে যথেষ্ট অপমানিত করে। তবে সিও এএসইউ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলকে (বর্তমানে নির্বাচন কমিশনার) আমার তীব্র বিরোধিতার মুখে সরাতে ব্যর্থ হয়।

পরবর্তিতে মিস্টার বেনজীর স্বয়ং আমার কাছে আসেন এবং র‍্যাব চালাতে আমার সহায়তা চান। কিন্তু আমি তাকে অফিসার দেয়ার কোনো নিশ্চয়তা দিইনি। এমএসপিএম আমাকে কয়েকবার ফোন করে জানান যে প্রধানমন্ত্রী র‍্যাব, বিজিবি আর ডিজিএফআইতে আরও অফিসার চাচ্ছেন। আমি আমার সিদ্বান্তে অনড় থাকি। চট্টগ্রামের হোটেল র‌েডিসন উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে আমাকে ডেকে বলেন, র‍্যাবে আরও জুনিয়র অফিসার বদলি দিতে। আমি বুঝিয়ে বলি, পিজিআর (PGR), এসএসএফ (SSF), ডিজিএফআই, বিজিবি—সবখানেই ইতিমধ্যে এত অফিসার দেয়া হয়েছে যে, এ মুহূর্তে অতিরিক্ত অফিসার দেওয়ার মতো অবস্থা সেনাবাহিনীর নেই। তিনি জোরাজুরি করলেও আমি আমার অবস্থানে শেষ পর্যন্ত অটল থাকি।

আজকে আমরা এমন একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছি যে র‍্যাব সম্পর্কে জরুরি সিদ্ধান্ত নেয়া বান্ছনীয়। আমি সেনাপ্রধানকে অনুরোধ করবো যেন তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে ভেঙে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেন। সেটি সম্ভব না হলে সামরিক অফিসারদের র‍্যাব থেকে যেন স্হায়ীভাবে প্রত্যাহার করে নিয়ে আসেন। এটি করার জন‍্য বর্তমান সেনাপ্রধানের যে স্বাধীনতা তৈরি হয়েছে আগের কোনো সেনাপ্রধানের তা ছিলনা। তার এই নতুন লব্দ অবস্থানের জন্যই তাকে অনুরোধ করছি তিনি যেন আমরা যে কাজটি করতে পারিনি সেটি সম্পন্ন করেন।

গাড়িতে ভ্রমণ করার সময়, আমার এডিসি (ADC) পাশের সিটে বসতেন। একবার আমার প্রথম এডিসি, ক্যাপ্টেন (এখন কর্নেল) তৌহিদ জানালেন—এখনকার অনেক তরুণ অফিসার ইচ্ছে করে কোর্সে বেশি নম্বর পেতে চান না। কারণ শীর্ষস্থান (A বা A+) পেলে তাঁদের পোস্টিং হয় এডিসি হিসেবে, অথবা ব্রিগেড/ডিভিশন সদর দপ্তরে স্টাফ অফিসার হিসেবে বা বিএমএ/এসআইঅ্যান্ডটি-তে প্রশিক্ষক হিসেবে—যেগুলোতে ভবিষ্যতের উন্নতির তেমন সুযোগ থাকে না। কিন্তু একটা “ভালো মানের বি” পেলে এসএসএফ, র‍্যাব, ডিজিএফআই বা এ-জাতীয় সংস্থায় পদ পাওয়া যায়, যেখানে পদোন্নতির সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল। আমি এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সেই উচ্চ-প্রোফাইল পোস্টিংগুলোর চাকচিক্য, তুলনামূলক স্বাধীনতা এবং ক্যারিয়ারের সুযোগ অনেককে আকর্ষন করতো। এসএসএফ-ই এত বেশি জুনিয়র অফিসার নিয়ে নিত যে এমএস শাখা (MS Branch) অন‍্যান‍্যদের চাহিদা মেটাতে গলদঘর্ম হত। SSF-এ কাজ করার সময় তাঁরা নানা বিতর্কিত লোকজনের সংস্পর্শে আসত এবং এতে তাঁদের রেজিমেন্টাল মানসিকতার কিছুটা হলেও ক্ষয় হতো। আমার দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল, যখন শুনলাম এসএসএফের একজন অফিসার—মেজর রবি—এসএসএফ আর পিজিআরের অফিসারদের উৎসাহ দিচ্ছেন একজন “মিস্টার নবি”-র কাছে টাকা বিনিয়োগ করতে, যিনি শেয়ারবাজারে লাভজনক মুনাফার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন। এতে ডিজি এসএসএফ মেজর জেনারেল মিয়া জয়নুল আবেদিন যুক্ত ছিলেন বলে কানে আসে এবং মনে হয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাও বিষয়টি জানতেন। পরে আমার পুরনো ইউনিটের একজন অফিসার, আমাকে জানান, যাঁরা এই বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁরা মুনাফা বা লভ্যাংশ দূরের কথা, আসল টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না—কারণ শেয়ারবাজারে ধ্বস নেমেছে। তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তা উপদেষ্টা তাঁকে ডিজিএফআই আর র‍্যাব ব্যবহার করে এই টাকা উদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছেন। আমি তাঁকে সাবধানে ও নিজের বিবেচনা অনুযায়ী এগোতে বললাম। অল্প কিছুদিন পর মিস্টার নবি-র সন্দেহজনক মৃত্যু সারা দেশের সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়।

ডিজি-রা তাঁদের ক্ষমতা ব্যবহার করে বেনিফিট পেতেন। একজনের স্ত্রী একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন, যিনি ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্ধ করতেন ওখানে বিনিয়োগ করতে। আরেকজন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালেয় থেকেই অবৈধ ভিওআইপি (VOIP) চালাতেন। প্রধানমন্ত্রীকে আমি দেখালাম, কী পরিমাণ ফোনকল—মাসে প্রায় এক মিলিয়ন—এসএসএফ লাইনের মাধ্যমে বেরিয়ে যাচ্ছে। তিনি খুব অবাক হয়ে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদকে তদন্ত করতে বলেন। পরেরবার ওনার সাথে দেখা হলে তিনি আমাকে জানান, তদন্তে অভিযোগগুলো সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

লেখক: জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূঁইয়া, সাবেক সেনাপ্রধান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

এএইচ


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি