ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

বিদেশি গাছের প্রতারণা!

কাজী ইফতেখারুল আলম

প্রকাশিত : ১৮:৪৬, ২৫ জুলাই ২০২৩ | আপডেট: ১৮:৫৩, ২৫ জুলাই ২০২৩

‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান।’ গাছ রোপনের এখনই উপযুক্ত সময়। দিন দিন বিদেশি গাছের কদর বাড়ছে। সাম্প্রতিককালে বিদেশি চারা রোপণের জন্য নানান প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এই মুখরোচক প্রচারে কান দিয়ে অনেকেই অধিক লাভের আশায় বিদেশি গাছ বাছাই করে তা রোপন করে পরিবেশের ক্ষতি সাধন করেন অজান্তেই। এসব চারা থেকে কাঙ্ক্ষিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সুফল পাচ্ছে না খামারিরা। এক শ্রেণির সিন্ডিকেট এর কবলে পরে এসব বিদেশি গাছের চারা কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।   

এসব বিদেশি গাছের চারা পরিহার করে দেশিয় গাছ কেনে পরিবেশ রক্ষার আহবান জানিয়েছেন পরিবেশ বন্ধু সাখাওয়াত উল্লাহ। 

এ বিষয়ে তাঁর সচেতন মূলক একটি পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরেছে। 
ফেসবুক পোস্ট-  আমাদেরকে অনেকেই বলেন, 'আমাকে একটা ভালো জাতের ভিয়েতনামী নারকেল গাছ দাও, একটা এভোকাডো দাও, উন্নত জাতের আমের চারা দাও। কেউ আবার মদীনার খোরমা খেজুরের চারা আবদার করেন, কারো লাগবে সাদাজাম (শ্বেতরোগীর মতো কুৎসিত সাদা বিদেশি জাম) ইত্যাদি ইত্যাদি।' 

অনেকেই আবার টাকা অফার করেন। আমরা সবসময়ই বলি আমরা বৃক্ষরোপণে সহযোগিতা চাই তবে সেটা আর্থিক নয়। বিদেশি জাতের ফলের এক প্রকার বিরোধী আমরা। শুধুমাত্র মানুষের শখের প্রতি সম্মান জানিয়ে কিচ্ছু বলি না।

ভিয়েতনামি নারকেলের ব্যাপারে আমরা সবাইকে সচেতন করি। সবাই মনে করেন গাছ রোপন করলেন আর চোখ বন্ধ করলেন এরই মধ্যে দেখলেন শতশত নারিকেল ধরে আছে। ব্যাপারটা এমন নয়। ভিয়েতনামি হাইব্রিড নারকেলের জন্য অনেক পরিশ্রম দরকার। এন্টিবায়োটিকের মতো নিয়ম করে ঔষধ প্রয়োগ দরকার। ড্রাগন ফলের গাছে দশ মণ সার দিলেও সে খেয়ে ফেলবে। এতো এতো রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে উৎপাদিত ফলের খাদ্যমান নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। 

বিদেশি সকল ফল দেখতে সুন্দর, উৎপাদন কঠিন। তাই জেনে-বুঝে কাজে নামা উচিত। আর দেশিয় ফল আল্লাহ তায়ালার অশেষ দান। রোপণ করলেই হলো। বছরের পর বছর ফল দিতেই থাকবে। আর গাব, ডেউয়ার মতো ফল কেউ রোপনও করে না। বীজ পড়ে চারা হয়। চারা অযত্নে বড় হয়ে রাগ অভিমান ছাড়া ফল দেয়। আসুন, দেশিয় প্রজাতির গাছ লাগাই।। 

ইদানিংকালে বিদেশি চারায় সর্বস্বান্ত হয়েছে অনেকেই। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ঘোড়শাল ইউনিয়নের নারকেলবাড়িয়া গ্রামের সফল খামারি মোখলেসুর রহমান। তিনি কৃষি বিভাগের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০১৬ সালে ভিয়েতনামের খাটো জাতের নারকেল চারা কেনেন। প্রতিটি ৫০০ টাকা করে ২০০ চারা কিনে আড়াই বিঘা জমিতে লাগিয়েছেন। রোপণসহ প্রতিটি গাছের পেছনে তার খরচ হয়েছে ১ হাজার টাকা করে। সব মিলিয়ে এই সাত বছরে বিনিয়োগ করেছেন ১০ লাখ টাকার
বেশি। কিন্তু একটি টাকাও তিনি ফেরত পাননি।

তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘কৃষি বিভাগ থেকে বলা হয়েছিল আড়াই থেকে তিন বছরে নারকেল ধরবে। মাটিতে দাঁড়িয়েই ফল ছেঁড়া যাবে। গাছ ঠিকই বড় হয়েছে। মোচাও বেরিয়েছে। কিন্তু নারকেল হয়নি। আর গাছগুলো পোকায় ধরার পর অনেকগুলোই কেটে ফেলেছি। কিন্তু খামারজুড়ে পোকা ছড়িয়ে গেছে। আমি খাটো জাতের নারকেলগাছ লাগিয়ে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছি।’

শুধু খাটো জাতের নারকেলই নয়, সৌদি খেজুর, মিয়াজাকি আম, ত্বীন ফল, টক আতা, চায়না কমলা, আনারসহ অসংখ্য বিদেশি ফলের বাগান করে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন কৃষক ও খামারিরা। অথচ এই চারার বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের দেশে-বিদেশি ফলের মধ্যে থাই পেয়ারা, বারি মাল্টা-১, ড্রাগন, স্ট্রবেরি ও কয়েক জাতের আম বাণিজ্যিক সফলতা পেয়েছে। তবে খাটো জাতের নারকেল, চায়না কমলাসহ কিছু ফলে আমরা সফলতা পাইনি। এখন এসব চাষে আমরা কৃষকদের নিরুৎসাহিত করছি।’

বিদেশি ফলের চারা দেশে আনতে হলে আগে যথেষ্ট পরিমাণে গবেষণার প্রয়োজন। গবেষণার ফলাফল ভালো হলে সেই চারা বাণিজ্যিকভাবে চাষ হতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে কোনো ধরনের গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ফলের চারা আনা হচ্ছে। এরপর ওই চারার বিষয়ে খামারবাড়িতে কর্মরত একজন কৃষি কর্মকর্তা পরিচালিত একটি ইউটিউব চ্যানেলসহ আরও কিছু মাধ্যমে সফলতার প্রচার করা হচ্ছে। এরপর বেসরকারিভাবেও বিদেশি চারা আমদানির দ্বার উন্মুক্ত করা হচ্ছে। এতে সিন্ডিকেটে জড়িত কিছু ব্যবসায়ী ফলের চারা আমদানি করছেন। ফলে খামারিরা উদ্বুদ্ধ হয়ে চড়া দামে চারা কিনে বিদেশি ফলের বাগান করছেন। কিন্তু বড় ধরনের বিনিয়োগ করে বেশিরভাগ খামারিই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। আর এই বিদেশি গাছের পোকা-মাকড় দেশি অন্যান্য ফলের গাছও নষ্ট করে দিচ্ছে।

নাটোর সদরের সফল খামারি সেলিম রেজা সম্প্রতি তার পুরো বাগানের ১০৭টি খাটো জাতের নারকেলগাছ কেটে ফেলে আলোচনায় এসেছেন।

তিনি বলেন, ‘কৃষি বিভাগের প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি প্রতিটি ৫০০ টাকা হিসেবে ১২০টি চারা কিনি। এর মধ্যে ১৩টি আত্মীয়স্বজনকে উপহার দিয়েছি। বাকি ১০৭টি আমার খামারে লাগাই। প্রায় ছয়-সাত বছর সব ধরনের যত্ন নেওয়ার পরও ফল ধরেনি। পরে রাগ করে সব গাছ কেটে ফেলেছি।’

এক খামারি নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, ‘আমি ভিয়েতনামে দেখেছি খাটো জাতের নারকেল চারার দাম ৮০ থেকে ১২০ টাকা। আর যদি আমরা পরিবহন খরচ ধরি, তাহলে ২০০ টাকার বেশি একটি চারার দাম পড়ার কথা নয়। অথচ ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ প্রকল্পের মাধ্যমে সাড়ে সাত লাখ চারা আনা হয়েছে। সেগুলো দেশে আনা পর্যন্ত খরচ দেখানো হয়েছে ৫১৭ টাকা। আর ১৭ টাকা সরকার ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের কাছে ৫০০ টাকা করে চারা বিক্রি করেছে। এখানেও বড় ধরনের লুটপাট হয়েছে। এর বাইরে ওই সিন্ডিকেট বেসরকারিভাবেও লাখ লাখ চারা এনেছে।’

ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার শিবগঞ্জে ২০১৮ সালে ৫০টি সৌদি খেজুরের গাছ লাগান। এর প্রতিটি গাছের চারা তিনি ৯ হাজার টাকা করে কেনেন। তবে ইতিমধ্যে মারা গেছে ১০টি। গত বছর কিছু গাছে ফল এলেও বড় হওয়ার আগেই তা ঝরে যায়। গাছও পোকায় ধরেছে। ইতিমধ্যে কিছু গাছ কেটেও ফেলা হয়েছে।

কালিগঞ্জ উপজেলার তিলেচংপুর ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের আসাদ শেখ লাগিয়েছেন চায়না কমলা। তার গাছগুলোতে একবারে হলদে কমলা ধরে আছে। কিন্তু দেখতে সুন্দর হলেও এতে রস নেই। তেতো স্বাদ, বিচি বেশি। যারাই খেয়েছেন, তারাই গালাগাল করেছেন। আসাদ শেখ বেশ কয়েকবার ফলগুলো বিক্রির উদ্যোগ নিলেও বিক্রি করতে পারেননি। এখন গাছগুলো কেটে ফেলছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের খামারি আকবর হোসেন ১ হাজার ২০০ খাটো জাতের নারকেলগাছ লাগিয়ে মহাবিপদে পড়েছেন। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে পাঁচ-ছয় বছর যত্ন আত্তি করলেও তাতে ফল ধরছে না। দু-একটি গাছে ফল এলেও ডাবগুলো বড়ই হচ্ছে না।

ফিলিপাইন থেকে আনা এমডি-২ জাতের আনারসের সফলতার গল্প বেশ জোরেশোরে প্রচার হলেও মাঠপর্যায়ের চিত্র ভিন্ন। এই আনারসে চোখগুলো বেশি গভীরে না থাকায় সহজে কাটা যায়। তবে বাংলাদেশের আনারসের মতো এই আনারস মিষ্টি ও সুস্বাদু নয়। আর অনেক কৃষকই এই আনারসের চাষ করলেও কারও চারা মরে যাচ্ছে আবার কারও ফল আসছে না। 

এভাবে ত্বীন ফলের চারা আনা হচ্ছে জর্ডান ও মিসর থেকে। প্রতিটি চারা তিন হাজার টাকা বিক্রি করা হলেও তাতে যে ফল আসছে তা খাওয়া যাচ্ছে না। টক আতা নামে একটি বিদেশি ফলের চারা বিক্রি করা হচ্ছে ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবে। প্রতিটি চারা বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার টাকার ওপরে। কিন্তু এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এভাবে মাল্টা, আনারের চারা আনা হচ্ছে মিসর, দার্জিলিং থেকে। কিন্তু বেশিরভাগ বাগানে ফল এলেও তা মুখে দেওয়া যাচ্ছে। ফলের ভেতরটা সাদা, রস নেই।

বিদেশি চারার পরিবেশ গত তারতম্য রয়েছে। এসব চারা এখানে আনার আগে আরও গবেষণার দরকার রয়েছে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। এক শ্রেণির সিন্ডিকেট এর কবলে পরে বিদেশি চারা কেনা থেকে সতর্ক থাকতে বলেছেন পরিবেশ সংশ্লিষ্ট মহল। তাই আসুন দেশিয় গাছ লাগাই, পরিবেশ বাঁচাই। আমাদের সকলের শ্লোগান হোক ‘বৃক্ষপ্রাণে প্রকৃতি-প্রতিবেশ, আগামী প্রজন্মের টেকসই বাংলাদেশ’ । 
কেআই//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি