বিদেশে পড়তে যাওয়ার আগে জরুরি সতর্কতা
প্রকাশিত : ১১:২৫, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩
উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার ইচ্ছা অনেকেরই থাকে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা আর প্রস্তুতিকৌশল না জানার কারণে সুযোগ হারান অনেকেই। তাই বিদেশে পড়তে যাওয়ার যেসব পূর্বপ্রস্তুতি, কৌশল ও সতর্কতা অবলম্বন অত্যন্ত জরুরি, সেসব নিয়েই আজকের এই আলোচনা।
পড়ার বিষয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচন
বিদেশে পড়ার আগ্রহ থাকলে এসএসসি/ও-লেভেল পরীক্ষার পর থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করা উচিত। সে ক্ষেত্রে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কোন বিষয়ে পড়তে আগ্রহী, তা ঠিক করে নেওয়া জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটে ভর্তিসংক্রান্ত সব তথ্য সহজ ভাষায় লেখা থাকে। তাই ইন্টারনেটের মাধ্যমে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা নির্ধারণ করে ফেলা গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
যোগ্যতা প্রমাণের কিছু পরীক্ষা
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য যোগ্যতা যাচাইয়ের কিছু পরীক্ষায় অংশ নিন। এর মধ্যে যেমন রয়েছে জিআরই, জিম্যাট বা ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা প্রমাণের জন্য টোফেল বা আইইএলটিএস। জিআরই বা জিম্যাটে ভালো করলে ভর্তি বা ভর্তির সঙ্গে স্কলারশিপ পেতে সুবিধা হয়। স্নাতক পর্যায়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য যাদের প্রথম পছন্দ যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডা, স্যাট তাঁদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা। প্রধানত, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য আইইএলটিএস অপরিহার্য ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর আমেরিকা, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ পরীক্ষার স্কোর চাইছে। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইইএলটিএস চায়।
পরীক্ষার প্রস্তুতি
স্যাট পরীক্ষায় গণিত, ক্রিটিক্যাল রিডিং ও রাইটিং বিভাগে পরীক্ষা দিতে হয়। স্যাটে গণিত একটু সহজ হলেও ইংরেজির অংশ কিছুটা কঠিন। ইংরেজিতে ভালো করতে নিয়মিত ইংরেজি অনুশীলন, প্রচুর শব্দ শেখা আর ইংরেজি বই পড়তে হবে। পরীক্ষার নিবন্ধনের জন্য স্যাটের অফিশিয়াল সাইটে নাম নিবন্ধন করে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পরীক্ষার ফি জমা দেওয়া যায়।
টোফেলের সব তথ্য অনলাইনেই পাওয়া যায়। প্রতি মাসেই টোফেল পরীক্ষা দেওয়া যায়। এ পরীক্ষায় চারটি ভাগ আছে: রিডিং, রাইটিং, লিসেনিং ও স্পিকিং।
বাংলাদেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল ও আইডিপির আয়োজনে আইইএলটিএস পরীক্ষা দেওয়া যায়। প্রতি মাসে সাধারণত তিনবার পরীক্ষা নেওয়া হয়। ওয়েবসাইটে অথবা ফোন করে পরীক্ষার তারিখ জেনে নিতে পারেন। দুই সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়।
কোন সেশনে আবেদন করবেন
কোন সময়টায় ভর্তির জন্য আবেদন করবেন, সে বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ দেশে ফল সেশন শুরু হয় আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে। এই সময়ই বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির আবেদন করে। আবার এই সেশনেই শিক্ষাবৃত্তি বা অর্থায়নের সুযোগও পাওয়া যায় বেশি। আর অন্যটা হলো গ্রীষ্মকালীন সেশন। এ সময় স্থানীয় শিক্ষার্থীদের বেশি সুযোগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
আবেদনের জন্য কাগজপত্র তৈরি
স্কুল/কলেজ থেকে প্রশংসাপত্র, সনদ ও নম্বরপত্র তুলতে হবে। অল্প কথায় নিজেকে নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখতে হবে। আপনার লেখা নিবন্ধ পড়ে যেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বোঝে যে আপনি মানুষ হিসেবে কেমন। আপনার যদি ছবি আঁকতে, ফুটবল বা ক্রিকেট খেলতে ভালো লাগে, সেটাও নিবন্ধে লিখবেন। সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দারুণ গুরুত্ব দেয়।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভর্তির জন্য আবেদন করতে হয়। এমআইটির জন্য MyMit (https://my.mit.edu/uaweb/login.htm)–এ একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে হয় আর যুক্তরাষ্ট্রের বাকি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অ্যাকাউন্ট খুলতে হয় এই ঠিকানায়: Common Application (www.commonapp.org/Login)। কেমব্রিজ, অক্সফোর্ডসহ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির জন্য (www.ucas.com) করতে হয় আলাদা আলাদা আবেদন।
বিশ্ববিদ্যালয়, বিভাগ আর সেশন ঠিক করা
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করার ধরন ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে একটু আলাদা। দেশের বাইরে পড়ালেখার পরিকল্পনা থাকলে তাই আগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়গুলো সম্পর্কে ‘গুগল’ করে বিস্তারিত জেনে নিন। আবেদনের শেষ দিন, কী কী কাগজপত্র পাঠাতে হবে, খরচ কেমন...জেনে, বুঝে নিন, কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন বিষয়টি আপনার জন্য মানানসই। সাধারণত মার্চ ও অক্টোবর মাসের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করতে হয়। কয়েকটি সেশনে ভর্তি করা হয়, এ ক্ষেত্রে কোন সেশনে ভর্তি হতে চান, সে পরিকল্পনাও করে ফেলুন।
মূল সনদ সংগ্রহ করা
শিক্ষা বোর্ড বা কলেজ থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মূল নম্বরপত্র ও সনদ সংগ্রহ করে রাখুন। স্নাতকোত্তরে আবেদনের জন্য অনার্সের নম্বরপত্র আর সনদ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হবে। ইউরোপ-আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়-নির্ধারিত খামে সনদ পাঠাতে হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
পাসপোর্ট রেডি রাখা
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদনের সময় অনেক ক্ষেত্রে পাসপোর্ট নম্বর প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া স্যাট, জিআরই, জিম্যাট, আইইএলটিএস, টোয়েফল পরীক্ষা দিতে পাসপোর্ট কাজে লাগে। পাসপোর্ট না থাকলে তৈরি করে ফেলতে হবে কিংবা মেয়াদ ছয় মাসের কম হলে নতুন করে বানাতে হবে। পাসপোর্টে নামের বানান যেন মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক সনদের মতোই হয়। বানানের গরমিলের কারণে অনেকেই ভর্তি বা বৃত্তির আবেদন করতে পারেন না।
এলওআর, এসওপি, এলওআই তৈরি করা
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে এলওআর, এসওপি ও এলওআই শব্দগুলো খুব পরিচিত। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা একাডেমিক ক্ষেত্রে খুব আলোচিত ব্যক্তির কাছ থেকে ‘লেটার অব রিকমেন্ডেশন’ বা এলওআর সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এলওআরের নির্দিষ্ট ধরন থাকে, যা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করে নেওয়া যায়। যে বিষয়ে বা বিভাগে আবেদন করবেন তা কেন আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সম্ভাব্য গবেষণার বিষয়, কীভাবে গবেষণা করতে চান, কিসে আগ্রহ—এসব নিয়ে ‘স্টেটমেন্ট অব পারপাস’ বা এসওপি এবং ‘লেটার অব ইন্টারেস্ট’ বা এলওআই লিখতে হয়। এই দুটি পত্র লেখার সময় শতভাগ নিজের মতো লিখতে হবে। অন্য কোথাও থেকে ‘কাট-কপি-পেস্ট’ কোনোভাবেই করা যাবে না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নিজের ভাষায় এই পত্র লিখতে হয়। যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা হবে তার জন্য আলাদা আলাদা এলওআর, এসওপি ও এলওআই তৈরি করতে হবে।
অন্যান্য সনদ সংগ্রহ করা
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আবেদনের সময় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজের অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার ও অংশগ্রহণের সনদ বেশ গুরুত্বের চোখে দেখা হয়। এ ধরনের সনদ আবেদনের সঙ্গে জমা দিতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন পাঠানো
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের শেষ তারিখের প্রায় ২০-২৫ দিন আগেই আবেদনপত্র কুরিয়ারে পাঠাতে হয়। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে আবেদনপত্র পাঠাতে একেক সময় লাগে, এ ক্ষেত্রে হাতে সময় নিয়ে কুরিয়ার করতে হবে। করোনাকালে এ সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে। তাই সতর্ক থাকা উচিত। জমা দেওয়ার তারিখের পরে আবেদনপত্র পৌঁছালে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা গ্রহণ করা হয় না।
সনদ সত্যায়িত করা
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের সঙ্গে মূল সনদের সত্যায়িত কপি জমা দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে সনদ সত্যায়িত করতে হবে। ভুয়া কিংবা নকল সত্যায়ন করলে ভর্তি-প্রক্রিয়া যেকোনো সময় আটকে যেতে পারে।
দূতাবাসে খোঁজখবর নেওয়া
বিভিন্ন দেশে পড়ার জন্য বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাস থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য তথ্য পাওয়ার সুযোগ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আমেরিকান সেন্টার, যুক্তরাজ্যে পড়ার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল, জার্মানির জন্য গ্যেটে ইনস্টিটিউটসহ ওয়েবসাইট থেকে বৃত্তি এবং ফেলোশিপের তথ্য পাওয়া যাবে।
নেটওয়ার্কিং
বিদেশে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে নেটওয়ার্কিং করা বেশ জরুরি। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে চান সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সংগঠনসহ ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে তথ্য-সহযোগিতা নিতে পারেন।
এনএস//
আরও পড়ুন