বিনিয়োগ বাড়ানোর এখনই সময় : কাজী অামিনুল ইসলাম (ভিডিও)
প্রকাশিত : ১৮:৩৭, ১৭ জুলাই ২০১৮
কাজী মো. আমিনুল ইসলাম
অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। যদিও বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলোতে প্রচুর অর্থ পড়ে রয়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে এখনও ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ মনে করছেন না। পাশাপাশি বিদ্যুৎ সমস্যা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, গ্যাসের অনিশ্চয়তাও এই খাতের বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। দেশের বিনিয়োগ নিয়ে একুশে টেলিভিশনের সঙ্গে কথা বলেছেন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান । নিম্নে তা তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, গত ৯ বছর ধরে এ খাতে বিনিয়োগের চাকা আটকে আছে একই স্থানে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। বর্তমানে সেই বিনিয়োগ মাত্র দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২২ দশমিক ০৭ শতাংশ। ২০০৮-০৯ সালে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ২১.৮৭ শতাংশ, ২০০৯-১০ সালে ২১.৫৬ শতাংশ, ২০১০-১১ সালে ২২.১৪ শতাংশ, ২০১১-১২ সালে ২২.৫০ শতাংশ, ২০১২-১৩ সালে ২১.৭৫, ২০১৩-১৪ সালে ২২.০৩ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপির ২২.০৭ শতাংশ, ২০১৬-১৭ সালে ২২.৭৮ শতাংশ, ২০১৭-১৮ সালে ২২.৮৯ হয়েছে।
বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়ার কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারও ৬ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। স্বাধীনতার পর প্রতি দশকে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ হারে বাড়লেও বিনিয়োগ স্থবিরতায় গেলো ১২ বছর ধরে দেশের গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ঘরেই। অবশ্য ২০০৬-২০০৭ অর্থ বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ হয়েছিল। কিন্তু ২০০৮-২০০৯ এবং ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ঘরে নেমে গিয়েছিল।
আর বিনিয়োগ না হওয়ায় এ খাতে নতুন কর্মসংস্থানও কমে আসছে আশঙ্কাজনক হারে। শুধু তাই নয়, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহও সন্তোষজনক অবস্থায় নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ১৬ শতাংশের বেশি ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও সেটি অর্জিত হচ্ছে না।
গত ৯ বছরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লেও সরকারি খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে ৩ শতাংশেরও বেশি। সরকার গত কয়েক বছর ধরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকারও বাড়িয়েছে। এর ফলে ২০০৮-০৯ সময়ে জিডিপিতে সরকারি বিনিয়োগ ছিল ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ, আর এখন সেটি হয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। যদিও সরকারি বিনিয়োগের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংক।
অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগে গতি আসে। কিন্তু গত কয়েক বছরে সরকারি বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বাড়ানোর পরও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২২ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে। শুধু তাই নয়, বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে না। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এখন বিনিয়োগের হার প্রায় ২৯ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশের যে মাথাপিছু আয়, সে অনুযায়ী এ দেশে বিনিয়োগের হার হওয়া উচিৎ ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৫ অনুযায়ী, দেশে এখন বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে বিনিয়োগের হার ছিল ২৮ দশমিক ২৬ শতাংশ। চার বছরে বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র পৌঁনে ১ শতাংশ।
কেবল বিনিয়োগের অভাবে এই ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ফাঁদ থেকে বের হতে পারছে না বাংলাদেশ। এই বিনিয়োগ না হওয়ার পেছনে অবকাঠামো, গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যার পাশাপাশি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও অনেকাংশে দায়ী। এখন কোনও উদ্যোক্তা সাহস করে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না। তাই ঋণের চাহিদা না বাড়ায় ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বাড়েনি। তা ছাড়া অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে রাতারাতি সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে না। তিনি বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিও হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে এই খাতে ১৬ শতাংশের বেশি ঋণ প্রবাহের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৩ শতাংশের একটু ওপরে।
প্রসঙ্গত, ২০১০-১১ অর্থবছরেও বেসরকারি খাতে ঋণ নেওয়ার প্রবৃদ্ধি ছিল ২৪ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক এই অর্থবছরে বেসরকারি খাতের জন্য এবার ঋণ সরবরাহে ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঠিক করেছিল। কিন্তু গত অক্টোবর পর্যন্ত বেসরকারি খাত ঋণ নিয়েছে ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ।
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়ার কারণে হিসাবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, শিল্পে গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আসছেন না।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিএনপি সরকারের শেষ সময় ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগের হার ছিল ২৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ছিল ৬ শতাংশ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর পরের দুই অর্থবছর, অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে মোট বিনিয়োগ কমে যায়। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ছিল সাড়ে ২৪ শতাংশ এবং ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। এ সময়ে সরকারি বিনিয়োগ সাড়ে ৫ শতাংশ থেকে কমে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হয়। আর বেসরকারি বিনিয়োগ ১৯ শতাংশ থেকে সামান্য বেড়ে হয়েছিল ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ।
নানা সমস্যার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। আর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে জিডিপি প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মস্থানের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যেটা কারোরই কাম্য হতে পারে না। বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না। প্রতিবছর ২০ লাখ নতুন শ্রমশক্তি শ্রম বাজারে ঢুকছে। এদের মধ্যে ১০ লাখ বেসরকারি খাতে যুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু বিনিয়োগ না বাড়ায় বেকারত্বের হার বাড়ছে। একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রধান ভূমিকা রাখে মূলত বেসরকারি খাত। এই কারণে এই খাতকে এগিয়ে নেওয়া জরুরি। সেজন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়ানোর সময়টা এখন।
অা অা/ এসএইচ/
আরও পড়ুন