ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

বিমানের লন্ডন দুর্নীতি

প্রকাশিত : ২৩:০৫, ৩০ এপ্রিল ২০১৯ | আপডেট: ১২:০৩, ১৬ মে ২০১৯

বঙ্গবন্ধুর হাতে শুরু হওয়া বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছর ধরে আলোচনা সমালোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছে রাষ্ট্রয়াত্ত এই প্রতিষ্ঠান। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারণেই মূলত বিমানের এই দশা। কয়েক বছর আগে বিদেশী এমডি নিয়োগ করে প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিমানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের রোষানলে পড়ে অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং দক্ষ ঐ এমডি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিমানের এই দুষ্টচক্রের কাছে অতীতে মন্ত্রীরা পর্যন্ত অসহায় হয়ে পড়েছিলেন।

বর্তমানে বিমানের দুই কর্মকর্তাকে দুর্নীতির অভিযোগে ওএসডি করা হয়েছে। তারা হলেন বিমানের সদ্য বিদায়ী যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম এবং বিপণন ও বিক্রয় শাখার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আশরাফুল আলম। এদের বিরুদ্ধে টিকেট বিক্রি এবং কার্গো পরিবহনে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কার্গো খাতে ৪১২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।

তদন্তে দেখা গেছে কার্গোখাতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে লন্ডনে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লন্ডনে জেএমজি ট্রাভেল নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে একচেটিয়ে ব্যবসা করার সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এজন্য কার্গো এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অথচ গ্লোবাল এয়ার নামের একটি কোম্পানী যখন ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত কার্গো এজেন্টের দায়িত্ব পালন করেছে তখন বিমানের আয় হয়েছে ২৫ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে যখন জেএমজি ট্রাভেলকে কার্গো এজেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয় তখন পরবর্তী ছয় মাসে আয় হয়েছে ২২ লাখ টাকা। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটি এক সময় কার্গো এজেন্ট হওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা তদবির করেও হতে পারেনি।

লন্ডনে টিকেট কেলেংকারীর অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। সাবেক কান্ট্রি-ম্যানেজার শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে আড়াই হাজার ফ্রি টিকেট বিক্রি করে ১৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি এ অভিযোগের কিছুটা সত্যতা পাওয়া গেছে।

এসব অভিযোগ তদন্তে সম্প্রতি লন্ডনে এসেছেন দুই সদস্যের তদন্ত দল। এদলে রয়েছেন যুগ্ম সচিব জ্ঞানেন্দ্র নাথ সরকার এবং বিমান বাংলাদেশের কন্ট্রোলার অফ একাউন্টস এ এস এম মনজুর ইমাম। তাঁরা লন্ডনে সপ্তাহ খানেক থেকে তদন্ত করেছেন।

এসময় তাঁরা বিমান অফিস, লন্ডনের বিভিন্ন ট্রাভেল এবং কার্গো এজেন্ট অফিস পরিদর্শন করেছেন। লন্ডনে থাকাকালীন তদন্ত দলের একজন জ্ঞানেন্দ্র নাথ সরকারের সাথে দেখা হয়েছি বিমান অফিসে। তদন্তের বিষয়ে তিনি মুখ খুলতে নারাজ। বললেন, ঢাকায় গিয়ে প্রতিবেদন জমা দেবেন। তবে কথা প্রসঙ্গে জানালেন, হিথ্রো বিমান বন্দরে যাত্রীদের অতিরিক্ত ব্যাগ পরিবহনের জন্য যে নগদ অর্থ নেওয়া হয় সেটা যাতে ক্যাশ মেশিনের মাধ্যমে নেওয়া যায় সে ব্যবস্থা করা হবে। এখানে বলে রাখা ভালো,পৃথিবীর অত্যাধুনিক বিমানবন্দর হিথ্রো বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমান এনালগ পদ্ধতিতে অর্থের লেনদেন করে। এখানে কোন যাত্রীর নিকট অতিরিক্ত মালামাল হয়ে গেলে সে যাত্রীকে নগদ অর্থ পরিশোধ করে অতিরিক্ত মালামাল নিতে হতো।

এবিষয়ে অতীতে বহুবার কান্ট্রি ম্যানেজারগণকে অবহিত করা হলেও তাঁরা পাশ কাটিয়ে গেছেন। এ নগদ অর্থ সংগ্রহের দায়িত্বে আছে ডানাডা নামের একটি সংস্থা। কিন্ত হাতে লেখা বা কম্পিটারাইজড  রশিদ দেওয়া হতো বিমান বাংলাদেশের নামে। এ অর্থ আদৌ বিমান পেত কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এবিষয়ে সদ্য যোগ দেওয়া কান্ট্রি ম্যানেজার হারুন খান বালখিল্য ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কয়েক সপ্তাহ পূর্বে আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, বিমানের ব্যাংক রয়েছে বার্কলেস ব্যাংকে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নাকি কার্ড মেশিন দিচ্ছে না। তদন্ত দলের সদস্য জ্ঞানেন্দ্র সরকারের সামনে তিনি আরো হাস্যকর কথা বললেন যে, তিনি জানেন না যে কার্ড মেশিন অন্য কোথাও থেকে পাওয়া যায়। এভাবে লন্ডনের অবস্থা না জেনেই তিনি এসেছেন লন্ডনের দায়িত্ব নিয়ে।

এবার আসি মূল কথায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। মন্ত্রীসভা গঠনের সময় থেকে আমরা দেখেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমালোচিত কাউকে নতুন মন্ত্রী সভায় স্থান দেননি। এতে বোঝা যায় সরকার কোনমতেই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবে না। বিমানের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী সাংবাদিকদের বলেছেন, বিমানের প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনিয়ম আর দুর্নীতি। পর্যায়ক্রমে সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারী দেন তিনি। লন্ডনে আসা তদন্ত দলে থাকা জ্ঞানেন্দ্র সরকারও জানালেন বর্তমান মন্ত্রী মহোদয় এবং সচিব মহোদয় অত্যন্ত আন্তরিক বিমানের সমস্যা সমাধানে। তিনি বেশ প্রশংসা করলেন বর্তমান প্রশাসনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মনোভাবের। কিন্তু আমার কাছে খটকা লেগেছে কয়েকটি বিষয়।

জ্ঞানেন্দ্র সরকার দাবি করলেন বিমানের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করা প্রায় প্রতিটি তদন্ত দলে তিনি ছিলেন। এসব তদন্তে বিমানের কার্গো নিয়ে দুর্নীতি বিশেষ করে লন্ডনে কার্গো দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেছে। এছাড়া টিকেট নিয়ে দুর্নীতিও কিছুটা সত্যতা পেয়েছে বাংলাদেশের তদন্ত দল। লন্ডনে এসে তিনি তাঁর দলসহ কার্গো এজেন্টের সাথে বৈঠক করেছেন। তিনি অভিযুক্ত জেএমজি কার্গোর সাথে আলাদা বৈঠক করেছেন। বিমান অফিস থেকেও বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। আলাপকালে তিনি জানালেন, হিথ্রো বিমানবন্দরে নগদ অর্থ লেনদেনের বিষয়টিকে তাঁরা প্রাধান্য দিচ্ছেন। বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাঁদের মূলত তদন্তের বিষয় ছিল কার্গো এবং টিকেটে কেলেংকারীর বিষয়ে তদন্ত করা।

কার্গো বিষয়ে তিনি কোন কথা বলতে নারাজ। তবে বাঙালি পাড়ায় নানা ধরনের কথা বার্তা শোনা যাচ্ছে। বিমানের এক কর্মকর্তা কয়েক সপ্তাহ আগে বলেছিলেন, লন্ডনে এসে তদন্ত দল কোন কিছুই পাবে না। তখন আমি বলেছিলেন, বাংলাদেশে তো এটা খুবই সাধারণ একটি বিষয়। কোন দুর্নীতির তথ্য উদঘাটিত হলেও পরবর্তীতে তদন্ত দলের নামে নাটক করা হয়। শেষে প্রতিবেদনে দেখা যায় কোন দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কারণ দুর্নীতিবাজরা এতো শক্তিশালী যে তারা তদন্ত দলকে যেকোনভাবে ম্যানেজ করে ফেলে। বিমানের ঐ কর্মকর্তার কথা শোনে আমার মনে সে আশংকায় হয়েছিল। এখন তদন্ত দলের সদস্য জ্ঞানেন্দ্র সরকারের সাথে কথা বলে আমার আশংকায় সত্য হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কার্গো নিয়ে কোন কথা না বললেও টিকেট কেলেংকারী নিয়ে যা বললেন তাতে আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে। আশংকা হচ্ছে সর্ষের মধ্যেই ভূত কিনা। তিনি জানালেন, এভাবে ফ্রি টিকেট দেওয়া যায়। তবে এসব টিকেট সঠিক প্রক্রিয়ায় সঠিক লোককে দেওয়া হয়েছে কিনা সেটা দেখতে হবে। সাধারণত ট্রাভেল এজেন্টগুলোকে বিমানের টিকেট বিক্রির উপর ভিত্তি করে ফ্রি টিকেট দেওয়া হয়। আমি কয়েকজন ট্রাভেল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা জানান, টিকেট বিক্রির উপর ভিত্তি করে কিছু ফ্রি টিকেট পাওয়া যায়। তবে যে পরিমাণ ফ্রি টিকেট দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এতগুলো ফ্রি টিকেট দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

তদন্ত দল কোন পথে যাচ্ছে তার একটা ধারণা পাওয়া গেল জ্ঞানেন্দ্র সরকারের সাথে আলাপচারিতায়। তারপরও আমরা আশাবাদী। বর্তমান সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের নীতি বাস্তবায়নে প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা যেন সহায়তা করে আমরা সেটাই কামনা করি। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ যেন দুর্নীতির অতল গহবর থেকে মুক্তি পায় লক্ষ লক্ষ প্রবাসীর এটাই চাওয়া।

লেখক পরিচিতি- সরওয়ার হোসেন। (প্রবাসী সাংবাদিক)। লেখাটি লেখকের নিজস্ব মতামত।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি