বিশৃঙ্খল খাদ্যভ্যাস বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়
প্রকাশিত : ১০:০১, ১৯ অক্টোবর ২০২০
ক্ষুধা পেলে মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে। খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে দেহের পুষ্টি সাধিত হয় ও স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তাই সুস্থ জীবনের জন্য মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিশ্বজুড়ে মানুষের ‘বিশৃঙ্খল’ খাদ্যাভ্যাসের কারণে অচিরেই মানবসভ্যতা ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়বে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেট’-এ সম্প্রতি গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে।
সুস্থ থাকার জন্য খাদ্যাভ্যাসের কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০০ কোটি লোক প্রয়োজনীয় খাবার পায় না এবং ২০০ কোটি লোক প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত খাবার খায় বলে গবেষণা নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে। সেসবের বেশির ভাগ অস্বাস্থ্যকর খাবার বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষকেরা দাবি করেছেন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় এক কোটি দশ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং কয়েক ধরনের ক্যান্সারে উন্নত দেশের মানুষের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ। তবে সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে সেই হার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
গবেষণা নিবন্ধের অন্যতম সহলেখক ও যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টিম ল্যাং বলেন, বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৭৭০ কোটি। ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে এক হাজার কোটি, যা কিনা বাড়তেই থাকবে। এখনই সবার খাদ্যাভ্যাস না বদলালে এত বিপুলসংখ্যক লোককে স্বাস্থ্যসম্মত ও টেকসই খাবারের জোগান দেওয়া তখন অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই খাদ্যাভ্যাসের দিক দিয়ে দুনিয়াজুড়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে।
বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী খাদ্য উৎপাদন ও বনের জন্য জমি ব্যবহার। এছাড়া বিদ্যুৎ ও তাপ উৎপন্নের জন্যও যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয় সেটা বিশ্বের সব রেলগাড়ি, উড়োজাহাজ বা অন্যান্য যানবাহনের চাইতেও অনেক বেশি। খাদ্য উৎপাদন খাতের পরিবেশগত প্রভাব যদি আরও কাছ থেকে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবারের উৎপাদন পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশ্বব্যাপী গবাদিপশুর কারণে ১৪% থেকে ১৮% গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়ে থাকে।
এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী অন্যান্য গ্যাস যেমন মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের নির্গমন সবচেয়ে বেশি হয় কৃষি উৎপাদনের কারণে। বায়ু দূষণের একটি প্রধান কারণ এই কৃষিজমি। কেননা এসব খামার থেকে অ্যামোনিয়ার সৃষ্টি হয়। যেটাকে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। একইভাবে পানির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের হুমকি এই কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন খাত। কেননা বিশ্বের ৭০% পরিষ্কার পানি ব্যবহার হয়ে যায় কৃষিজমি সেচের কাজে।
পৃথিবীকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে একটি ডায়েট (খাদ্য তালিকা) প্রস্তুত করেছেন বিজ্ঞানীরা, যা দিয়ে সামনের দশকগুলোতে একশ’ কোটিরও বেশি মানুষকে খাওয়ানো যাবে। আর এটা সম্ভব হবে আমাদের গ্রহের কোনো ক্ষতি না করেই। সামনের দশকগুলোতে কোটি কোটি মানুষের খাদ্য সরবরাহ কিভাবে করা যাবে সেটা নিয়েই এতদিন গবেষণা করছিলেন বিজ্ঞানীরা। আমরা যেসব খাবারে আমাদের প্লেট ভরিয়ে রাখি, সেখানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার বলে মনে করেন তারা। অবশেষে গবেষকরা একটি আদর্শ ডায়েট (স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য তালিকা) তৈরি করে দিয়েছেন।
এই ডায়েটটি (খাদ্য তালিকা) তৈরি করা হয়েছে মাংস এবং দুগ্ধজাতীয় খাবার বাদ না দিয়েই। তবে প্রোটিনের চাহিদার একটা বড় অংশ মেটাতে সেখানে বাদাম, বিভিন্ন ধরনের ডাল আর দানাশস্য যুক্ত করা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের পরামর্শ হলো ডায়েট থেকে মাংসের পরিমাণ কমিয়ে বিকল্প প্রোটিনের উৎস খোঁজা। যেসব পুষ্টিকর খাবার আমরা এড়িয়ে যেতে চাই সেগুলোর প্রতি আগ্রহ জন্মানোর ওপরও তারা জোর দেন। আপনি যদি প্রতিদিন মাংস খেয়ে থাকেন তাহলে আপনার ডায়েটে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা জরুরি। তার মানে এই নয় যে, আর মাংসই খাবেন না। মাংস খাবেন, তবে পরিমিত হারে। যেমন- লাল মাংসের কোনো খাবার যেমন বার্গার যদি খেতেই হয় তাহলে সেটা সপ্তাহে একদিন খাবেন।
এছাড়া সপ্তাহের অন্য আরেক দিন মাছ বা মুরগির মাংস দিয়ে প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে পারেন। আর বাকি দিনগুলোতে প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে হবে বিভিন্ন উদ্ভিদজাত খাবার খেয়ে। এক্ষেত্রে গবেষকরা প্রতিদিন বাদাম, দানাশস্য বা ডাল খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া নানা ধরনের ফল এবং সবজি খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধির কথাও জানান তারা। শ্বেতসারযুক্ত খাবার যেমন- আলু বা কাসাভাও যুক্ত করা যেতে পারে।
‘ল্যানসেট’-এ প্রায় ৩৬ জন বিজ্ঞানীর একটি দল (যেখানে কৃষি থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন এবং সেইসঙ্গে পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা ছিলেন) টানা দু’বছর গবেষণার পর তারা এই খাদ্য তালিকা তৈরি করেছেন। যা পরবর্তীতে ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশ করা হয়। বাড়তি জনগোষ্ঠীর খাবার জোগান নিশ্চিত করতে তারা এই গবেষণাটি করেন। এখন তাদের লক্ষ্য বিভিন্ন দেশের সরকার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এই গবেষণা ফলাফল পাঠানো। যেন সব জায়গায় এই খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন আনা যায়।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষ করে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় লাল মাংস খাওয়ার হার ব্যাপকভাবে কমাতে হবে। পূর্ব এশিয়ায় মাছের ওপর নির্ভরতা এবং আফ্রিকায় শ্বেতসার জাতীয় সবজি খাওয়ার পরিমাণ কমানো প্রয়োজন। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টকহোম রেসিলিয়েন্স সেন্টারের পরিচালক লাইন গর্ডন বলেন, ‘আগে কখনোই এই হারে এবং এই গতিতে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়নি।’ লাল মাংসের ওপর কর বাড়ানো ডায়েটে পরিবর্তন আনার একটা উপায় হতে পারে বলে মনে করেন গবেষকরা।
গবেষকদের লক্ষ্য হলো সামনের দশকগুলোয় বিশ্বের বাড়তি জনসংখ্যার সবার খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করা সেটা পরিবেশের ক্ষতি না করেই। বরং এতে কমে যাবে গ্রিনহাউসের মতো ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণ এবং সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা জীববৈচিত্র্য। এতে কৃষি জমি আর বাড়াতে হবে না এবং পানি সংরক্ষণ করা যাবে। তবে শুধু খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনাই যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে খাদ্যের ফলে সৃষ্ট বর্জ্যরে হার কমিয়ে আনা, সেই সঙ্গে বিদ্যমান জমিতে বাড়াতে হবে খাদ্যের উৎপাদন এবং কমাতে হবে খাবারের অপচয়ও।
লেখক: বিএসসি ইন নার্সিং ( চবি), এম পি এইচ ইন নিউট্রিশন (ইবি)