ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪

বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের ৭৫ বছর পূর্তি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:০০, ৩ অক্টোবর ২০২০

বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠার পর আজ ৭৫ বছর পূর্তি পালন করছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ সমাপ্তির পরবর্তি অক্টোবর মাসেই শ্রমিকদের মৌলিক মানবিক অধিকার আদায় এবং যুদ্ধ নয়, ধ্বংস নয়, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবীতে ১৯৪৫ সালের এই দিনে প্যারিসের প্যালিস ডি চেইলোটে বিভিন্ন দেশের প্রগতিশীল শ্রমিক প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন গঠন করেন।

শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক বৃহত্তম এই সমাবেশটি সেদিন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে অনিন্দ্যভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ৭৫ বছরের দির্ঘ এই পথ চলায় বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন একই সাথে শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে, শ্রেণীবদ্ধ ও আন্তর্জাতিকতার প্রশ্নে তার অনমনীয় নীতি অব্যাহত রেখেছে এবং সম্মান ও মর্যাদার সাথে ৭৫ বছর পুর্ণ করেছে। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এই প্রতিষ্ঠানকে একটি শ্রেণী সচেতন, মর্যাদাপুর্ণ সংগ্রামী সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে যারা অবদান রেখেছেন তাদের স্মৃতিকে আজ শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরন করছি। ১২৬টি দেশের ৯৮ মিলিয়ন শ্রমিকের প্রতিনিধিত্বকারী বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন বিশ্বব্যপি নিপিড়িত শ্রমজীবি মানুষের অধিকার ও স্বার্থরক্ষায় তার ভুমিকা অব্যাহত রাখবে।

যে লক্ষ্যপূরণ করার জন্য বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ৭৫ বছরে তা আজ আরো প্রাসঙ্গিক। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণী যে নিপীড়নের শিকার তা আরো তীব্ররুপ লাভ করেছে করোনা মহামারিতে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে, বেকারত্ব বেড়েছে ভয়াবহভাবে, শ্রমজীবীদের অর্থনৈতিক দুর্দশা বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু পুঁজিবাদী শোষণের ফলে কর্পোরেট পুঁজির মুনাফাও বেড়েছে বিপুলভাবে। ফলে বিশ্বব্যাপী করোনা বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে। মজুরী, চাকুরীর নিশ্চয়তা সহ শ্রম আইনে শ্রমিকদের যে সুরক্ষা দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল তা আবার কেড়ে নেয়ার পায়তারা চলছে বিশ্বব্যাপী। গোটা পৃথীবী এখন পুঁজিবাদী আগ্রাসনের শিকার। বহুজাতিক কর্পোরেশনের দৌরাত্ব সীমা ছাড়িয়েছে। মুনাফার একাধিপত্য বিস্তারে তারা মরিয়া। মুনাফা লুন্ঠনের নেশায় তারা বিশ্ব প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের উমত্ত নেশায় মগ্ন। 

একমাত্র শ্রেনি সচেতন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনই শ্রমিকশ্রেনীকে দুর্দশা থেকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসনের বিপরীতে বিশ্বের দেশে দেশে গড়ে উঠা  ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করা আজ সময়ের দাবী। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে বিশ্বব্যাপী শ্রেণী সচেতন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলা আজ অত্যান্ত প্রয়োজন।

বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের ৭৫ বছর পূর্তি উদযাপনের এই বর্ষে বিশ্ব এক ভয়াবহ মহামারী কভিড-১৯ আক্রান্ত। করোনা মহামারী আমাদের পৃথিবীকে থমকে দিয়েছে; বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ঘটনা ঘটছে। কভিড-১৯ শুধুমাত্র আমাদের অসুস্থ ও জীবন কেড়ে নিচ্ছে না, সামগ্রীকভাবে আমাদের সমাজ, জীবনযাত্রা এবং সামগ্রীক অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব তৈরী করেছে। সবচেয়ে অভিঘাত এসেছে শ্রমজীবী কর্মজীবী মানুষের উপর। অসংগঠিত খাতে নিয়োজিত নিম্ন আয়ের মানুষ সংকটে নিপতিত। কভিড-১৯ শ্রমজীবীদের জীবন ও জীবীকা অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে; কর্মহারিয়ে তারা গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। 

কোভিড-১৯ এর ক্ষতিগ্রস্থরা হলেন, শ্রমিক, কৃষক ও শ্রমজীবী শ্রেণীসহ বিস্তর নিপীড়িত  জনগণ; ধনিক শ্রেণী ও শোষণকারীরা নয়। করোনার অজুহাতে বাংলাদেশের মালিকরা রাষ্ট্রের কাছে যত সুবিধা নিয়েছে তার কোন সুফল শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে নাই। বরং এই করোনাকালে প্রণোদনা নিয়েও গার্মেন্টস এবং চামড়া শিল্পে শ্রমিক ছাঁটাই, সময়মত মজুরী পরিশোধ না করা, মজুরী কম দেয়া সহ নানাভাবে শ্রমিকদেরকে বঞ্চিত করেছে। সড়ক ও নৌযান সহ পরিবহণ শ্রমিক, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা চরম দুর্দশায় জীবন অতিবাহিত করেছে। তারা জীবন বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। তাদের এই শ্রমে দেশের উৎপাদন ও অর্থনীতি সচল থাকলেও শ্রমিকদের জীবন হয়েছে দুর্বিষহ। ব্যাংক-বীমা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই সংকটকালে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অপচয়ের দায় শ্রমিকদের কাঁধে চাপিয়ে রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, চিনিকলগুলো বন্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। অতীতেও রাষ্ট্রীয় কারখানা লোকসানের অজুহাতে ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল, এর ফলে লুটপাট হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রের বা দেশের জনগণের কোন লাভ হয় নি। 

বিশ্বব্যাংক আই এম এফ এর পরামর্শে মালিকদের লাভ হলেও কোন দেশের জনগণের উপকার হয়েছে এমন কোন দৃষ্টান্ত নাই। আমরা এই সভা থেকে করোনাকালে মালিকদের সকল আবদার পূরণ করা হলেও শ্রমিকদের চাকুরি, মজুরী, জীবিকার সুরক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না করার প্রতিবাদ জানাই। আমরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সুরক্ষার দাবী উত্থাপন করছি। সভা আউটসোর্সিং এর নামে শ্রমিকদের চাকুরীর নিশ্চয়তা হরণকারী পদক্ষেপ এর প্রতিবাদ করছে এবং তা বাতিল এর দাবী জানাচ্ছে। শ্রমিকদের মজুরী সুরক্ষা বলে কিছু নেই। সভা সকল খাতের শ্রমিকদের জন্য আইন প্রণয়ন করে জাতীয় ন্যুনতম মজুরী ঘোষণার দাবী জানায়। প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা, করোনার কারনে কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসা, পুনরায় কর্ম ক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ দাবী করছে। সভা আন্তর্জাতিক ঘোষিত নীতি ও আইএলও কনভেনশন অনুসারে শ্রমিকের অধিকার রক্ষার আহবান জানায়। শ্রম আইন ও বিধিমালায় সকল শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী আইন বাতিলের দাবী জানায়।

সভা মনে করে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা যদি পুঁজিবাদী শ্রেণি এবং কোভিড-১৯ এর মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ সচেতন ভাবে শ্রমিকের আন্তর্জাতিক সংহতি গড়ে তুলতে পারি, তাহলে  আমরা  বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হবো। এখন সময় এসেছে শ্রেণীর শক্তি বাড়ানো ও শক্তিশালী করা, পুঁজি এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামী শ্রমজীবী জনগণকে তাদের উপযুক্ত জীবনযাপন বিষয়ে অধিকার সচেতন ও সংগঠিত করার।

এই উপলক্ষে বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সকল সহযোগী, সমর্থক এবং টিইউআই-কে পারস্পরিক আন্তর্জাতিক সংহতি বৃদ্ধি করার জন্য এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, শান্তি ও বন্ধুত্বের জন্য সংগঠিত ঐক্যের শক্তির পাশাপাশি প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা এবং সুস্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য আরও দৃঢ়তার সাথে সংগ্রাম করার আহ্বান জানাই।

আমরা বিশ্বাস করি শ্রেণি চেতনায় শাণীত ট্রেড ইউনিয়নগুলি কৌশলগত উপায়ে সংগ্রামের মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার এবং স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করার সকল প্রয়াস কে রুখে দিতে সক্ষম হবে। আসুন বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের ৭৫ বর্ষ পুর্তিতে ঘোষিত ‘একচেটিয়া ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক এবং জনগনের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম অব্যাহত: শোষনমুক্ত, সামাজিক ন্যায়বিচার সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ার’ শ্লোগানকে জোরদার করি ও এগিয়ে নেই। বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন তার ঐতিহ্যকে ধারণ করে শ্রমিকের স্বার্থ হরণকারী সকল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অব্যাহত সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রত্যয় এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি ব্যাক্ত করছে। 

আরকে//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি