বিসিএস যাদের ধ্যানজ্ঞান তাদের স্বপ্ন খুব বড় নয়
প্রকাশিত : ২০:২৩, ১২ আগস্ট ২০১৭ | আপডেট: ১৬:৪৯, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭
দেশে উচ্চশিক্ষা শেষ করে অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) ক্যাডার হওয়ার। তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিসিএস পরীক্ষায় আবেদনের হিড়িক দেখে। ৩৮ তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য আবেদন করেছেন প্রায় ৪ লাখ চাকুরিপ্রার্থী, যা গতবারের চেয়ে প্রায় দেড় লাখ বেশি। অথচ পদ রয়েছে মাত্র ২ হাজারটির মত। তাহলে বাকিদের কী হবে? আর কেনই বা বিসিএসের জন্য মরিয়া এতোগুলো চাকুরিপ্রার্থী? বিসিএসই কী সব? এসব ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা এবং বিসিএসের প্রস্তুতির বিষয়ে বলেছেন খুলনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, মিজান রহমান (৩৫ তম বিসিএস)।
জীবন মানেই কী বিসিএস ?
জীবন মানেই বিসিএস না। আমরা এটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বেলুন বানিয়েছি নিজেদের মতো করে। বরং বিসিএস যাদের ধ্যান জ্ঞান তাদের স্বপ্ন যে খুব বড় যে তা আমি মনে করি না। তার চেয়ে যিনি একটি নতুন ফ্যাশন হাউজ খুললেন তার স্বপ্নের আকাশ অনেক বড়। যদি টাকার কথাই বলি, বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পর কত টাকাই বা বেতন পাবেন! তবে হ্যাঁ, যদি সাধারণ মানুষের জীবন বদলাতে আপনি সহযোগী হতে চান, দেশের উন্নয়নে সরাসরি অংশ নিতে চান তাহলে আসতেই পারেন! ভালো থাকাটাই আসল উদ্দেশ্য। যে যেভাবে পারেন ভালো থাকলেই হলো। তবে সেটা যেন সৎ পথে হয়। জীবন আর কত বড়!
বিসিএস ক্যাডার হওয়া কী খুব কঠিন?
বাংলাদেশে যতগুলো চাকরির পরীক্ষা আছে তার মধ্যে বিসিএসটাকেই তুলনামূলক সহজ মনে হয়েছে আমার কাছে। বেসিক যদি ভালো থাকে তাহলে একেবারে অল্প পড়েও লিখিত পরীক্ষায় পাস করে টেকিনিক্যাল/প্রফেশনাল ক্যাডার পাওয়া সম্ভব। যাদের টেকনিক্যাল বা প্রফেশনাল ক্যাডারে যাওয়ার সুযোগ আছে তারা সবচেয়ে ভাগ্যবান এখানে। আর যারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা লোক প্রশাসন টাইপ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন অর্থাৎ সাধারণ ক্যাডারই শেষ ভরসা তাদেরও অনিশ্চয়তার কিছু নেই আর। নন ক্যাডারে অনেক সম্মানের চাকরি আপনার জন্য তো আছেই! আগে পায়ের নিচে মাটির ব্যবস্থা করেন। পরেরবার না হয় সাধারণ ক্যাডারের জন্য চেষ্টা করলেন।
৩৪তম পর্যন্ত ও ৩৪তম পরবর্তী বিসিএসের তুলনামূলক বিশ্লেষণ-
প্রথমে আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে বা আগের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যে বিসিএস আর আগের জায়গায় নেই। ৩৫তম থেকে সিলেবাস পরিবর্তন হয়েছে। পিএসসি চায় এখন স্মার্ট এনার্জেটিক ছেলেমেয়েদের যারা শুধু বাজারের বইয়ে মুখ লুকায়ে রাখবে না। ৩৫ থেকে ৩৭ পর্যন্ত প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন বিশ্লেষণ করেন আশা করি পার্থক্য বুঝতে পারবেন আগের বিসিএস থেকে। ভাইভা পরীক্ষায়ও আপনাকে যাচাই করা হয় আপনি কতটা স্মার্ট, আপডেটেড আর খেলাধূলা, শিল্প সংস্কৃতি, পৃথিবীর চারপাশ সম্পর্কে কতটা জানেন আপনি।
তাই জব সলিউশন পড়ে পাস করবেন এই বিশ্বাস বাদ দিন। জব সলুশ্যনে থাকে এলোমেলো তথ্য, ব্যাখ্যা। উদাহরণ হিসেবে বলি, আপনি যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে জানবেন তখন যতটা পারবেন পুরোটা জানবেন।
বাজারের প্রতিটি বইয়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কী লেখা আছে দেখুন, বাজারের বইয়ের বাইরে বিভিন্ন রেফারেন্স বই দেখুন। সব বই শেষ? এবার গুগলে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখুন। উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়াতে অনেক আনকমন তথ্য পাবেন নিশ্চিত। বিভিন্ন ব্লগে ভালো ভালো লেখা পাবেন। এভাবে প্রতিটা বিষয় জানুন সময় পেলে। এক সময় এর প্রতিদান পাবেন নিশ্চিত। জ্ঞান আহরণের উৎসকে সরু পথ বানাবেন না প্লিজ।
আপনি পরীক্ষায় বিশ্ব পরিবেশ দিবস কবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবে প্রতিষ্ঠিত হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় কয়টি সেক্টর ছিল, ফরাসি বিপ্লব কবে হয় এই টাইপ প্রশ্ন আর খুব বেশি আশা করবেন না। ৩৬তম তেও সহজ প্রশ্ন ছিল তবে তা ৭০টির বেশি নয়। ৩৭তম তেও সহজ কঠিনের মিশ্রণ ছিল, বেশ স্মার্ট কোশ্চেন ছিল।
পড়ার ইচ্ছা থাকলে বাজারের কমপক্ষে তিনটি প্রকাশনীর ডাইজেস্ট কিনে ফেলুন! প্রতিটি পড়বেন। জানার মাধ্যম বাড়ান। স্মার্ট হোন। চোখ কান খোলা রাখুন। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একেবারে স্পষ্ট ধারণা রাখুন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ুন। ইতিহাস জানুন। বাংলাদেশের সংবিধান ও অনুচ্ছেদ সম্পর্কে ধারণা রাখুন। পত্রিকা পড়ুন বাংলা ইংলিশ। নিয়মিত কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স পড়ুন।
ইংলিশ লিটারেচার নিয়ে বেশিরভাগ পরীক্ষার্থীই কেয়ারলেস। অথচ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ১৫ নম্বর আছে। এখানে আরেকটু যত্নশীল হোন। এই বিষয়ে ভালো করতে হলে শুধু ডাইজেস্টের উপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। বিষয়ভিত্তিক বই পড়ুন অন্তত ২টি এ বিষয়ে।
সামগ্রিক আলোচনা-
প্রথমে ভাবুন আপনি সত্যিই বিসিএস ক্যাডার হতে চান কিনা। যদি উত্তর হ্যাঁ আসে তাহলে নেমে পড়ুন মাঠে। বিসিএস হচ্ছে টেস্ট খেলা। ব্যাটিংয়ে নামলে কখনো সাউথ আফ্রিকার পিচের মতো বাউন্সার আসবে, কখনো ইংল্যান্ডের পিচের মতো সুইং, কখনো ভারতের পিচের মতো স্পিন বল আসবে। পিচে ধৈর্য ধরে থাকুন। ভালো বই পড়ুন,সিনেমা দেখুন। গৌতম ঘোষ পরিচালিত “শঙ্খচিল” সিনেমা দেখেছেন? আমার মনে হয় ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ বিষয়টাকে বোঝার জন্য এর চেয়ে ভালো সিনেমা হয় না।
পারলে রাত জেগে ইউরোপিয়ান লিগ দেখুন। ওটা দেখতে গিয়ে ইউরোপের শহর সম্পর্কে ভালো ধারণা হয়ে যাবে। স্টুয়া বুখারেস্ট নামে একটা ক্লাব চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলে মাঝে মাঝে। খেলা দেখতে গিয়ে বুঝতে পারবেন ওইটা আসলে রোমানিয়ার ক্লাব আর রোমানিয়ার রাজধানীর নাম হচ্ছে বুখারেস্ট।
পিএসজির নেইমারকে কেনার পেছনে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্য ও কাতারের যে বিশ্ব রাজনীতিও ছিল সেটাও বুঝতে পারবেন গভীরভাবে। জীবনটাকে উপভোগ করুন। যেখানে যা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কুড়ান।
আমি সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১০/১১ টা পর্যন্ত পড়ার সময়ই পেতাম না। ছাত্র পড়াতাম।
৩৫তম প্রিলিমিনারিতে একটা প্রশ্ন এসেছিল “বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি বলেছিল কোন পত্রিকা?” এই প্রশ্ন তখন অধিকাংশ পরীক্ষার্থী উত্তর করতে পারেনি হয়ত। বাজারের কোনো বইয়ে এই তথ্য ছিল না। আমি পেরেছিলাম। কারণ এই তথ্য আমি পেয়েছিলাম ক্লাস টেনের ছাত্রকে বাংলা পড়াতে গিয়ে।
আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি, বলুনতো বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন কি?
উত্তর চর্যাপদ তাই না?
কিন্তু যদি দেখেন অপশনে চর্যাপদ নেই তখন! ৩৫ তম`র প্রশ্নে অপশনে ছিল "দোহাকোষ"। এখন আপনাকে তো চর্যাপদ, দোহাকোষ এগুলো সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানতে হবে নাকি?
৩৭ তম তে মীর মশাররফ হোসেনের একটা উক্তি এসেছিল যেটা পাওয়া যায় শহীদ মিনারের পাশে দেয়ালে!
আমাদের জাতীয় সংগীতের সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কার সুরের আদলে তৈরি করেছেন?
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের কোথায় সবচেয়ে বড় গণহত্যা (২ ঘন্টায় ৮-১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়) সংঘটিত হয়?
বিসিএসের প্রস্তুতি-
বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মো: সাদিক স্যার চাকুরিপ্রত্যাশীদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। উনি খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছেন বিসিএসের সব ধাপ অতিক্রম করার পর কেউ বেকার থাকতে পারে না। আপনি জানেন হয়ত ৩৫তম বিসিএসে পাস করা কিন্তু ক্যাডার পদের স্বল্পতা থাকায় চাকরি না পাওয়া সবার ঘরে তিনি পূর্ণিমার আলো দিয়েছেন। এই ট্রেন্ড এরপর থেকে চলতেই থাকবে আশা করি। তাই বিসিএস হতে পারে আপনার জন্য ভরসার জায়গা। অর্থাৎ আপনি যদি প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভায় পাস করেন তাহলে যেকোনো একটি জব পাবেন কোনো হয়রানি ছাড়াই। আপনি পরিশ্রমের মূল্য পাবেনই। আপনার মোটামুটি মানের মেধা আছে? পরিশ্রম করতে পারবেন? আর কিছু নেই? ওকে,দরকার নেই। ভরসা রাখুন পিএসসিতে।
৩৮ তম’র রেকর্ড সংখ্যক আবেদন এবং বিশ্লেষণ -
৩৮ তম তে রেকর্ড সংখ্যক আবেদন হয়েছে। এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ভাল প্রস্তুতি খুব কম জনের থাকে।আপনি হবেন সেই খুব কম জনের একজন। হওয়াটা কঠিন না। একটু ভিন্নভাবে, অন্যেরা যেভাবে পিঁপড়ার মতো চলছে সেভাবে চলবেন না। যেখানে থাকুন না কেন সৎ থাকুন, দেশের জন্য কিছু করুন। আর এটা যদি বিসিএসের মাধ্যমেই করতে চান তাহলে বলবো আপনার “লাইফ ইজ বিউটিফুল” ।
আরও পড়ুন