বিয়ের স্মৃতিচারণ: ১০ লাখ টাকা ডিপোজিটের শর্ত শ্বশুরবাড়ির
প্রকাশিত : ১৫:২০, ৪ জুলাই ২০১৮ | আপডেট: ১৫:৪৬, ৪ জুলাই ২০১৮
হবু শ্বশুর বড় কর্মকর্তা, বড় বাড়ি তাঁদের। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য শ্বশুর বাড়ির লোকজন শর্ত দিলেন, বিয়ের আগে মেয়ের অ্যাকাউন্টে ১০ লাখ টাকা ডিপোজিট করতে হবে। অথচ বরের পকেটে ছিল মাত্র ৭০০ টাকা। অকপটে নিজের দৈন্যদশা প্রকাশ করলেন, বললেন থাকার ঘরটাও যে কোনো সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে। শ্বশুর মশাই শেষ পর্যন্ত বরের সততার কাছে হেরে গিয়ে সগর্বে নিজের মেয়েকে তুলে দিলেন সেই বেকার ছেলের কাছে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ২৪টি বছর একই ছাদের নিচে পরম সুখে সংসার করছেন তারা। পকেটে ৭০০ টাকা নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়া লোকটা আর কেউ নয়। তিনি বসুধা বিল্ডার্স লিমিটেডের কর্ণধার আব্দুল জব্বার খান (কুসুম)। সেই দিনের স্মৃতিচারণ করেছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের কাছে। নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো-
সাজানো গোছানো একটা ড্রইংরুমে বসে আছি।
একটু টেনশন হচ্ছে। হবু শ্বশুর আমার ইন্টারভিউ নেবেন। ভদ্রলোক দুবাই থাকেন পঁচিশ বছর ধরে।
ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইনস এ্যামিরেটস এর বড়কর্তা।
সুমি হঠাৎ করেই গতকাল ফোনে বললো,
: কাল দুপুরে বাসায় আসতে পারবে? বাবা আসতেছে। ভোরের ফ্লাইটে। দশটার মধ্যেই বাসায় চলে আসবে।
আমি বললাম,
: জী... ম্যাডাম। কখন আসবো?
: বারোটায়। মনে থাকে যেন। বলেই লাইন কেটে দিল।
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। হঠাৎ করে আবার কি হলো! নতুন কোন ঝামেলা নাতো!
মাত্র গতকালই ওদের বাসায় অনেক নাটক করে এসেছি। একদিন গ্যাপেই আবার!
সুমি`র ফ্যামিলি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলোনা দেখে ও চাচ্ছিলো বিয়ের কাজটা কোর্টেই সেরে ফেলতে।
আমি রাজি না। বললাম,
: আমাকে একবার চেষ্টা করতে দাও। আমি তোমার ফ্যামিলির সাথে কথা বলতে চাই। কোর্টে বিয়ে করলে, তোমার ফ্যামিলি সামাজিক ভাবে অপমানিত হবে। আমার ফ্যামিলি থেকেও সারাজীবন খোঁটা শুনতে হবে। কথায় কথায় বলবে, এই মেয়েতো ভেগে এসেছে! তোমারও সন্মান নষ্ট হবে।
সুমি ভীত গলায় বললো,
: ওরা তোমাকে অপমান করবে! তোমার আর্থিক ব্যাপার নিয়ে যাচ্ছেতাই কথা বলবে!
এগুলো আমি সহ্য করতে পারবো না!
আমি বললাম,
: করুক! যত খুশি অপমান করুক! আমি ফেস করতে চাই। অন্ততঃ নিজেদেরকে বোঝাতে পারবো যে আমাদের চেষ্টায় ঘাটতি ছিল না।
গেলাম তাদের বাসায়। নিজেদের বিরাট বাড়ি!
দোতলায় থাকে। বাকি সব ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া।
আমার সঙ্গী হয়েছে ছোট বোন মিতা, তার বর জামিল এবং আমার বন্ধু শাম্মু।
ওদের বাসায় ঢোকার সময় জামিল ভাই আমার হাতে চাপ দিয়ে সাহস দেয়ার চেষ্টা করলেন। বললেন,
: একদম নার্ভাস হবেন না! সব ঠিক হয়ে যাবে!
আমরা কথা বলবো। আপনি পাত্র। নিজে থেকে কিছু বলতে যাবেন না!
বলার সময় তার চেহারা দেখে বুঝলাম, নিজেই নার্ভাস হয়ে গেছেন।
বোন মিতা এমনিতে মাতব্বরি করে অনেক।
কিন্তু আজকে কেন যেন খুবই চুপচাপ। বরের কথায় সায় দিয়ে বললো,
: হুম। সেটাই ভালো। তোমার ওই জিহ্বাটা আজকে ব্লক করে রেখো! যা বলার আমরাই বলবো।
কি বলেন, শাম্মু ভাই? বলে আমার বন্ধুর দিকে তাকালো। বন্ধু শাম্মু আরো বেশি নার্ভাস ভঙ্গিতে বললো,
: তাইতো করতে হবে। বলার সময় দেখলাম, বরাবরের মতই শাম্মু বেচারার চেহারায় খুবই দুর্বল ভাব।
আমি জানি, পাত্র হিসেবে আমার দুর্বল অবস্থাই ওদেরকে নার্ভাস করে দিয়েছে। তার উপর আবার অপমানিত হবার হুমকি ছিল।
সবাই মিলে ওদের ড্রইং রুমে বসে গেলাম।
সুমির বাবার দুজন বন্ধু এবং এক কাকা ওই পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
বড় মানুষের বড় বন্ধু। সবার আগে টাকা পয়সা নিয়ে কথা বলেন। ভাবখানা এই যে অঢেল টাকা থাকলে, বাকি সব মাফ। যাই হোক, এক পর্যায়ে ঝগড়াটা বেধেই গেল।
এক বন্ধু আভিজাত্যের আগুনে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
: আগে মেয়ের নামে দশ লাখ টাকা ব্যাংকে ডিপোজিট করতে হবে। তারপর আমরা বিয়ের আলোচনায় বসতে পারি। আমার পকেটের মানিব্যাগে তখন বড়জোর ছয় সাতশো টাকার মত হবে। আর ওইটাই ছিল আমার ব্যাংক, বাজেট, সঞ্চয় সব। ন্যাচারালি মাথাটা গরম হয়ে গেল।
সবার সাবধান বাণী ভুলে গেলাম। বললাম,
: ফাজলামো করেন? এটা কি বিজনেস ডিল হচ্ছে?
মেয়ে পক্ষের সবাই ক্ষেপে গেলেন। বললেন,
: ছেলেতো মহাবেয়াদব! আমরা এই বিয়ে দেবো না!
আমার পক্ষের সবাই তখন আমার হাত টেনে ধরেছে। কথা না বলার জন্য অনুনয় করছে।
তবুও আমি বললাম,
: নেগেটিভ কিছু বলার আগে মেয়ের মতামত জেনে আসুন!
: ওকে! তাহলে তাই করি! বলে ওনারা সবাই দল বেঁধে ভেতরে চলে গেল।
মিতা প্রচন্ড নার্ভাস হয়ে আমার হাত চেপে ধরে বললো,
: ভাইয়া। সুমি ঠিক আছেতো? উল্টাপাল্টা হলে আর মানসম্মান বলে কিছু থাকবে না।
আমি বললাম,
: ঠিক থাকারইতো কথা। দেখা যাক! ওয়েট করি!
কাকারা সেই যে গেল ভেতরে, আর আসেনা।
সুমি আর তার বোন হঠাৎ করেই পর্দা সরিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকলো। সুমির চোখ ভেজা। এসেই আমার পাশে বসে হাত ধরে বললো,
: স্যরি! কাকারা কাজটা ঠিক করেনি।
আমাকে হুমকি দিয়েছে বারবার। এই বিয়ে হবে না! হতে দেবে না! আমিও বলে দিয়েছি, তোমরা বাধা দিলে আমি কোর্টে বিয়ে করবো এবং একেই করবো! শুনে রাগ করে সবাই অন্য দরোজা দিয়ে চলে গেছে। তুমি প্লিজ, কষ্ট নিওনা!
সবার চোখে মুখে স্বস্তির ছাপ দেখলাম।
আমি সুমিকে বললাম,
: আমিতো তোমার জন্যেই এসেছি। অন্যেরা কি বললো, তাতে কিছুই আসে যায় না।
পর্দা সরিয়ে মেয়েকে নিয়ে হবু শ্বশুর মশাই ঘরে ঢুকে একটা সোফায় বসলেন। আমি সালাম দিলাম। সুমি বললো,
: তুমি বাবার সাথে কথা বলো। আমি চা নিয়ে আসছি। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম।
ভদ্রলোক হেসে বললেন,
: একটু প্যাচ লেগে গেছে। অন্যদের দায়িত্ব দিলে যা হয় আর কি! ফোনে আমি সব শুনেছি। আই এম স্যরি ফর এভরিথিং! বাবার কাজ বাবাকেই করতে হয়। অন্যরা নিজেদের ইগো নিয়ে ভাবে। অথচ, এখানে আমার মেয়ের জীবন জড়িত। আমি সব শুনে দুবাইয়ে আমার অফিসে খুব মন খারাপ করে বসেছিলাম। আমার বস, শেখ, সব জেনে বললেন, নিজেই দেশে চলে যাও! ছেলে পছন্দ হলে একেবারে বিয়ে দিয়ে চলে আসো! এখন কথা হচ্ছে, পছন্দের ব্যাপারটাতো আমাদের হাতে আর নাই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি আবার বললেন,
: তুমি কি করো? আই মিন, হোয়াট`স ইয়োর প্রফেশন?
আমি জবাব দিলাম,
: একটা ব্যবসার চেষ্টা করছি। জানি না, এটা দাঁড়াবে কিনা!
: ওহ্..! বলে তিনি আবার বললেন,
: তুমি কোথায় থাকো? বললাম,
: পুরোনো ঢাকার বনগ্ৰামে ছোট্ট একটা বাসায় থাকি।
আবারও প্রশ্ন।
: কয় বেডের ফ্ল্যাট?
আমি মৃদু হেসে বললাম,
: বেড ফেডের হিসাব করার মতো কিছু নাই।
দুইশ বছরের পুরোনো বাড়ি। লিজিং প্রোপার্টি। ঘর আছে মোট তিনটা। ছোট ছোট। যেকোনো সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে। দিনে ভাঙলে রিস্ক নাই।
রাতে ভাঙলে রিস্ক আছে। কারন, সারাদিন আমি বাসায় থাকি না। রাতে এই বাসাটাতেই ঘুমাই।
হবু শ্বশুর এতোটা চমক আশা করেননি।
তবুও হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই বললেন,
: তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
এবার আমিও চমকে গেলাম। ওনার কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না।
উনি সেটা বুঝেই বোধহয় বললেন,
: আমি সারাজীবন অনেস্ট লাইফ লিড করেছি।
তাই অনেস্ট মানুষ পছন্দ করি। তুমি ইচ্ছে করলে একটা ভিজিটিং কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে দিতে পারতে। যাতে হয়তো লেখা থাকতে পারতো ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা চেয়ারম্যান।
তাছাড়া, তোমার বাসার ব্যাপারেও যা বললে, আমার চৌদ্দ গুষ্টির কেউ এরকম শুনেছে কিনা সন্দেহ আছে। আশা করি, সারাজীবন তুমি এরকমই থাকবে!
গলা চড়িয়ে সুমির মা`কে সহ সবাইকে ডাকলেন।
বললেন,
ছেলে আমার পছন্দ হয়েছে!
তার অকপট কন্ঠে ছিল গভীর আনন্দের ছোঁয়া।
মেয়েকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন,
চিন্তা করিস না! কুসুম একদিন অনেক বড় হবে!
এই ছেলে বড় না হয়ে যায় না!
জিরো ক্যারিয়ারের একটা ছেলের প্রতি সুমি এবং তার ফ্যামিলির আস্থা দেখে আমার চোখ ভিজে গেল। কয়েক দিন পরেই বিয়ের কাজ শেষ।
ক্যারিয়ারের চড়াই উতরাই থাকবেই। আমারো ছিল, আছে। সুমিকে কখনোই দেখিনি হতোদ্যম হতে। একটা অন্ধ বিশ্বাসের সাথে বলে,
: তোমার কিছুই হবে না। তুমি হারার মতো মানুষ নও। আমার ওপর আস্থা রেখে গভীর নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যায় সে। আমি বসে বসে ভাবি, ওর এই বিশ্বাস আমি সারাজীবন ধরে রাখতে পারবো তো?
আজ আমাদের বিয়ের চব্বিশ বছর পুরো হলো।
দুই মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে ভালো আছি। ওহ্, বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। জামাইকে না দেখে থাকতে পারিনা এখন। আলহামদুলিল্লাহ!
সবার কাছেই প্রার্থনা,
: আমাদের জন্য দোয়া করবেন! যতদিন বাঁচি, এভাবে একসাথেই যেন থাকতে পারি!
বিঃদ্রঃ আমার ছোট বোন মিতা আর বেঁচে নেই।
আমেরিকার মাটিতে শুয়ে আছে সে। ওর দুই ছেলে এবং হাজবেন্ড ওখানেই এস্টাবলিস্ট।
" আল্লাহ্ আমার বোন মিতাকে জান্নাতবাসী করুন!"
অনুলিখন: মোহাম্মদ জুয়েল
এমজে/