ঢাকা, বুধবার   ১২ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বিয়ে সংক্রান্ত অপ্রয়োজনীয় বিষয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৫৪, ১২ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ২১:৫৮, ১৯ আগস্ট ২০২১

Ekushey Television Ltd.

দাম্পত্য জীবনে অশান্তির প্রধান কারণ বিয়ের ব্যাপারে ভুল ধারণা এবং মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যাশা। ‘রাজা বানকে আনারে- মুঝে লেকে যানারে, ছম ছমাছম ছম’- বিয়ের প্রসঙ্গে হিন্দি সিনেমার এ গানটিতে যে উচ্ছ্বাস, যে মোহময় কল্পনা ফুটে উঠেছে, বাস্তব জীবনেও তা-ই হবে- এমন কল্পনা করতে গিয়েই বিয়ে সংক্রান্ত অবিদ্যা বা ভ্রান্ত ধারণায় আক্রান্ত হন অনেকেই। সিনেমার নায়ক বা নায়িকার মতো স্বামী বা স্ত্রী কল্পনা করেন নিজেদের জন্যে। অথচ বাস্তব জীবনের সাথে সিনেমার জীবনের কোনো মিল হয় না। বাস্তবে এদের দুঃখ আর অশান্তির কোনো শেষ নেই।

সাধারণত বিয়েতে ছেলেপক্ষের প্রত্যাশা থাকে মেয়ে ফর্সা, সুন্দরী এবং কম বয়সী হতে হবে। মেয়ের বাবার বাড়ি গাড়ি ব্যাংক-ব্যালেন্স থাকতে হবে, যাতে যৌতুক পাওয়া যায়। আবার মেয়েপক্ষ ভাবে ছেলে ভালো বেতনের চাকুরে বা পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ী বা বিদেশে থাকলেই তা ভালো পাত্র হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। সে মদ্যপ, বদমেজাজী বা লম্পট কিনা বা বিদেশে সে কী করে তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজনও তারা মনে করেন না। এমনকি বিয়ের পর মেয়ের পড়াশোনা বা ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে কিনা, এটাও তারা ভাবতে চান না।

বিয়ে সংক্রান্ত আরেকটি অবিদ্যা হচ্ছে বিয়েকে ফরজ বা বাধ্যতামূলক মনে করা। অথচ নবীজী (সা.) বলেছেন, ‘বিয়ে হলো আমার সুন্নত। যে ব্যক্তি (শারীরিক ও আর্থিক সঙ্গতি থাকার পরও) এই সুন্নতকে লঙ্ঘন করলো সে আমার দলভুক্ত নয়’ অর্থাৎ জৈবিক চাহিদা বিয়ের মাধ্যমেই পূরণ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু যিনি জৈবিক প্রয়োজন সেভাবে অনুভব করেন না, তার জন্যে বিয়ে ফরজ নয়। বিয়ের জন্যে মানসিক আগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ। কারও যদি বিয়ের ব্যাপারে অবচেতন মনে অনীহা থাকে, তার বিয়ে হওয়া যেমন একদিকে বিঘ্নিত হবে, তেমনি জোর করে বিয়ে দেয়া হলেও আরেকটি মানুষকে প্রবঞ্চিত করা হবে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের জবরদস্তি একেবারেই অনুচিত।

বিয়ের তৃতীয় অবিদ্যা হলো বিয়ে না করলে জীবন বৃথা- এ ধারণা। বিয়ে করেছেন এমন অনেকে যেমন বিখ্যাত হয়েছেন, তেমনি বিয়ে করেন নি এমন প্রচুর নারী-পুরুষের নামও আমরা ইতিহাসে পাই যারা বিখ্যাত হয়েছেন। অর্থাৎ জীবন সার্থক হওয়া বা বিখ্যাত হওয়ার সাথে বিয়ের সম্পর্ক নেই। কারণ বিয়ে এমন একটি দায়িত্ব যেখানে রয়েছে দৈহিক, মানসিক, বংশধারা এবং আত্মিক- এ চারটি মৌলিক চাহিদাকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে সমন্বিত করার প্রয়োজন। দায়িত্ব পালনে দৈহিক, মানসিক অথবা অর্থনৈতিকভাবে অক্ষম হলে সে বিয়ে অর্থহীন। এ ধরনের বিয়ে অশান্তিই ডেকে আনে।

বিয়ের আরেকটি অবিদ্যা হলো বিয়ের সময় পাত্রপক্ষকে নানারকম দামি আসবাব, বিলাস উপকরণ ইত্যাদি দিতে হবেই- এরকম একটি বাধ্যতা যা যৌতুকেরই নামান্তর। কারণ কনের মা-বাবা কৌতুক করে এগুলো দিচ্ছেন না। তারা যৌতুক হিসেবেই দিচ্ছেন প্রচলিত সমাজের তথাকথিত নিয়মের চাপে বাধ্য হয়ে, যাতে বিয়ের পর মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির খোঁটা না শুনতে হয়। কিন্ত সত্য হচ্ছে, কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন পুরুষেরই উচিত নয় শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ের সময় তথাকথিত উপহার হিসেবে পাওয়া এ সমস্ত আসবাব-উপকরণ গ্রহণ করা।

বিয়ে সবসময় পরিচিত পরিমণ্ডলে হওয়া উচিত যেখানে পারস্পরিক জানা-শোনা আছে এবং সেটা অবশ্যই সম-সামাজিক ও সম-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে উভয় পরিবারের সম্মতিতে। সত্যিকারের সুখী এবং আনন্দপূর্ণ পরিবার গঠনের জন্যে একটি ছেলে বা মেয়ের তাকেই বিয়ে করা উচিত যাকে সে সম্মান করতে পারে, তার সহযোদ্ধা মনে করতে পারে এবং যে তার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে এবং তার জন্যে প্রয়োজনে সবকিছু বিসর্জন দিতে পারবে। তাই বিয়ের জন্যে শুধু সৌন্দর্য বা অর্থ-বিত্ত নয় বা উচ্চ ডিগ্রী নয়, ভালো মানুষ খুঁজতে হবে যার সাথে চেতনার মিল আছে এবং যিনি এ জীবনের পরও মহাজাগতিক জীবনে সঙ্গী হতে পারবেন। আসলে স্বামী-স্ত্রী যদি পারস্পরিক মেধা বিকাশ এবং আলোকিত পথের সহযোগী হন এবং সন্তানকে আলোকিত হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে সফল দম্পতি হিসেবে অবশ্যই স্বীকৃত হবেন। আর ফাউন্ডেশন এরকম সফল দম্পতিই কামনা করে।

বিয়ে সংক্রান্ত প্রচলিত আরেকটি অবিদ্যা হলো বিয়ের জন্যে খরচের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠা। একটিমাত্র বিয়ের জন্যে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে একাধিক অনুষ্ঠান আয়োজনের পাশাপাশি পোশাক ও অলঙ্কার কেনাকাটা করতে গিয়ে হয় টাকার শ্রাদ্ধ। ঋণ করে হলেও বিয়ের এই ফুটানি করতে গিয়ে অনেক পরিবার দুর্দশায় নিপতিত হয়। বিয়েতে দেয়া হীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পারিবারিক অশান্তি বয়ে আনে। কারণ হীরা বেশিরভাগ মানুষের জন্যেই অশুভ।

আসলে বিশ্ব পুঁজিবাদী চক্র নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থেই ভোজন, বিনোদন এবং জৈবিক চাহিদা পূরণকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে প্রচার করতে মিডিয়াকে ব্যবহার করছে। এজন্যেই মিডিয়াতে বিয়েকে কাল্পনিক এক বিশাল ব্যাপার হিসেবে চিত্রিত করা হয়। অথচ বিয়ে একটি সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা যার মাধ্যমে দুজন নর-নারীর জৈবিক চাহিদা পূরণের বিষয়টিই সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা পায়। তাই একটি স্বাভাবিক ঘটনাকে আকাশ কুসুম মনে করা এবং এর জন্যে অপচয়ে মত্ত হওয়া অবিদ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। বরং এই খরচ, ধুমধাড়াক্কা, অপচয় শুধু অকল্যাণই বয়ে আনে। যে বিয়েতে ধুমধাড়াক্কা অপচয় যত বেশি, সে বিয়েতে সুখের পরিমাণ তত কম।

সুখী বিয়ের জন্যে করণীয় (মেয়ে পক্ষ)

সুখী বিয়েই একটি সুখী পরিবারের সবচেয়ে গুরুতপূর্ণ পূর্বশর্ত। এজন্যে পাত্র এবং পাত্রী দু’পক্ষকেই জানতে হবে বিয়ের সঠিক কিছু দৃষ্টিভঙ্গি, মানতে হবে সহজ কিছু করণীয়।

১. ছোটবেলা থেকেই কন্যাসন্তানকে আত্মপরিচয় সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করুন। বিয়ের আগে লেখাপড়া শেষ করে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দিন।

২. আপনার মেয়ে যাতে সবসময় মনে করতে পারে যে আপনি তার পাশে আছেন। বিয়ের পর মেয়ে হয়ে যায় পরের, বাবার বাড়ির সঙ্গে আর তার সম্পর্ক রাখা যাবে না-এটা ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি। মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের শিকার হয় এ মানসিকতার কারণেই।

৩. মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না বলে তাকে খোঁটা দেবেন না, কটু কথা শোনাবেন না। তার প্রতি সমমর্মিতা পোষণ করুন।

৪. বিয়েকেই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরবেন না। শুধু চেহারা বা রূপসজ্জা নয়, তাকে তার মেধা বিকাশের জন্যে উৎসাহিত করুন। তাকে বোঝান রূপের প্রশংসা সাময়িক। গুণের কদর চিরন্তন। তাই গুণকে বিকশিত করুন।

৫. বিয়ের সিদ্ধান্তে তাড়াহুড়ো করবেন না। পাত্র/পাত্রী পক্ষের লৌকিক আচরণ দেখেই মুগ্ধ হবেন না। সব ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিন। বিয়ে হওয়া উচিত সম-সামাজিক এবং সম-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। আর পরিচিত গণ্ডীতে হলে তা আরো ভালো।

৬. যৌতুক দেবেন না। অর্থের বিনিময়ে কখনো সুখ কেনা যায় না। অর্থ এমন একটি দুষ্টচক্র তৈরি করে যে, যত পাওয়া যায় তত এর অভাববোধ বাড়তে থাকে।

৭. নির্যাতন, অবহেলা, বিশ্বাসভঙ্গ বা অন্য কোনো গুরুতর কারণে যদি বিয়ে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয় তাহলে মেয়ের পাশে দাঁড়ান। সামাজিক নিন্দা বা পারিবারিক কলংক ইত্যাদি কারণ সামনে এনে বিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্যে মেয়ের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করবেন না। বরং এসব ক্ষেত্রে বাচ্চা হওয়ার আগেই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়া ভালো।

৮. একটা বাচ্চা হলে আপনার সংসারে শান্তি ফিরে আসবে, স্বামী ভালো হয়ে যাবে এ আশায় তাড়াহুড়ো করে সন্তান নেয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে সন্তান হওয়ার পর অশান্তি আরো বেড়ে গেছে এবং তখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়া আরো কঠিন হয়ে গেছে। আর তাছাড়া পারিবারিক অশান্তির মধ্য দিয়ে যে শিশু জন্মায় বা বেড়ে ওঠে তার মানসিক ভারসাম্য সবসময়ই নড়বড়ে অবস্থায় থাকে।

এসএ/


 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি