ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ নভেম্বর ২০২৪

বি. চৌধুরী-ড. কামালের ঐক্যকে যেভাবে দেখছে আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত : ২০:০৬, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ২০:১৪, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

দেশের রাজনীতিতে সম্প্রতি যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। সেই মাত্রার নাম বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য। ১৪ দলীয় জোট ও ২০ দলীয় জোটের বাইরে এই জোট নিয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক পাড়া বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে।

মূলত নির্বাচনকে সামনে রেখে সাবেক রাষ্ট্রপতি বিকল্পধারা প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও গণফোরাম সভাপতি বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে এই ঐক্য প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। এই প্রক্রিয়াকে নতুন মেরুকরণ হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এর আগে বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জাসদ সভাপতি আসম আব্দুর রব ও নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিলেন। ডাকঢোল পিটিয়ে ওই ফ্রন্ট গঠিত হলেও রাজনীতির ময়দায়ে সেটি কোনো উত্তাপ ছড়াতে পারে নি।

হঠাৎ করেই বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের আওয়াজ উঠে বিরোধী রাজনৈতিক অঙ্গনে। এই জোট গঠনে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। বিএনপি ঘরানার কয়েকজন বুদ্ধিজীবী এই ঐক্য গড়ে তোলার আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

দফায় দফায় রুদ্ধদ্বার বৈঠক হলেও আনুষ্ঠানিক ঐক্যের ঘোষণা এখনও আসে নি। এছাড়া এই জোটে বিএনপির অন্তর্ভূক্তি নিয়ে রয়েছে মত দ্বিমত। বিএনপি নির্বাচন সামনে রেখে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য চাইলেও যুক্তফ্রন্ট নেতারা এবং ড. কামাল চাচ্ছেন জামায়াতকে বাইরে রেখে বিএনপি এই ঐক্যে আসুক। কিন্তু বিএনপি দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতকে বাদ দিতে চাইছে না। এ নিয়ে এক ধরণের দরকষাকষি চলছে।

ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে তারা বিভিন্ন জোট উপজোট ও সংলাপের প্রস্তাব করলেও এবারের জোটকে রাজনীতি বিশ্লেষকরা দেখছেন ভিন্ন ভাবে। কেন নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে রাজনীতিতে তাদের এই সক্রিয় মনোভাব তা অনেককেই ভাবিয়ে তুলেছে। রাজনৈতিক পর‌্যবেক্ষকদের কেউ কেউ মনে করছেন এটা নিছক যুক্তফ্রন্ট নেতাদের নিজেদের আলোচনায় রাখার কৌশল। আবার কেউ কেউ মনে করছেন অন্য কোন শক্তির ইন্ধনে তারা নিজেদের রাজনৈতিক `ফ্যাক্টর` হিসেবে দাঁড় করাতে চাচ্ছেন।

আবার কেউ বলছেন, এটা সরকারী দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল। নির্বাচনের আগে এমন একটি প্লাটফর্মকে নির্বাচনে এনে আওয়ামীলীগ কৌশলে বিএনপিকে আলোচনার বাইরে ফেলে দিতে চাচ্ছে বলেও মনে করছেন অনেকে।

ইতোমধ্যে ড. কামাল- বি চৌধুরীদের এই জোট নিয়ে রাজনীতির মাঠে আলোচনা যেমন হচ্ছে তেমনি সমালোচনাও কম হচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে তৃতীয় জোটের নেতাদেরকে `গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল`, `ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার` বলেও অভিহিত করা হচ্ছে।

ড. কামাল হোসেন এক সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই সহচর দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের বাইরে থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান প্রনয়নে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা সর্বজন স্বীকৃত। অন্যদিকে বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হাত ধরে রাজনীতি শুরু করা মানুষ। বিএনপি`র রাজনীতি তাকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করলেও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েই তাকে বিএনপি ছাড়তে হয়।

জোট গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত আসম আব্দুর রব ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে সারাদেশে জনপ্রিয়তা পেলেও পরবর্তীতে ছাত্রলীগ ছেড়ে নিজেরা জাসদ গঠন করেন। পরবর্তীতে জাসদ- এর নানা ভাঙ্গনের ভেতর দিয়েও তিনি এখনো একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যা জেএসডি নামে পরিচিত।

ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীতে দল ছেড়ে এসে `নাগরিক ঐক্য` ব্যানারে কাজ শুরু করেন। একটা বিষয় এখানে স্পষ্ট। তা হলো তারা প্রত্যেকে বড় দল ছেড়ে আসা নেতা। তবে বড় দল ছেড়ে এসে আলাদা দল করলেও কেউই রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থান নিতে পারেননি।

দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের প্রতি গণমানুষের আস্থায় বারবার ঘাটতি প্রমাণিত হলেও তারা বিরোধী দলীয় অবস্থান থেকে তাদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। জাতীয় প্রেস ক্লাব কেন্দ্রীক মানববন্ধন, গোলটেবিল বৈঠক ও মাঝে মধ্যে টেলিভিশন টকশোতে তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তবে এটাও সত্য পড়াশুনা, সুশীল মনোভাব, পরিচ্ছন্ন ইমেজ, রাষ্ট্রীয় যে ককোন ইস্যুতে কথা বলা, বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কসহ নানা বিষয় মিলিয়ে তাঁদের ব্যক্তি ইমেজ মোটেও ফেলনা নয়।

ভোটের রাজনীতিতে সরকারী দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপি`র অবস্থান শক্তিশালী একথা যেমন সত্য তেমনি আওয়ামী লীগের ইঁদুর বেড়াল খেলা সব সময় বিএনপি`র সঙ্গে চলে এটাও মিথ্যা নয়। সেই বিএনপি ড. কামাল - বদরুদ্দোজা চৌধুরী নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে দাবি করা হচ্ছে। যদিও বা ইতোমধ্যে বিএনপিকে এজন্য চারটি শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে জোটের পক্ষ থেকে।

যার প্রথমটি হচ্ছে বিএনপিকে তার নেতৃত্বাধীন জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দিতে হবে। তবে সব মিলিয়ে বিএনপি এই জোটে যোগ দেবে কীনা তা নিয়ে এখনো নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছেনা।

ইতোমধ্যে সাত দফা দাবি উথাপন করা হয়েছে ড. কামাল হোসেন- বদরুদ্দোজা চৌধুরী নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষ থেকে। দাবিগুলোও প্রমাণ করে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার মানসিকতা নিয়েই এই জোট। প্রশ্ন হলো এই জোটকে কীভাবে দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নূহ উল আলম লেনিন বৃহৎ জোট গঠনের প্রকিয়া সম্পর্কে বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে এরকম জোট হতেই পারে। এটা গণতন্ত্রের অংশ। কিন্তু প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। তা হলো ড. কামাল হোসেন সাহেবরা এতোটাই গণবিচ্ছিন্ন যে তাদের এই জোট নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে কি-না? বিগত সময়েও তারা অনেকবার অনেক কিছু করতে চেষ্টা করেছেন। যার কোনটিই ফলদায়ক হয়নি।

নূহ উল আলম লেনিন আরো বলেন, আইনজীবী হিসেবে ড. কামাল হোসেনের একটা ইমেজ আছে। সেই ইমেজ আইনজীবী হিসেবে, রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়। মানুষ যদি ড. কামাল - ডা. বি চৌধুরীদের ভোট দিয়ে পার্লামেন্টে পাঠায় তাহলে পার্লামেন্টের জন্য ভালো। নানা মতের মানুষদের সমন্বয়ে পার্লামেন্ট সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু তারা জোট করে কতটা সফল হবে সেটি সময়ই বলে দেবে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মণি বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক উদ্যোগকে আওয়ামী লীগ স্বাগত জানায়। তবে দেখতে হবে সেই উদ্যোগটা যারা নিল তারা কারা? খেয়াল করলে দেখবেন তৃতীয় জোটের নামে যারা একতাবদ্ধ হচ্ছেন তারা প্রত্যেকেই অতীতে জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তাদের অতীতের কাজকর্ম জনগণের জন্য ক্ষতিকর। তবে হ্যাঁ, ড. কামাল সাহেবরা যদি ইতিবাচক কোনো বিষয় জাতির সামনে নিয়ে আসেন তাহলে অবশ্যই স্বাগত জানাব।

সরকার এই জোটকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছে কী-না এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. দীপু মণি বলেন, সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে না। কারণ, যারা এই জোটের সঙ্গে নানা ভাবে জড়িত তাদের কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই। নানা সময় তারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। অতীতেও তাদের কোনো কর্মসূচী জনগণ গ্রহণ করেনি।

কিন্তু বিএনপি যদি এই জোটে যোগ দেয় তাহলে ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব পড়বে কিনা এমন প্রশ্নে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষ ভীষণ শান্তিপ্রিয়। যারা অতীতে মানুষ পুড়িয়েছে, ভাংচুরের রাজনীতি করেছে, লুটপাট করেছে তাদেরকে মানুষ পুণরায় প্রশ্রয় দেবে তা মনে হয় না।

এই জোট ভোটের ময়দানে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদকে এ বিষয়ে বলেন, জিরো প্লাস জিরো সমান জিরো। তিনি আরো বলেন, ড. কামাল সাহেবরা যদি জামায়াতসহ ঐক্য করেন তাহলে সেটা হবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রতারণা। আর যদি জামাতকে বাদ দিয়ে জোট করেন তাহলে সেটা হবে নতুন প্রক্রিয়া।

এই তৃতীয় জোট মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক কৌশল নেবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে হাছান মাহমুদ বলেন, আওয়ামী লীগ গণনির্ভর সংগঠন। জনগণের ভালবাসা নিয়েই আমরা চলি। অন্য কারো বিরুদ্ধে কৌশল অবলম্বন করার কোন দরকার আওয়ামী লীগের নাই।

এদিকে বৃহত্তর জোট গঠনের প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানালেও এই জোটের ব্যানারে কোনো ধরণের সহিংস কর্মসূচিকে কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দু’দিন আগে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, যে কোনো গণতান্ত্রিক ও অসহিংস কর্মসূচিকে আমরা স্বাগত জানাবো। কিন্তু জোট গঠনের নামে, আন্দোলনের নামে কোনো ধরণের সহিংসতা বরদাশত করা হবে।

এমতাবস্থায় ড. কামাল - বি চৌধুরী নেতৃত্বাধীন জোট রাজনীতিতে কোনো ফ্যাক্টর আসলেই হবে কী-না বা আগামী নির্বাচনে কোন প্রভাব ফেলতে পারবে কি-না সেটি নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌছে আরও কটা দিন অপেক্ষা করতে হবে।

অা অা// এআর


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি