ঢাকা, সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বীরঙ্গনা সখিনা

আনোয়ার হোসেন শাহীন

প্রকাশিত : ১০:৫৩, ২৬ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ১২:০৫, ২৬ আগস্ট ২০২০

বীরাঙ্গনা সখিনার মাজার। ছবিটি তুলেছেন এসইউ আহমদ।

বীরাঙ্গনা সখিনার মাজার। ছবিটি তুলেছেন এসইউ আহমদ।

Ekushey Television Ltd.

ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা মাওহা ইউনিয়নের কুমড়ি গ্রামের কুন্দ-কুশোম গাছের ছায়াঘেরা প্রকৃতির নির্জন পরিবেশে ইতিহাস খ্যাত বঙ্গ বীরঙ্গনা সখিনা ঘুমিয়ে আছেন। সমাধিক্ষেত্রটি চারপাশে বসন্তকালে ফুলের মৌ মৌ গন্ধে মুখরিত হয়, যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। এই আঁকা বাকা গাছগুলো দেখে মনে হবে খুবেই প্রাচীন। অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠা গাছগুলো সকলের নজর কাড়ে।

এলাকায় মহিলারা প্রতিপ্রাণা সখিনার সমাধিতে মানত শিন্নি নিয়ে আসে। কালেভদ্রে আসে কিছু পিকনিক পাটি। ঈশাখার শেষ বংশধর জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান ফিরোজ খাঁ কেল্লাতাজপুরের অধিপতি মোঘল সম্রাটের অনুগত উমর খাঁর কাছে তাঁর গুনবতী কন্যা সখিনাকে দেখে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্ত পিতা ওমর খাঁ বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে ফিরোজ খাঁ তাজপুর আক্রমণ করে কেল্লা বিধ্বস্ত করেন। ফিরোজ খাঁ সখিনাকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে বঁধুবেশে জঙ্গলবাড়ী রাজপ্রাসাদে নিয়ে যান।

এদিকে সখিনার পিতা উমর খাঁ এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মোগলদের শরণাপন্ন হন। ফলে দু’ পক্ষের মধ্যে  প্রচন্ড যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধ বিদ্যা ও অশ্ব চালনায় পারদর্শী সখিনার মেহেদীর রঙ মুছে যাবার আগেই স্বামীকে বাঁচানোর জন্য রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে রণে রণঙ্গিনী হয়ে তেজোদ্দীপ্ত  পুরুষ যোদ্ধাবেশে স্বামীর পক্ষে বীররূপে পিতা উমর খাঁর বিরুদ্ধ রণাঙ্গনে সৈন্য পরিচালনা করেন এবং কেল্লার দরজা ভেঙে ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেন। 

কবির ভাষায়-
‘আড়াইদিন হইল রণ কেউ না জিতে হারে/আগুন লাগাইল বিবি কেল্লাতাজপুর শ’রে।/বড় বড় ঘর- দরজা পড়িয়া হইল ছাই,/রণে হারে বাদশার ফৌজ শরমের সীমা নাই।/ দিনে- দুপুরে কাটিল হেলিয়া পড়ে বেলা।/ঘোড়ার উপর থাকিয়া বিবি লড়িছে একেলা।’

নিশ্চিত পরাজয় জেনে উমর খাঁ প্রতারণার আশ্রয় নেন এবং ছদ্মবেশী সেনাপতি সখিনার কাছে দূত মারফত নিদের্শপত্র দেখান। নির্দেশপত্রে সম্মিলিত মোগল শক্তির বিরুদ্ধে জঙ্গলবাড়ীর বিজয়ের সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। আরো উল্লেখ থাকে যে, ফিরোজ খা সখিনাকে তালাক দিয়ে  উমর খাঁর সাথে সন্ধি স্থাপন করেন। সর্বোপরি তরুণ সেনাপতিকে যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়।তখন ছদ্মবেশী সখিনা স্বামীর আচরণে স্তম্ভিত হয়ে  পড়েন। ‘যার জন্য জ্বলে আগুন জঙ্গলবাড়ী শ’রে,/ তালাক দিছে দেওয়ান সেই সখিনারে’।


শিল্পী দিলীপ সরকারের অঙ্কিত  কাল্পনিক বীর নারী বীরঙ্গনা সখিনার যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি

স্বামীকে বিজয়ী করার লক্ষে যে নারী পিতাকে শত্রু মনে  করে তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন, সেই নির্দেশনামা পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন বীরাঙ্গনা সখিনা।

‘সখিনা তালাকনামা  ঘোড়ার উপর পড়ে/ সর্পে দংশিল যেন বিবির শিরে।/ঘোড়ার পিষ্ঠ হতে বিবি ঢলিয়া পড়িল/ সিপাই-লস্কর যত চৌদিকে ঘিরিল’।

এরপর ঘোড়ার উপর থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সখিনা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
‘আউলিয়া পড়িল বিবির মাথার  দীঘল কেশ/ পিন্দন হতে খুলে কন্যার পুরুষের বেশ’।

পতিপ্রেমে পাগল সখিনার জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। যুদ্ধের ময়দানে তাঁর করুণ মৃত্যু ঘটে। সেই বীর নারী  সখিনাকে কেল্লাতাজপুরের অদুরে কুমড়ি গ্রামে সমাহিত করা হয়। জানা যায়, ফিরোজ খাঁ সখিনার কবরে প্রতিসন্ধায় মোমবাতি জ্বালিয়ে দিতেন এবং সমাধীর পাশে একটি মসজিদ  নির্মাণ করে ধর্মে- কর্মে মনোনিবেশ  করেন। ইতিহাসের কি মহান সাক্ষী এই মহিয়সী নারী। পরাক্রমশালী রাজা উমর খাঁর রাজ্য আজ আর নেই। এ এক অবহেলিত জনপদ। 


বীরাঙ্গনা সখিনার কবর। ছবিটি তুলেছেন এসইউ আহমদ।

কেল্লাতাজপুরের এই মর্মস্পর্শী ঘটনা এ দেশবাসীর অজানা নয়। এ কাহিনীকে নিয়ে কবি- সাহিত্যিকরা অনেক গল্প, নাটক, যাত্রা, সিনেমা, গীতিনাট্য তৈরি করেছেন। কিন্তু স্মৃতি বিজরিত এই ঐতিহাসিক স্থানটি সম্পর্কে সরকার বরাবরই উদাসীন। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রচীন এই গৌরবগাঁথা অমর স্মৃতিকে সংরক্ষণ করে  পর্যটন কেন্দ্র করে আপামর দেশবাসীকে জানার সুযোগ করে দিন।

(তথ্যসুত্রঃ কাজী এম এ মোনায়েম এর গৌরীপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য কিংবদন্তী ও পাক্ষিক সুবর্ণ বাংলা)।

এমবি//


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি