বেগম রোকেয়া পদক পেলেন সদরপুরের রহিমা খাতুন
প্রকাশিত : ০৯:৫৪, ১১ ডিসেম্বর ২০২২ | আপডেট: ১০:২৬, ১১ ডিসেম্বর ২০২২
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পদক নিচ্ছেন রহিমা খাতুন
রহিমা খাতুন, এ সময়ের রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের যোগ্য উত্তরসূরী। সারাজীবন লড়ে গেছেন অবহেলিত ও গ্রামের নারী শিক্ষার জন্য। ফরিদপুরের সদরপুরে শত বাঁধা, শত কথা এড়িয়ে নিজের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে গেছেন তিনি।
সময়টা তখন ১৯৮১ সাল। তিনি আসেন ফরিদপুরের সদরপুরে। এসে দেখলেন নারী শিক্ষার অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। শুরু হলো তার স্বপ্ন দেখা। কিভাবে তাদের শিক্ষার আলোতে আনা যায়? ভাবতে লাগলেন তিনি।
তখন সদরপুরে মাত্র ৩টি স্কুল ছিল। আমিরাবাদ ফজলুল হক পাইলট ইনস্টিটিউশন, বাইশরশি শিব সুন্দরী একাডেমী এবং বাবুরচর উচ্চ বিদ্যালয়।
বাইশরশি শিব সুন্দরী একাডেমী এবং বাবুরচর উচ্চ বিদ্যালয় ছিল সদরপুর থেকে বেশ দূরে। যেখানে সদরপুরের মেয়েরা যেয়ে পড়াশোনা করতে পারত না। আর আমিরাবাদ ফজলুল হক পাইলট ইনস্টিটিউন যা ছিল খরশ্রোতা নদী ভুবনেশ্বর নদের ওপারে। সেখানে যেতে বাশের সাঁকো পাড়ি দিতে হতো। যা ছিল মেয়েদের জন্য দুরূহ ব্যাপার।
সকল বিষয় পর্যবেক্ষণ করে নারীশিক্ষার অগ্রগতির জন্য ১৯৮১ সালেই রহিমা খাতুন বেগম কাজী জেবুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু করলেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারী শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে মেয়েদের অভিভাবকদের বোঝাতে। এভাবে লোকদের বুঝিয়ে, কারও আবার বাজে মন্তব্য শুনে ছাত্রী সংগ্রহ করতে লাগলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বেগম রোকেয়া পদক জয়ী বিশিষ্ট পাঁচ নারী
সে বছর তার বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ৫ জন, ৭ম শ্রেণিতে ২ জন এবং ৮ম শ্রেণিতে ১ জন, মোট ৮ জন ছাত্রী ভর্তি হয়। তাদের নিয়েই শুরু করেন তার স্কুলের পাঠদান কার্যক্রম।
তৎকালীন সময়ে নারী শিক্ষাকে অনেক বাঁকা চোখে দেখা হত। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। যখন বাড়িতে কোনো মেয়ের পুরুষ অভিভাবক না থাকতেন তখন লুকিয়ে লুকিয়ে যেতেন সেই মেয়ের মা বা বোনের কাছে, বুঝিয়ে বলতেন নারী শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে।
তার অক্লান্ত পরিশ্রমে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১ বছর পর ১৯৮২ সালে স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় ১৭ জন ছাত্রী। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম শুরু করেন নারীশিক্ষার প্রসারে। যতই বাধা আসুক হাল ছাড়েননি রহিমা খাতুন। শত বাঁধা মাড়িয়ে নিজের অভিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে গেছেন।
এরপর ধারাবাহিকভাবে তার স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকে। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের মূল্য দেয় এলাকাবাসী। একসময়ের ৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা করা প্রতিষ্ঠানটিতে ২০১৫ সালে ছাত্রীসংখ্যা দাঁড়ায় ১৪শ’।
শুধু পড়াশোনা নয় তিনি মেয়েদের অন্যান্য বিষয়েও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সদরপুর উপজেলা শিল্পকলা একাডেমীর একজন সক্রিয় সদস্য। ফলে তিনি ছাত্রীদেরকে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক চর্চা করাতেন।
রহিমা খাতুন তাদের নিয়ে যেতেন জেলা শহর ফরিদপুরে। ছাত্রীদের খেলাধূলা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করাতেন। এভাবে তিনি ছাত্রীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন।
এছাড়াও তিনি বেগম কাজী জেবুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়কে সরকারিকরণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে ২০১৬ সালে স্কুলটি সরকারিকরণ হয়। কিন্তু তার ১ বছর আগেই ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে তিনি এই বালিকা বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষিকার পদ থেকে অবসরে যান।
জেবুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয় ছাড়াও ১৯৮৭ সালে সদরপুরে প্রতিষ্ঠিত সদরপুর মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষও ছিলেন তিনি। সদরপুরের নারীশিক্ষাকে সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে যেতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন এই মহিয়সী নারী।
১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর যশোর জেলার ঝিকোরগাছা থানায় জন্ম গ্রহণ করেন রহিমা খাতুন। সদরপুর তার পৈতৃক নিবাস। তার পিতা ও মাতা হলেন আবদুস সামাদ শিকদার ও জাবেদা বেগম। তার বর্তমান বয়স ৬৭। তার স্বামী স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং সাবেক চেয়ারম্যান কাজী খলিলুর রহমান।
বর্তমানে রহিমা খাতুন বাল্যবিবাহ, প্রতিবন্ধীদের সংগঠন ‘অগ্রণী সমাজ উন্নয়ন সংস্থায়’ কাজ করছেন।
নারী শিক্ষার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করা এই নারী ২০২২ সালে বেগম রোকেয়া পদক পেয়েছেন। শুক্রবার (৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ৫ নারীকে পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সম্মানস্বরূপ দেওয়া হয় একটি স্বর্ণপদক, চার লাখ টাকার চেক ও সনদপত্র।
পদক পাওয়ার পর নিজের অনুভূতি জানতে চাইলে রহিমা খাতুন বলেন, অবশ্যই অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে এই পদক। আগামী দিনে এই পদক আমাকে আরও কাজ করতে উৎসাহ দিবে।
তিনি আরও বলেন, “নারী শিক্ষার কাজ করতে ওই সময় যারা উৎসাহ দিয়েছেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। বিষয় করে তখন বাবু রমেন্দ্রলাল ভৌমিক আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। এছাড়া স্বামী, সন্তান ও আত্মীয়স্বজনসহ সদরপুরবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ।”
এএইচ