বৈশাখ, দেবে কি সাত রঙের একটি ফুল?
প্রকাশিত : ১১:১৯, ১৪ এপ্রিল ২০১৯
বৈশাখ বাঙালির জীবনে শুধু ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠায় চিহ্নিত একটি দিন মাত্র নয়। পথ চলার সহায়কশক্তি। এ শক্তিকে অবদমন করার চেষ্টা করেছিল পাকিস্তান সরকার। পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিষিদ্ধ করেছিল।
সরকারি ছুটি বাতিল করেছিল। বাঙালির অমিত শক্তির সামনে সেই অবদমন ধোপে টেকেনি। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন তার অমিত শক্তির বিশেষ দিক। এদিক বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সীমান্ত অতিক্রম করেছে। বৃহত্তর সামাজিক পাটাতনের পরিসর বাড়িয়েছে। সৃষ্টি করেছে উদ্যম ও ব্যাপ্তিতে জাতিসত্তার বলয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাঙালিদের দ্বারা আয়োজিত বৈশাখী উৎসব আজ নিজেদের পরিচয়ে উজ্জ্বল উদ্ধার।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা। অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ বৈশাখ, তোমার চেয়ে আর কে বেশি জানে যে এ দুটো পঙ্ক্তি একজন কবির শুধু ঋতুবন্দনা নয়, কবি জীবনের কল্যাণে প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করেছেন। বছর ধরে জমে ওঠা গ্লানি ও জীর্ণতাকে দূর করে ধরণীকে শুচি করার কথা বলেছেন। সারা বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাওয়ার মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন। এ মন্ত্র ধূলিমলিন জরাগ্রস্ত পৃথিবীর চেতনা, যে বোধ জীবনের অবমাননা ঘটায়, তাদের দূর করে জীবনের দার্শনিক সুন্দরকে প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন কবিগুরু। এ সত্য মঙ্গলের সাধনার গভীর বোধটি বাংলা নববর্ষে সব বাঙালির ভেতরে থাকুক- এ আহ্বান ধ্বনিত হয় এই দিনকে কেন্দ্র করে। হে বৈশাখ, আমরা তোমার দিনের শুরুর যাত্রাকে স্বাগত জানাই। তুমি আমাদের জীবনে নববর্ষের সূচনা কর।
সেজন্য আমরা সমবেত কণ্ঠে বলতে চাই, নববর্ষ একটি নতুন, অন্যরকম সূর্যোদয় উদ্ভাসিত করো বাংলাদেশের মানুষের জীবনে। আমরা নতুন আলোয় দেশটাকে দেখতে চাই। এখনও অনেক জঞ্জালে ভরে আছে এ দেশের মানুষের জীবন। আমরা নতুন সূর্যোদয়ের দিকে তাকিয়ে বলতে চাই, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
আমরা তোমাকে চাই বৈশাখ। তোমার রুদ্র বৈশাখী জরাজীর্ণ পাতা উড়িয়ে নেয়ার অমিত শক্তি, শান্ত-স্নিগ্ধ তারাভরা আকাশ, বৃষ্টির অপরূপ ছোঁয়া। দহন ও স্বস্তির সমন্বয়ে আমরা ভরে তুলতে চাই জীবনের বিশাল ক্যানভাস।
তোমার কাছে প্রার্র্থনা বৈশাখ, রঙধনুর সাত রঙ দিয়ে একটি ফুল বানিয়ে দাও আমাদের। আমরা এই দেশের জন্য জীবনদানকারী লাখো শহীদের স্মরণে ভরে দেই স্মৃতিসৌধ, দেশজুড়ে গড়ে ওঠা স্মৃতিস্তম্ভ ও গণকবরগুলো। আমরা শহীদের পবিত্র আত্মাকে বলতে চাই, আমাদের হৃদয়ের সবক’টি জানালা তাদের জন্য খোলা আছে। ফুলের রঙে ভরে উঠুক দিগন্তরেখা পর্যন্ত টানা স্বদেশের সীমানা। সৌরভে ভরে উঠুক প্রতিটি মানুষের হৃদয় এবং প্রায় ষোল কোটি মানুষ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণে রাখুক শহীদদের। এ স্মরণ যেন কোনোদিনের বেড়াজালে বন্দি না থাকে। বৈশাখ, দেবে কি সাত রঙের একটি ফুল? বৈশাখ, তোমার কাছে একটি গাড়ি চাই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের লাল-সবুজ-হলুদ রঙের পতাকাটি দিয়ে সাজানো গাড়ি। যুদ্ধের সময়ে যেসব বীর নারী পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত হয়ে স্বাধীনতার মতো মহান গৌরবকে সত্য করে তুলেছিলেন আমাদের জীবনে, তাদের আমরা দিনের আলোয় স্নাত করতে চাই। তাদের আমরা দেশের প্রতিটি জনপদে নিয়ে যেতে চাই। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দিনমজুর মানুষটিও বলুক, আপনাদের কোনো লজ্জা নেই। সব লজ্জা পুরো জাতির, যারা আপনাদের যোগ্য মর্যাদা দেয়নি। আপনারা তাদের ক্ষমা করুন। বৈশাখ, তাদের কাছে আমাদের অকৃতজ্ঞতার দায় শোধ করার চেতনাকে রুদ্র তাপে প্রজ্বলিত করে দাও। শুধু মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণার মধ্য দিয়ে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন যেন শেষ হয়ে না যায়। তাদের ধৈর্য, সাহস, তাদের ত্যাগ, স্বাধীনতার জন্য তাদের জীবন-মরণের স্বপ্ন যেন এ দেশের প্রজন্মের সামনে আলোর প্রদীপ হয়ে জ্বলে।
প্রিয় বৈশাখের কাছে প্রার্থনা, বৈশাখ, আমাদের স্বর্ণশস্যপ্রসবিনী পলি মাটি মাখানো নলখাগড়ার কলম দাও। আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শস্যদানার অক্ষরে লিখে রাখি। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করুক সেই নাম। ইতিহাসবিকৃতির চক্রান্ত যেন সে নাম ছুঁতে না পারে। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র মুছে দিতে চায় ইতিহাসের জ্বলজ্বলে পৃষ্ঠা। ইতিহাসের খেরো খাতায় নিজেদের তুলে ধরার চেষ্টা করে। বৈশাখ, ‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে’। বৈশাখ, বাঙালিকে একাত্তরের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করে দাও। বাঙালি যেন বলতে পারে, হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে। বৈশাখী ঝড় অনৈক্যের জায়গাটিকে উৎখাত করে ঐক্যের জায়গাটি সমান করে দিক। মানুষ হিসেবে বাঙালির শুভবুদ্ধি একাত্তরের চেতনার মতো দীপ্ত হয়ে উঠুক। স্বদেশ যেন বাঙালির চেতনার সবটুকু জায়গায় অমলিন থাকে, যেন সে বোধে কোনো ফুটো তৈরি না হয়। যেন ব্ল্যাক হোলের মতো সে ফুটো স্বদেশকে গ্রাস না করে। বৈশাখ, বড় মিনতি তোমার কাছে। তুমিই তো পার বলতে, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা।’ জাতির জীবনে জমে যাওয়া আবর্জনা দূর করতে বাঙালিকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তুমি বিপুল শক্তি দাও।
কেন তোমার কাছে প্রার্থনা, বৈশাখ? বর্তমান সময়ে জীবনের যাত্রাপথে নারী-শিশু নির্যাতনের ধৃষ্টতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না বলে কি? যে সুষম জীবনব্যবস্থা আমাদের সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দিলে আমরা প্রকৃত মানুষের জনগোষ্ঠী হতে পারতাম বলে কি? বৈশাখ, বড় গভীর প্রার্থনা তোমার কাছে। আমাদের একটি স্রোতস্বিনী দাও। তার স্বচ্ছতোয়া জলধারা ধুয়ে দিক আমাদের পাপ, ভাসিয়ে নিয়ে যাক মানবিক বোধের জঞ্জাল। মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিক বেঁচে থাকার অন্যতম বোধ। সেই স্রোতস্বিনী আমাদের বলবে, ছুঁয়ে দেখো আমার জল। তোমাকে দেবে অমৃতের স্পর্শ। তুমি মানববোধের সবটুকু নিজের মধ্যে ধারণ করে অমৃতের আস্বাদ পাবে। বৈশাখ, তুমি কি এমন একটি বোধের চেতনায় বদলে দিতে পার ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ডকে?
জঙ্গিবাদের মতো অপশক্তিকে নির্মূল করে দাও। বৈশাখ, হে মৌন তাপস, বড় দুঃসময়ের মুখোমুখি এই ভূখণ্ডের মানুষ। আমাদের ভেতরে ধর্মীয় সম্প্রীতি থাকুক। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সিক্ত হয়ে আমাদের প্রার্থনা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে থাকুক, বৈশাখ, হে মৌন তাপস। তাপসের সাধনার নিমগ্ন থাকুক আমাদের সমাজ বিবর্তন।
তোমার কাছে প্রার্থনা, বৈশাখ, যারা গরিবের আমানতের খেয়ানত করে, তাদের কঠোর শাস্তি দাও, যেন তারা টাকার আকার ভুলে যায়। কত প্রকারের নোট হয়, তা-ও ভুলে যায়। তাদের লোভের জিবটাকে ছোট করে দাও, বৈশাখ। তাদের লোভের হাতের আকার ক্ষুদ্র করে দাও, যেন তাদের লোভ ছুঁতে না পারে চালের মূল্য, ডালের মূল্য। যেন ধরতে না পারে মাছ-ফলমূল-শাকসবিজ-মুরগি-হাঁস। তাদের ক্ষুদ্রকায় মানুষ করে বুঝতে দাও যে কীভাবে জীবনের ফুল ফোটাতে পরিশ্রম করতে হয়। অন্যের অধিকারে থাবা দিয়ে অন্যায়ভাবে ভোগদখল জীবনের ধর্ম নয়।
অন্যের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা রাষ্ট্রের সুশাসন নয়। বৈশাখ, কিছু মানুষের দুর্নীতির হাতে বিপুল জনগোষ্ঠীকে জিম্মি করে দিয়ো না। আমরা বলতে চাই, ‘নিষ্ঠুর, তুমি তাকিয়ে ছিলে মৃত্যুক্ষুধার মতো। তোমার রক্ত নয়ন মেলে/ভীষণ তোমার প্রলয়সাধন প্রাণের বাঁধন যত/যেন হানবে অবহেলে।’ দুর্নীতির জাঁতাকল থেকে মুক্ত থাকুক গণমানুষের জীবন। তারা যেন অধিকারের জায়গা থেকে বঞ্চিত না হয়।
তোমার কাছে প্রার্থনা, বৈশাখ, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়, যেন মনুষ্যত্ব বিকাশের অনুশীলনের প্রতিষ্ঠান হয়। আমাদের আগামী প্রজন্ম যেন তোমার নতুন বছরকে নির্মাণ করার জন্য প্রতিজ্ঞাদীপ্ত হয়। বৈশাখী মেলা থেকে আম-আঁটির ভেঁপু কিনে আমাদের সন্তানরা নিজেদের হৃদয় খুলে শিক্ষা নির্যাসে আলোকিত মানুষ হোক। বৈশাখ উদযাপনের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ইউনেস্কো কর্তৃক Intangible Heritage হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। এ গৌরবের জায়গা পরবর্তী প্রজন্ম যেন ধরে রাখতে পারে এ প্রার্থনা তোমার কাছে।
তোমার কাছে প্রার্থনা, বৈশাখ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনকে দেশের মূলধারা জনগোষ্ঠীর কাতারে নিয়ে এসো। তাদের বঞ্চনার অবসান ঘটাও। তাদের বেদনাকে নিজের বেদনায় পরিণত করে বলো, অগ্নিস্নানে শুচি হোক বাংলাদেশ। আমরা সব জনগোষ্ঠীর মানুষ এক হয়ে ফসল উৎপাদন করি, বনভূমি রক্ষা করি, নদী রক্ষা করি, সৃষ্টির যা কিছু মহৎ সুন্দর তাকে আহ্বান করে মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের সমন্বয়ে প্রিয় স্বদেশের ভূখণ্ডকে সুন্দর করি।
আবার সেই আহ্বান, এসো, এসো হে বৈশাখ। তোমার নতুন প্রাণের উজ্জীবিত শক্তিতে আমরা পাহাড়প্রমাণ সমস্যাকে দূর করব। তুমি যদি নতুন বছর নিয়ে আসতে পার, তাহলে আমরাও বছরের রূপবৈচিত্র্যকে ভিন্ন করতে পারব। আমাদের আশাবাদী সংগীতে বাজবে নবপ্রাণের গান। আমরা বলব, বৈশাখ, হে মৌন তাপস... হঠাৎ তোমার কণ্ঠে এ যে আমার ভাষা উঠল বেজে, দিল তরুণ শ্যামলরূপে করুণ সুধা ঢেলে। সমাজজুড়ে মূল্যবোধের অবক্ষয় গ্রাস করেছে নানা দিক। উৎসবের আনন্দ খর্ব করছে অপশক্তি। নিগৃহীত করছে নারীদের। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা উৎসবের সময়কে বেঁধে দিয়ে সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশকে খণ্ডিত করছে। এ আমাদের কাম্য নয়।
আমাদের প্রার্থনায় আশার বাদ্য বাজাও, বৈশাখ। আমাদের অমিত শক্তিকে অভিনন্দিত করো।
সেলিনা হোসেন : কথাসাহিত্যিক
এসএ/