ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

বৈষম্যের পৃথিবী আলোর মাঝেই অন্ধকার,ভৌগলিক অবস্থান ভিন্ন হলেও গল্পটা একই

তানভীর সুমন

প্রকাশিত : ১১:৩৫, ১০ মে ২০২৪ | আপডেট: ১১:৪০, ১০ মে ২০২৪

পাতায়া ঝকঝকে শহর। ১৯৭৮ সালে এই শহরটির নামকরণ করা হয়। একসময় পাতায়া  ছিল থাইল্যান্ড উপসাগরের একটি জেলেপল্লী। সাগরে অল্প কয়েকটি নৌকা এবং তীরে  কিছু কুঁড়েঘর ছাড়া সেখানে, তেমন কিছুই ছিল না। ১৯৫৯ সালের ২৯ জুন নাখন রাচাসিমার সামরিক ঘাঁটিতে থাকা ৫০০ সদস্যের একটি মার্কিন সেনাদল এক সপ্তাহের বিশ্রাম ও বিনোদনে পাতায়ায় আসে। ওই সেনারা সৈকতের দক্ষিণাঞ্চলে  স্থানীয়দের  থেকে কয়েকটি বাড়ি ভাড়া নেয়। একটা সময় পর তাদের মাধ্যমে পাতায়ার সৌন্দর্যের খবর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর  জেলেপল্লীতে সাহেবদের আনাগোনা। বাকিটা শুধুই উন্নয়ন আর আকাশ ছোঁয়ার গল্প।

ব্যাংকক পৌঁছে বিমানবন্দর থেকে সোজা পাতায়া। হোটেলে এসে জিনিষপত্র রেখে সবাই চললাম সুইমিংপুলে। সুইমিং শেষে রুমে গিয়ে একটু রেস্ট করেই। বেরিয়ে পড়লাম সন্ধ্যার পাতায়া দেখতে । সাথে হালকা পাতলা কিছু খেয়ে নিলাম সবাই।

পর্যটকের মনোরঞ্জনের সকল ধরনের ব্যবস্থা আছে এখানে। পথে একটু  পরপর দেখা মিলবে নাইট ক্লাব, বার, রেস্টুরেন্ট এবং  বিভিন্ন ম্যাসাজ পার্লার । টুলের উপর বসে আছে অনেক সুন্দরী তরুণী। তারা আপনাকে বিভিন্ন ধরনের  শরীরের ম্যাসাজ করানোর পরামর্শ দিবে। ঝলমলে পোশাক, চোখে মাস্করা, গালে হালকা গোলাপি রুজ, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। এক কথায় প্রথম ঝলকে নিজেকে আকর্ষণীয় দেখাতে যা যা প্রয়োজন। প্রত্যেকেই আপনাকে ম্যাসাজ করানোর জন্য ডাকবে। কিছুটা পথ হাঁটতেই বুঝতে পারলাম। সারা পাতায়ায় এমন তরুণীদের সংখ্যা কম নয়।

একটু পরেই আমি পাতায়া সাগর পাড়ে চলে গেলাম।  সেখানে বিভিন্ন ধরনের আনন্দকর্মী (যৌনকর্মী) দেখতে পেলাম। একটু বলে রাখা ভালো আমি আসলে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে চাই। কোন পেশা দিয়ে তাকে বিবেচনা করতে চাই না। তাই অন্য কোন ভাষা নয়, আমি যৌনকর্মীকে,  আনন্দকর্মী বা বিনোদনকর্মী হিসেবেই স্বীকৃতি দিতে চাই। কারণ প্রতিটি মানুষের সমাজে কিছু অবদান থাকে । প্রত্যেক মানুষের একটা পিছনের গল্প থাকে।  আজকে আমার উদ্দেশ্য একটি আনন্দকর্মীর পিছনের গল্প জানবো।  কারণ সবার কাছেই মনে হয় থাইল্যান্ড বিনোদনকর্মী বা আনন্দকর্মীদের জন্য বিখ্যাত। এছাড়া আর একটি প্রচলিত ধারণা আছে সবার মধ্যে। প্রতিটা মানুষ থাইল্যান্ডে আসে আনন্দকর্মীদের উপভোগ করতে।

যাইহোক প্রথমে একটু সংকোচ বোধ হচ্ছিল।  এই জাতীয় জায়গা গুলির সাথে জুড়ে থাকে কিছুটা ঘৃণা, কিছুটা অচেনা অজানা ভয় আর মধ্যবিত্ত উন্নাসিকতা। চিরকালই নারীদের থেকে আমার অনেক দূরে বসবাস। জীবনের এতটা পথে হাঁটেছি হাতে গুনা কয়েকজন মেয়ে বন্ধু ছিল আমার। জীবনে মেয়েদের সম্পর্কে যতটুকু অভিজ্ঞতা  অর্জন করছি, সেটা আমার মা আর বাকিটা ওদের কাছ থেকে। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে, একটু সাহস করেই মিশতে চাইলাম ওদের সাথে। তারপর থেকেই ভাঙতে থাকে এই নারীদের সম্পর্কে  আজন্ম লালিত বেশিরভাগ ধারণা। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয় এদের যন্ত্রণার চিত্র। চূড়ান্ত অসাম্যের সমাজের অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের মতোই এরাও বৈষম্য, অবিচার আর লাঞ্ছনার শিকার।

বাংলাদেশের পতিতা পল্লীর একটি মেয়ের সঙ্গে , এদেশের মেয়েদের কতটা মিল! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সাহস করে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন দেশ থেকে এসেছো? কে কে আছে তোমার?  কতদূর পড়াশুনা করেছ? উত্তর দিলো না মেয়েটি। উল্টে আমাকে প্রশ্ন করল, তুমি  কোনদেশ থেকে এসেছ? বললাম বাংলাদেশ। আমাকে পুরোপুরি অবাক করে দিলো বলল। বাংলাদেশ চিনি না । তুমি কি ভারতীয়? সে আরো প্রশ্ন করল, তুমি কি শুধু ঘোরার জন্য? না অন্য কোন কাজে এসেছো?

আমার মনে একটু ভয় কাজ করল। কোন উত্তর না দিয়ে আমি সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মেয়েটি এসে আমাকে থামিয়ে দিল। বলল আমার সঙ্গে সময় কাটাতে চাও? তবে এক রাত ৪০০০ বাথ লাগবে। হোটেলে ফিরে, পুল পাড়ে বসে বারবার মনে হচ্ছিল- কেমন হয় এই মেয়েদের  জীবন? পুলের স্বচ্ছ পানিতে যেন ওদের মুখগুলো ভাসছিল।

 ঝড়ে , নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যাওয়া সর্বস্ব হারিয়ে সম্বলহীন কোন নারী বা স্বামী পরিত্যক্তা কিংবা  নিজের পরিবার-পরিজনদের বাঁচাতে পতিতাবৃত্তিতে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়া অথবা ভালোবেসে কেউ সর্বস্ব লুটে রেখে গেছে এই নিম্ন পল্লীতে। এ যেন ঠিক আমার দেশের রহিমা , সকিনা খাতুন বা আমেনার প্রতিচ্ছবি। আমি একই মুখ দেখেছি তাদের মধ্যে। তাহলে কি? এখানেও  তাদের মতই কেউ? কতটা পার্থক্য বাংলাদেশী আনন্দকর্মী আর এ দেশের আনন্দকর্মীদের মধ্যে।

রাতের পাতায়া  একেবারে ঝলমলে চকচকে, টাকা হলে সব মেলে এখানে। ওয়াকিং স্ট্রিটের দুই ধারে রেস্টুরেন্ট, বার, ডিস্কো সবই খোলা থাকে প্রায় ভোর ৫টা পর্যন্ত।

কাউকে না বলে প্রায় রাত বারোটার দিকে আমি হাজির হলাম সাগর পাড়ে। ওই মেয়েটার ( মিনি) খোঁজে। পেয়েও গেলাম। আমি খুবই অবাক হলাম সে আমাকে মনে রেখেছে। সে অপরুপ এক সাজে সাজিয়েছে নিজেকে। সে আমাকে প্রশ্ন করল সময় কাটাতে চাও। আমি কিছু না বলে শুধু ঘাড় নাড়ালাম। সে বলল ২০০০ বাথ লাগবে। রাত শেষের দিকে তাই একটু কমিয়ে নিচ্ছি। আমি বললাম পারবোনা ১০০০ বাথ দেব চলো। না ১৫০০ বাথ লাগবে। আমি বললাম চলো। সে বলল কোন হোটেল? আমি বললাম সাগরের পাড়ে চলো। সে বলল কেন? এখানে কি করবা? আমি বললাম তোমাকে জানতে চাই। একটু হাসি দিলো বলল ও আচ্ছা। সেই সব ব্যবস্থা করল। বসার জন্য একটা পাটি আর কিছু ফ্রুটস ও কমল পানীয় নিলাম। পরিচয় পর্ব শেষে জানতে পারলাম। অনেক ছোট সময় ও এসেছে নেপাল থেকে। সাথে ওর আর একটা বোন আছে। দুজনেই এই পেশায়। কিছু সময় পর ওর মোবাইল একটা কল আসলো। পরে বুঝতে পারলাম ওর মা ফোন দিয়েছে । ও যখন ফোনে কথা বলছিল তখন ওর চোখ দিয়ে অঝরে অশ্রু ঝরছিল। কিছু  সময় পরে ফোন কেটে চোখ মুছেই, আমাকে বলল আমি খুবই দুঃখিত। আমি খুব অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। একটা মানুষ এতটা বিনয়ী হয় কি করে? তাহলে কি ওরা আর দশটা মানুষ থেকে আলাদা? মনে প্রশ্ন জাগলো। তাহলে আনন্দকর্মীদের যে সংজ্ঞা আমরা জানতাম সেটা কি ভুল? না ভৌগোলিক কারণেই তারা একটু আলাদা। এত বিনয়? একটা মূর্খ মানুষ, যে খুব অল্প বয়সে জীবনের ভয়াবহতা উপলব্ধি করেছে। জেনেছে পৃথিবীতে এক মুঠো খাবারের জন্য কতটা যুদ্ধ করতে হয়। সে কিভাবে এতটা বিনয়ী হয়। তাহলে কি? বিনয়ী মানুষের মূল অস্ত্র? যা দিয়ে পাতায়া থাইল্যান্ড সমস্ত পৃথিবীর মানুষের আকৃষ্ট করেছে? 

যাক  সে কথা। ও ইংরেজি খুব একটা বোঝেনা। একটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা বলতে পারে। এর মাঝে ওর সাথে আমার অনেক কথা হয়ে গেছে। ও আমাকে বারবার বলছে হোটেলে যাবেন না? আমি শুধু হাসলাম। একটু পরে ও বলল আমাকে, আমাকে কিন্তু পুরো টাকাটাই দিতে হবে। আমি আবার একটা হাসি দিলাম। ও বলল সকাল হয়ে যাচ্ছে, আমি বুঝেছি। তবে আপনিই আমার জীবনে প্রথম কোন মানুষ ।যে আমাকে শুধু গল্প করার জন্য টাকা দিচ্ছে। বলার পর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো ও। তবে আমাদের আলাপের মাঝে সাগর পাড়ে ও আমার একটু ভিডিও আর কয়েকটা ছবি তুলে দিয়েছিল। আমি ওর সঙ্গে সেলফি উঠতে চেয়েছিলাম কিন্তু ও রাজি হয়নি। ছবিগুলো সত্যিই আমার ভালো লেগেছে। ওর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত কখনো আমার মনে হয়নি। ও আমাদের সমাজের কেউ না। বরং এতটাই বিনয়ী এতটাই সামাজিক। ওর সাথে মিশার পর, শুধু নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়েছে। মনে হয়েছে আমরা যারা সমাজে আছি। তারা ওর তুলনায় অনেকটা অসভ্য। ওর কাছ থেকে এই অল্প সময়ে অনেক কিছু শিখেছি। সব থেকে বেশি যে জিনিসটা শিখিয়েছে। সেটা হল অনেক কষ্টের মাঝেও কিভাবে হাসতে হয়। কিভাবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে হয়। কিভাবে বিনয়ী হতে হয়।

ওর বাবা মারা গেছে অনেক আগেই। অসুস্থ মা আর দুই ভাই আছে। তাদের জন্য ওর অনেক রোজগার করতে হয়। কোন কাজ না পেয়ে দুই বোন অবশেষে এই লাইনে আসে। এখন অবশ্য সে বেশি খোদ্দের পায় না। তারপরেও সে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে তার পরিবারের জন্য। নিজের পরিবারকে আরেকটু ভালো রাখার জন্য।

হয়তো অন্য কোন কাজ করেও নিজের জীবনটা চালিয়ে নিতে পারতো। কিন্তু থাইল্যান্ডে জীবন যাত্রার নির্বাহের যে ব্যয়, অন্য জায়গায় ইনকাম করে সে তার ফ্যামিলি চালাতে পারতো না। প্রথমে সে তার এক প্রতিবেশীর লালসার শিকার হন। পরবর্তীতে অনেকেই প্রতিশ্রুতি  বা টাকার বিনিময়ে তাকে ভোগ করে। একটা সময় সে নিজেকে মানিয়ে নেয়। মিনির একবার বিয়ে হয় একটা বাচ্চা আছে ওর। পরে আস্তে আস্তে তার বোনসহ সে এ কাজে লিপ্ত হন। একটা পর্যায়ে আরো উন্নত জীবনের আশায় তারা পাতায়া চলে আসে।

এখানে জিনিষপত্রের যা দাম, সেখানে জীবন চালান বেশ কষ্টকর। মুদ্রাস্ফীতি একটা বড় সমস্যা থাইল্যান্ডে। মিনির রুটি-রুজি নির্ভর করে এখানে আসা পর্যটকদের উপরেই। তবে মিনি ও এই সাগর,  দুজনার মাঝে আমি অনেক মিল পাই। সাগর যেমন তার উপরে হাওয়া সমস্ত ভার, অত্যাচার সবকিছু নিরবে হাসিমুখেই মেনে নেয়। মিনিও ঠিক তার মত। এখানে আসা পর্যটকরা মিনির উপরে তাদের রাগ অভিমান ঘৃণা সব ডালে। মিনি নিরবেই মেনে নেয় এই সাগরের মত।

রাত গভীর। আর কিছুক্ষণ পরেই সূর্য্য উঠবে। আচ্ছা এই সূর্যের আলো কি মিনিদের ছুয়ে দেয়? নাকি তাদের কাছে এ আলো যেতে  পারে না? এ জীবন বড়ই অদ্ভুত,  বড়ই কঠিন । কবিগুরুর কবিতার মত।

রূপনারানের কূলে
জেগে উঠিলাম,
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।

রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ,
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়।

সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,
সে কখনো করে না বঞ্চনা।

আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন,
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।

 

সাগর পাড় দিয়ে হাঁটছি। আস্তে আস্তে হোটেলের দিকে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে এ শহর সবার জন্য অনেক নিরাপদ। একা একা হাঁটছি একটুও ভয় লাগছে না। মনে হচ্ছে একটা মস্ত খোলা আকাশ আমার জন্য। মনে হচ্ছে মিনিরা, সখিনারা আমাকে প্রশ্ন করছে। কবে তারা একটি মুক্ত আকাশ পাবে। কবে তারা মুক্ত পাখির মত ডানা মেলে উড়বে। এ প্রশ্নের উত্তর সত্যিই আমার অজানা। জানিনা অসাম্যের সামাজিক শৃংখল  কবে মুক্ত হবে। কবে অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। আর কতটা সময় পেরোলে একমুঠো খাবারের , একটু মাথা গোজার  ঠাই নিশ্চিত হবে। এই পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ,  মানুষ হিসেবেই বাঁচতে পারবে। তবে বিশ্বাস করি এই পৃথিবী একদিন মানুষের পৃথিবী হবে। মানবতার জয়ের ধনী সর্বত্র ধ্বনিত হবে। মানুষকে পণ্য নয় মানুষ হিসেবেই দেখা হবে।  জয় মানুষের জয়, জয় মানবতার জয়।


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি