ঢাকা, বুধবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

ব্রেন : বিস্ময়কর জৈব কম্পিউটার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:১১, ৫ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১৫:৪০, ২০ জুলাই ২০২১

মানবদেহের সবচেয়ে জটিল, রহস্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে ব্রেন বা মস্তিষ্ক। মানব অস্তিত্বের সবকিছু ব্রেন দ্বারা পরিচালিত হলেও ব্রেন সম্পর্কিত মানুষের ধারণা এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছে। মহাকাশ জয়ের কারিগরি নৈপুণ্য, সুপার কম্পিউটারের মতো প্রযুক্তি উদ্ভাবন করলেও মাথার খুলির অভ্যন্তরে অবস্থিত ব্রেন সম্পর্কিত জ্ঞান এখনো একদমই ভাসা ভাসা। ব্রেন সম্পর্কিত জ্ঞান অর্থাৎ আত্ম-জ্ঞান এবং মানুষের মাঝে ব্যবধান হচ্ছে এক মহাসমুদ্রের। এই মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে ব্রেন সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্থাৎ আত্ম-জ্ঞান লাভ করতে পারলেই মানুষ দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গকে ব্যবহার করতে পারবে পরিপূর্ণভাবে। এখনকার অনেক সীমাবদ্ধতা ও মনোদৈহিক অসুবিধাকে অতিক্রম করতে পারবে। নিজের জন্যে সৃষ্টি করতে পারবে সাফল্য ও সম্ভাবনার নতুন মাত্রা। এমআইটি-র নিউরোসায়েন্টিস্ট প্রফেসর ফ্রান্সিস স্মিথের ভাষায়, মানুষ যদি আবিষ্কার করতে পারে কেন সে অনন্য, তাহলে হয়তো সে নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে না। বরং এখনকার চেয়ে নিজেকে বেশি শ্রদ্ধা করবে।

বিশ্বে প্রাণের সর্বশ্রেষ্ঠ বিকাশ বা আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে মানুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে ব্রেনের কারণেই। আগেই বলেছি, দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ব্রেন। হার্টকে বলা যেতে পারে একটা পাম্প মেশিন। ফুসফুসকে বলা যেতে পারে অক্সিজেন সমৃদ্ধকরণ যন্ত্র। কিন্তু মানুষের প্রতিটি কাজের পেছনে নিয়ন্ত্রক শক্তি হচ্ছে ব্রেন। মানুষের সকল চিন্তা ও সচেতনতার কেন্দ্র হচ্ছে ব্রেন। মানুষের সকল উদ্ভাবনী দক্ষতার উৎস হচ্ছে ব্রেন। ব্রেনের এই দক্ষতার কারণে মানবজাতির পূর্বপুরুষরা দৈহিকভাবে তার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাভূত করে শুধু টিকেই থাকে নি, বরং প্রাণিকুলের মাঝে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে। ব্রেনই মানুষকে প্রথম পাথরের অস্ত্র তৈরি করতে শিখিয়েছে। আর সেই ব্রেনের জেনেটিক উত্তরসূরিরাই বানিয়েছে মহাশূন্য যান। মানুষ অতীতে যা করেছে, ভবিষ্যতে যা করবে তা এই ব্রেনেরই ফসল। ব্রেনই মানুষকে ‘মানুষ’ বানিয়েছে।

প্রাচ্যের সাধকরা হাজার হাজার বছর ধরে মস্তিষ্কের শক্তির গুরুত্ব দিলেও পাশ্চাত্য বর্তমান শতাব্দিতে এসেই মাথার খুলির ভেতর অবস্থিত দুর্জ্ঞেয় ও অত্যাশ্চর্য যন্ত্র ব্রেন সম্পর্কে গবেষণা শুরু করেছে। দার্শনিক এরিস্টটল তার ছাত্রদের শিখিয়েছেন হার্টই হচ্ছে চিন্তা ও চেতনার কেন্দ্র, ব্রেন হচ্ছে রেডিয়েটর বা রক্ত ঠান্ডা করার যন্ত্র মাত্র। দার্শনিক প্লিনি প্রথম ব্রেনকে বুদ্ধি ও উপলব্ধির কেন্দ্র বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু তিনি বা তার পরবর্তী বিজ্ঞানীদের ব্রেন নিয়ে গবেষণা করার জ্ঞান বা কারিগরি দক্ষতা কোনোটাই ছিল না।

মানবজাতি ব্রেন সম্পর্কে পুরোদমে গবেষণা শুরু করেছে ৬০-এর দশক থেকে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কয়েক ডজন ল্যাবরেটরিতে মনোবিজ্ঞানী, প্রাণিবিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (MIT) আহূত নিউরোসায়েন্স রিসার্চ প্রোগ্রাম (NRP)। 

১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই এনআরপির ব্রেন সম্পর্কিত গবেষণায় ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, মার্কিন ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটসহ বহু দেশের বিজ্ঞানীরা সহযোগিতা করে আসছেন। ড. ফ্রান্সিস অটো স্মিথের নেতৃত্বাধীন এই প্রোগ্রামের সাথে জড়িত কয়েক ডজন বিজ্ঞানীর মধ্যে আধ ডজন বিজ্ঞানীই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ব্রেনের কার্যক্রম বোঝার ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের এই আগ্রহের কারণ হচ্ছে, ব্রেনের ভেতরে যা ঘটছে তা থেকে ব্রেনের বাইরে যা ঘটছে তাকে আলাদা করা যায় না। তাই প্রতিবছরই বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানী ব্রেনের কার্যক্রম নিয়ে গবেষণায় জড়িয়ে পড়ছেন। যত জানছেন, তত বেশি করে তাদের সামনে ধরা পড়ছে এ জানার সীমাবদ্ধতা। মানুষ পরমাণুকে চূর্ণ করেছে, জেনেটিক কোডকে ভাঙতে সক্ষম হয়েছে। চাঁদে পা রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এখনো স্মৃতি, শিক্ষা, সচেতনতার রহস্য রহস্যই রয়ে গেছে। তাই এখনো সে নিজেকে বুঝতে পারে নি। ড. স্মিথ তাই বলেছেন, 'মানুষকে বুঝতে হলে প্রথম ব্রেনকে বুঝতে হবে।'

কিন্তু ব্রেনকে বোঝা এত সহজ নয়। তাই ব্রেনকে বোঝার এই নতুন বিজ্ঞান নিউরোসায়েন্সের সাথে জড়িত বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা কার্যক্রমে সাফল্যের পথের বাধাগুলোকে কিছুতেই ছোট করে দেখছেন না। কারণ ব্রেন এক অতি জটিল অঙ্গ। কম্পিউটারের সাথে এর তুলনা করা হলেও একটি আধুনিক কম্পিউটার ১০০ বিলিয়ন 'বিট' তথ্য জমা ও মনে করতে পারে। সেখানে ব্রেনের সামর্থ্য অসীম। 

কম্পিউটার অবশ্য ব্রেনের চেয়ে দ্রুত বেতন তালিকা, হিসাব তালিকা, মহাশূন্য যানের গতিপথ নির্ণয় করতে পারে। কিন্তু কম্পিউটার শুধুমাত্র সে কাজগুলোই করতে পারে যা তার নির্মাতা মানুষ তাকে করার জন্যে প্রোগ্রাম করেছে। অপরদিকে ব্রেন অনেক অনেক সূক্ষ্ম কাজ অনায়াসে সম্পন্ন করে। মানুষের হার্ট ও দম মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেন, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেন, গরম কিছুতে ছ্যাকা লাগার সাথে সাথে হাত সরিয়ে নেয় ব্রেন। আর এ নিয়ন্ত্রণ পরিচালিত হচ্ছে মানুষের সচেতনতার অজ্ঞাতে। আর তাছাড়া ব্রেন নিজেকে নিজে মেরামত করতে পারে। ব্রেন নষ্ট হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্রেনের কোনো কোনো অংশ অপর অংশের কাজ রপ্ত করতে ও পরিচালিত করতে শিখতে পারে, যা কম্পিউটার পারে না। কম্পিউটারকে সুইচ অফ করে বন্ধ করে দেয়া যায়, কিন্তু ব্রেনকে বন্ধ করার উপায় নেই। আপনি কাজ করুন বা ঘুমিয়ে থাকুন ব্রেন সবসময়ই সক্রিয় থাকে। শিশমহল বা আয়নার মহলে যেমন একের পর এক নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, তেমনি ব্রেন পারে নিজেকে নিয়েও ক্রমাগত চিন্তা করতে।

কম্পিউটার ও ব্রেনের তুলনামূলক আলোচনা করলেই বোঝা যায়, মানুষ কী বিশাল শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। বিশ্বের একটি সুপার কম্পিউটার হচ্ছে ক্রে-১ কম্পিউটার। এর ওজন ৭ টন। আর মস্তিষ্কের ওজন দেড় কেজি। ক্রে-১ প্রতি সেকেন্ডে চার শত মিলিয়ন ক্যালকুলেশন করতে পারে। মস্তিষ্ক পারে ২০ হাজার বিলিয়ন। ক্রে-১ কম্পিউটার প্রতি সেকেন্ডে ৪০০ মিলিয়ন ক্যালকুলেশন হিসেবে ১০০ বছর কাজ করলে মস্তিষ্কের মাত্র ১ মিনিটের কার্যক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবে। 

ব্রেনের নিউরোনের যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে বিশ্ব টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাকে তুলনা করলে মস্তিষ্কের সামনে এটির তুলনামূলক অবস্থান হবে একটি চীনা বাদামের সমান। দীর্ঘ গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা মাত্র বুঝতে শুরু করেছেন যে, মস্তিষ্ক হচ্ছে এক বিস্ময়কর জৈব কম্পিউটার। যার অসীম সম্ভাবনা এখনো প্রায় পুরোটাই অব্যবহৃত রয়ে গেছে। 
 


সকল প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক

মানুষকে তার পারিপার্শ্বিকতার সাথে সংযুক্ত রাখছে ব্রেন। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রেরিত তথ্যের সমন্বয় ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ব্রেনই মানুষকে সক্ষম করছে নতুন তথ্যের প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণে। এইভাবে সে মানুষকে ক্ষতি বা বিপদ থেকে বাঁচাচ্ছে। আর শরীরের সবকিছু যাতে যথাযথভাবে কাজ করে তা নিশ্চিত করছে। আর এ কাজ করার জন্যে প্রতিনিয়ত শরীরের ভেতরে কী ঘটছে, শরীরের বাইরে কী হচ্ছে, পারিপার্শ্বিকতায় কী ঘটছে- তার সবকিছুই মনিটর করছে ব্রেন। 

দেহের সব যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে ব্রেন। দেহের ভেতরের সকল তথ্য সে পাচ্ছে হরমোন ও রিসিপ্টরের মাধ্যমে। দেহের বাইরের সকল তথ্য পাচ্ছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়, কখনো কখনো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। এই সকল তথ্য সে জমা রাখছে স্মৃতিতে। ব্রেন পুরনো তথ্যের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে দেহের সকল অঙ্গের সাথে যোগাযোগ ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রমের নির্দেশ পাঠিয়ে দেহাভ্যন্তরের সুষম অবস্থা বজায় রাখছে আর পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কেও ব্যবস্থা নিচ্ছে। 

ব্রেনের তথ্য ধারণক্ষমতা অসীম। সচেতন বা অবচেতনভাবে দৈহিক বা মানসিকভাবে আপনি এখন যা করছেন বা যে পদক্ষেপ নেবেন তা সাধারণত নির্ভর করে আপনার অতীত অভিজ্ঞতার ওপর। অর্থাৎ অতীতে যখন এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন, তখনকার ঘটনার ওপর। এটি হচ্ছে 'স্মৃতি'। এই 'স্মৃতি'ই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনার দৈহিক আচরণকে প্রভাবিত করে। আপনি সচেতন থাকুন আর না-ই থাকুন এই স্মৃতিই প্রতিটি দক্ষ সিদ্ধান্ত ও কাজের সংক্ষিপ্ত পথ। 

ব্রেন সেলগুলো যে বৈদ্যুতিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় এবং একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে যে কত সংখ্যক নিউরোন সেলের পারস্পরিক যোগাযোগ প্রয়োজন হয় তা কল্পনা করতে গেলেও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। 

জার্মানির বিখ্যাত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. ম্যানফ্রেড ইগান নিরীক্ষা করে দেখেছেন যে, ব্রেনের কোনো কোনো কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন সংঘটিত হতে সময় লাগে মাত্র এক সেকেন্ডের ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়। তিনি বলেছেন, একটি দ্রুতগামী গাড়ির নিচে পড়া থেকে বাঁচার জন্যে এক পা পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া ও তা কার্যকর করার জন্যে এক লক্ষ নিউরোনের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের প্রয়োজন হয় এবং পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে।

পরিবেশের সাথে দেহের ভারসাম্য বজায় রাখার ওপরই নির্ভর করে আপনার অস্তিত্ব। আপনার প্রাণ-প্রক্রিয়ার সুস্থতা নির্ভর করে বিশেষ পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর । এর সাথে যদি দেহ খাপ খাইয়ে নিতে অক্ষম হয় তবে তার বিনাশ অনিবার্য। যেমন- বাইরের তাপমাত্রা যা-ই হোক দেহের তাপমাত্রা যদি ঠিক না থাকে তাহলে বেশিক্ষণ জীবিত থাকা সম্ভব নয়। অবশ্য ব্রেন বাইরের তাপমাত্রার যে-কোনো পরিবর্তনকে সাথে সাথে ধরতে পারে এবং দেহের তাপমাত্রা অক্ষুণ্ন রাখার জন্যে প্রয়োজনীয় কাজের নির্দেশনা প্রদান করে।

আপনার জীবন ধারণের জন্যে অত্যাবশ্যক প্রাণ-রাসায়নিক প্রক্রিয়া চালু রাখার পুরো কাজই করে ব্রেন। এ প্রক্রিয়া যেমন জটিল তেমনি একটির সাথে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং নির্ভরশীল। এর যে-কোনো পর্যায়ে সমন্বয়ের বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি পুরো প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে দিতে পারে। যেমন- রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া না থাকলে আপনি খাদ্য হজম এবং তা থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে দেহের সর্বত্র প্রেরণ করতে পারতেন না। আবার আপনি যদি খাবার শনাক্ত করতে ব্যর্থ হতেন অথবা শনাক্ত করতে পারলেও যদি সঠিকভাবে হাত ব্যবহার করে তা ধরে ঠিকমতো দুই ঠোঁটের মাঝখানে মুখে প্রবেশ করাতে না পারতেন তাহলে আপনার হজম প্রক্রিয়াও কোনো কাজে আসত না। 

কিন্তু আপনি কোনোরকম চিন্তা না করেই অবলীলায় সামনের খাবার তুলে মুখে দিয়ে চিবানোর সাথে সাথে মুখের গ্রন্থিগুলো লালা নিঃসরণ শুরু করে দেয় আর আপনি কোনো সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়া তা গলাধঃকরণ করে পাকস্থলীতে পাঠিয়ে দেন। 

এনজাইম তৈরি হয়ে শুরু হচ্ছে পাকস্থলীর খাবার হজমের প্রক্রিয়া। হজম প্রক্রিয়ায় শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগৃহীত হচ্ছে। আর রেচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় অংশ শরীর থেকে নির্গত হচ্ছে। ব্রেন দেহের এই পুরো প্রক্রিয়াকে এমনভাবে পরিচালিত করে যাতে করে প্রতিটি কাজ ঠিক সময়ে শুরু হয় এবং ঠিক সময়ে শেষ হয়। একে একটি সুসমন্বিত রিলে রেসের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যদি প্রতিটি প্রক্রিয়ার মধ্যে সমন্বয়ের কোনো অভাব হতো, তাহলে দেখা যেত মুখে খাবার প্রবেশ করার পরও লালা নিঃসরণ হচ্ছে না অথবা খাবার হজম না হয়েই পাকস্থলী, অন্ত্র পার হয়ে রেচন প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে যাচ্ছে।

আমরা আগেই দেখেছি- ব্রেন এই কাজগুলো সুচারুরূপে করতে পারছে দেহের অভ্যন্তরে প্রতিটি অংশের সাথে সংযোগ এবং বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ থাকার ফলে। পঞ্চ ইন্দ্রিয়, কখনো কখনো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ব্রেন পায় বাইরের তথ্য। আর ভেতরের তথ্য সংগৃহীত হয় রিসিপ্টর (Internal receptors)-এর মাধ্যমে। তথ্য পাওয়ার পর এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কার্যকর করার জন্যেও ব্রেন ও শরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গের রয়েছে সংযোগ। 

ব্রেন এই তথ্য সংগ্রহ ও কর্ম নির্দেশনা প্রদান করে দুই পদ্ধতিতে। প্রথমত, অতিদ্রুত পদ্ধতি নার্ভাস সিস্টেমের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের মাধ্যমে (হরমোন দ্বারা) শ্লথ গতিতে। ব্রেন, নার্ভাস সিস্টেম, এন্ডোক্রাইন সিস্টেম, দেহ, পরিবেশ ও বায়ো-ফিডব্যাক কীভাবে পরস্পর পরস্পরকে প্রভাবিত করে ওপরের চিত্র থেকে তার একটা সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

মন, দেহ ও পারিপার্শ্বিকতা পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। চিত্রে দেখুন- ব্রেন কোনো হুমকি দেখা দেয়ার সাথে সাথেই দেহকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত হওয়ার জন্যে কেমিকেল ম্যাসেঞ্জার পাঠাচ্ছে। এই কেমিকেল ম্যাসেঞ্জার আবার ব্রেনকে আরো সতর্ক করার কারণ হতে পারে। পরিণামে ব্রেন মূল বিপদ কেটে যাওয়ার পরও সতর্কসংকেত পাঠানো অব্যাহত রাখতে পারে। এই ফিডব্যাক লুপকে কোনো না কোনোভাবে সংশোধন করতে না পারলে (যেমন মেডিটেশন, শিথিলায়ন বা পায়চারি) দেহে ক্ষতিকর টেনশন সৃষ্টি হয়, যা দেহের জন্যে যেমন ক্ষতিকর, তেমনি ব্রেনের সার্কিটও জ্যাম করে দেয়। আসলে দেহের ভেতরের এবং বাইরের পরিবেশের মধ্যে যোগাযোগ সমন্বয়ে ব্রেনের কার্যক্রম ফিডব্যাক দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়।
বিস্ময়কর অঙ্গ

ব্রেন-এর ওজন প্রায় দেড় কেজি। এটি গঠিত দুই ধরনের সেল দিয়ে। নিউরোন সেল এবং গ্লিয়াল (Glial) সেল। নিউরোন সেলের তুলনায় গ্লিয়াল সেলের অনুপাত হচ্ছে ১:১০। অর্থাৎ একটি নিউরোন সেলের বিপরীতে রয়েছে ১০টি গ্লিয়াল সেল। আর এই নিউরোন সেলের সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১০০ বিলিয়ন। একটি নিউরোন অপর নিউরোনের সাথে সংযুক্ত হয় সূক্ষ্ম তন্তু ডেনড্রাইট ও এক্সনের মাধ্যমে। এমনিভাবে একটি নিউরোন কমপক্ষে ১০ হাজার নিউরোনের সাথে সংযুক্ত। কোনো কোনো নিউরোন সংযুক্ত থাকে দুই লক্ষ নিউরোনের সাথে। একটি নিউরোনের সাথে অপর নিউরোনের সংযুক্তি সার্কিটে একটা ফাঁক থাকে। একে বলা হয় সিন্যাপস (Synapse)। এ ধরনের সিন্যাপস-এর সংখ্যা কমপক্ষে ১০০ ট্রিলিয়ন। ব্রেনের কাজ কর্ম পরিচালিত হয় ইলেকট্রোকেমিক্যাল পদ্ধতিতে। ব্রেন পরিচালনায় প্রয়োজন হয় ২০ থেকে ২৫ ওয়াট বিদ্যুৎ। প্রতি সেকেন্ডে এক থেকে দশ লক্ষ কেমিকেল রি-অ্যাকশন ঘটে ব্রেনের মধ্যে। গভীর মনোযোগে ভারী ব্যায়ামের সমান ক্যালরি খরচ হয়। ব্রেন কখনো ক্লান্ত হয় না। ২৪ ঘণ্টা কাজ করে। গভীর ঘুমের সময়ও ব্রেন সক্রিয় থাকে।


ব্রেনের সেরিব্রাল বলয়

ব্রেনের সেরিব্রাল বলয় (Cerebral hemispheres) বাদামের মাঝখান দিয়ে বিভক্ত দুই অংশের মতো সমানভাবে বিভক্ত। এক অংশকে বলা হয় ডান বলয়, অপর অংশকে বলা হয় বাম বলয়। কিন্তু এই দুটোর আড়াআড়ি সংযুক্তি (Cross-wired) থাকায় ডান বলয় নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের বাম অংশকে আর বাম বলয় নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের ডান অংশকে। দুই বলয়ের মধ্যে বাম বলয় (বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে বাম বলয়) বেশি সক্রিয় থাকে এবং তা নিয়ন্ত্রণ করে কথা, শ্রুতি, অঙ্ক, যুক্তি, ভাষা, ক্ষুধা, হজম ও বৈষয়িক ভাবনা। আর ডান অংশ নিয়ন্ত্রণ করে কল্পনা, আবেগ, বিশ্বাস, ঘুম, স্বপ্ন, সংগীত, সৃজনশীলতা, অতিচেতনা, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক ভাবনা ইত্যাদি। সাধারণত এই দুই বলয় সংযুক্ত থাকে কর্পাস কলোসাম (Corpus callosum) নামে স্নায়ুতন্তুর গোছা দ্বারা। কিন্তু এই সংযোগ যদি কোনো কারণে ছিন্ন হয়, তাহলে দুই বলয়ের স্বায়ত্তশাসনের রূপ পরিষ্কার বোঝা যায়। বিভক্ত ব্রেন (Split brain) রোগীরা দুই হাতে যে সব কাজ আগে করতে শিখেছিল, তা ক্রমান্বয়ে ভুলে যেতে থাকে। আর যে কাজ করতে দু’হাতের প্রয়োজন হয়, তা শেখা তাদের জন্যে যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। 

ব্রেনের ১০০ বিলিয়ন নিউরোন আবার তিনটি গ্রুপে যথা সেনসরি, মটর ও এসোসিয়েশন সেন্টারে বিভক্ত। বাইরের আঘাত থেকে ব্রেন শক্ত খুলি দ্বারা রক্ষিত। এরপরও রয়েছে তিন স্তর বিশিষ্ট ঝিল্লির রক্ষা আবরণ। ঝিল্লির আবরণের ফাঁকে রয়েছে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড নামক তরল পদার্থ যা শক-অ্যাবসরবার হিসেবে কাজ করে। আবার বর্জ্য পদার্থ ধুয়ে নিয়ে যায়। এই ফ্লুইডের মধ্যে রয়েছে অক্সিজেন ও স্নায়ুর জন্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি। এই ফ্লুইডই স্পাইনাল কর্ডকে পুষ্টি সরবরাহ ও রক্ষা করে। আর এই স্পাইনাল কর্ড ও ব্রেনের সমন্বয়েই গঠিত হয়েছে আপনার সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম।


সেরিব্রাম

ব্রেনের সবচেয়ে বড় অংশ সেরিব্রাম। মাথার খুলির বেশিরভাগ জায়গাই দখল করে রয়েছে এটি। সেরিব্রাম দুই ভাগে বিভক্ত। ডান ও বাম। এই দুই বলয় সাদা স্নায়ুর গোছা দ্বারা সংযুক্ত। সেরিব্রামের ভেতরের অংশ সাদা পদার্থ (White matter) দ্বারা গঠিত। এর ওপর রয়েছে ধূসর পদার্থের (Gray matter) আচ্ছাদন। একে বলা হয় সেরিব্রাল করটেক্স (Cerebral cortex)। পুরো সেরিব্রামই বিভিন্ন লোবে (Lobe) বিভক্ত। এগুলোর নামকরণ করা হয়েছে খুলির হাড়ের নাম অনুসারে। সেরিব্রাল বলয়ের সাদা পদার্থের মাঝে রয়েছে ধূসর পদার্থের পিণ্ড। একে বলা হয় সেরিব্রাল নিউক্লি।

সেরিব্রামের দুই বলয় একে অপরের প্রতিবিম্ব নয়। বিভিন্ন বিষয় এরা পৃথক পৃথকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এরা পরস্পর সংযুক্ত এবং একে অপরের পরিপূরক। এক বলয়ে রক্ষিত 'স্মৃতি' অন্য বলয়ও প্রয়োজনে পেতে পারে। তাই সেরিব্রামের কোনো বলয়ের কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেই যে আপনার জীবন থেকে সে অংশের বিশেষ কার্যক্ষমতার বিলুপ্তি ঘটবে, এমন কোনো কথা নেই।

সেরিব্রাম শরীরের বহু জটিল কাজ সম্পাদন করে। এই সব কাজ নিয়ন্ত্রণকারী সেরিব্রামের অংশগুলোকেও শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। মটর তৎপরতা (Motor activities) যেমন পেশি পরিচালন নিয়ন্ত্রিত হয় সেরিব্রামের সম্মুখ ভাগের নিকটে অবস্থিত করটেক্সের অভ্যন্তরস্থ নার্ভ সেন্টারসমূহ দ্বারা। সেরিব্রাল করটেক্সের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন পেশিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এই মটর এলাকায় কোনো ক্ষতি হলে এর সাথে সংযুক্ত পেশি নিশ্চল হয়ে যাবে। 

সেরিব্রাল করটেক্স-এর সেনসরি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে শ্রবণ, দর্শন, স্পর্শ তথা পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা সংগৃহীত তথ্যাবলি। সেরিব্রামের এই সেনসরি এলাকা না থাকলে একটা বস্তু কেমন তা দেখতে পেতেন না। ঠান্ডা না গরম তা-ও বুঝতে পারতেন না। কোনো আওয়াজ বা সুর শুনতে পেতেন না। আপনার সেরিব্রামের দুটো বলয়েই মটর ও সেনসরি এলাকা রয়েছে। 

স্মৃতি, আবেগ ও বিচার বিশ্লেষণ সংযুক্ত রয়েছে পুরো সেরিব্রাল করটেক্স ও তৎসন্নিহিত এলাকায়। বলা হয়, স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে পুরো এলাকায়। তাই করটেক্সের অর্ধেক অপসারণ করা হলে মনে রাখার ক্ষমতা আনুপাতিক হারে কমে যেতে পারে, কিন্তু এটি কোনো সুনির্দিষ্ট স্মৃতিকে ধ্বংস করে দেয় না। কারণ করটেক্স স্মৃতিকে ধারণ করলেও এটি কম্পিউটারের মেমোরি ব্যাংকের মতো নয়। কম্পিউটারের মেমোরি ব্যাংকে একটি ইলেকট্রনিক সেলে পৃথক তথ্য জমা থাকে। আর করটেক্সে মেমোরি থাকে সর্বত্র ছড়িয়ে।

সেরিব্রাল করটেক্সে স্মৃতি বা মেমোরির স্থায়িত্ব গবেষকদের কাছেও বিস্ময়কর। দীর্ঘদিন মনে পড়ে নি এমন স্মৃতিও হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে। 'রিমেম্ব্রেন্স অব থিংস পাস্ট'-এ মার্সেল প্রুস্ত চায়ে ভেজানো বিস্কুটের স্বাদ গ্রহণ করার সাথে সাথে স্মৃতির বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। 

অনেকেই কোনো সুগন্ধির গন্ধ নেয়া, কোনো কথা শোনা বা কোনো গানের কলি মনে আসার সাথে সাথে বহু বছর আগে ঘটা ঘটনা হুবহু স্মরণ করতে ও বর্ণনা করতে পেরেছেন। এক্ষেত্রে বিখ্যাত কানাডিয়ান নিউরোসার্জন ড. ওয়াইল্ডার পেনফিল্ডের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হচ্ছে- স্মৃতিকে বিদ্যুৎ প্রবাহ দিয়েও জীবন্ত করে তোলা যায়। ড. পেনফিল্ড এক মহিলা রোগীর ব্রেনে ইলেক্ট্রয়েড স্থাপন করে রোগীর স্নায়ুরোগের উৎস সন্ধান করছিলেন। ড. পেনফিল্ড এসময় অবাক হয়ে যান, রোগীর মুখে ছোটবেলার একটি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ শুনে। তিনি বিভিন্ন রোগীর ওপর তার গবেষণা চালিয়ে যান। তিনি দেখেন যে, ইলেক্ট্রয়েড দিয়ে সেরিব্রাল করটেক্সের বিভিন্ন অংশ স্পর্শ করার সাথে সাথে তারা দীর্ঘদিন ধরে ভুলে গিয়েছিল এমন গান হুবহু মনে করতে পেরেছে এবং এমন অভিজ্ঞতার হুবহু বিবরণ দিয়েছে, যা বহু আগেই বিস্মৃতির অতলে অপসৃত হয়েছিল।

সেরিব্রাল করটেক্সের এসোসিয়েশন এলাকায় রয়েছে মটর ও সেনসরি এলাকার স্নায়ুতন্তুর সংযোগকারী তন্তুসমূহ। এই এসোসিয়েশন এলাকার কারণেই আপনি বর্তমান তথ্য ও অনুভূতির প্রেক্ষিতে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। সেরিব্রাল করটেক্সই অতীত অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির আলোকে বর্তমানে প্রাপ্ত তথ্যের প্রেক্ষিতে সবচেয়ে উপযুক্ত ও কার্যকরী পদক্ষেপের নির্দেশ প্রদান করে। কল্পনার অবস্থানও এখানেই বলে অনুমান করা হয়। সেরিব্রামই মানুষকে আলাদা করেছে অন্য প্রাণী থেকে। এখানেই রয়েছে চিন্তাকেন্দ্র। যা অতীতকে মনে রাখে, বর্তমানকে উপলব্ধি করে, ভবিষ্যতকে বরণের প্রস্তুতি নেয়। 
সেরিবেলাম

ব্রেনের এ অংশকে বলা হয় লঘু মস্তিষ্ক। এটি সেরিব্রামের অক্সিপিটাল লোব (Occipital lobe)-এর নিচে অবস্থিত। সেরিব্রামের মতো সেরিবেলামও ধূসর পদার্থের বেষ্টনীর মধ্যে সাদা পদার্থ সমন্বয়ে গঠিত। সাদা পদার্থের অভ্যন্তরে আবার রয়েছে ধুসর পদার্থ এলাকা। একে বলা হয় সেরিবেলাম নিউক্লি। এখানে রয়েছে দুটি বলয়। এই দুই বলয় সংযুক্ত হয়েছে ভেরমিস (Vermis) দ্বারা।


সেরিবেলাম

সেরিবেলাম পেশির গতি নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় সাধন করে। এর ফলে সমন্বয় সাধিত হয় প্রতিটি ভঙ্গির মাঝে। আপনি অনায়াসে নাকে চাপ দিয়ে সর্দি রুমালে মোছার মতো কাজগুলো করতে পারেন। সেরিবেলামের সাদা পদার্থের মধ্যে রয়েছে স্নায়ুতন্তুর গোছা। এই স্নায়ুগুলো পেশি ও কানে অবস্থিত ভারসাম্যস্থাপক অঙ্গ থেকে সেনসরি বার্তা সেরিবেলামে পৌঁছায়। তবে বহির্মুখী স্নায়ুতন্তুগুলো এখান থেকে সরাসরি সাড়া প্রদানকারী অঙ্গে যায় না, বরং এগুলোও এসোসিয়েশন সেন্টার ঘুরে যায়। ফলে আপনার তৎপরতা সচেতন হস্তক্ষেপ ছাড়াই সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রিত ও সমন্বিত হয়। সেরিবেলাম না থাকলে আপনার গতি ও তৎপরতা সুষম ও নিয়ন্ত্রিত হওয়ার পরিবর্তে হতো ঝুঁকিপূর্ণ হঠাৎ হঠাৎ। সেরিবেলাম ক্ষতিগ্রস্ত হলে পেশি তৎপরতায় ঘটে সমন্বয়ের অভাব।
ব্রেন স্টেম

ব্রেন স্টেম (Brain stem) ব্রেনের উচ্চতর কেন্দ্রগুলোকে সংযুক্ত করেছে স্পাইনাল কর্ডের সাথে। এর প্রধান অঙ্গগুলো হচ্ছে মেডুলা অবলঙ্গাটা (Medula oblongata), পনস (Pons), মিড-ব্রেন (Mid-Brain), থ্যালামাস (Thalamus) এবং হাইপোথ্যালামাস (Hypothalamus)।


ব্রেন স্টেম


মেডুলা অবলঙ্গাটা

মেডুলার সাদা পদার্থের অভ্যন্তরে রয়েছে ধূসর পদার্থ। মাথা, গলা ও কাঁধের সকল সচেতন তৎপরতা নিয়ন্ত্রণকারী চারটি ক্রানিয়াল নার্ভকেন্দ্র এখানে অবস্থিত। মেডুলার অভ্যন্তরে রয়েছে আরো গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রসমূহ। কার্ডিয়াক কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করে হার্ট বিট। ভাসো কনস্ট্রিকটর কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করে রক্তবাহী নালীর পরিধি। শ্বাসকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করে দমের হার ও দমের গভীরতা। আরো বিভিন্ন কেন্দ্র রয়েছে যা গলাধঃকরণ, বমি, পাকস্থলীর তৎপরতা এবং হজমকারী জারক নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে। সব ধরণের ইচ্ছা নিরপেক্ষ ক্রিয়ার (Involuntary reflex action) উৎস হচ্ছে মেডুলা।
মিড-ব্রেন

মিড-ব্রেন ওপরের সেরিব্রামের সাথে নিচের সেরিবেলাম ও পনসের (Pons) সাথে সংযোগ সাধন করেছে। দেখতে এটাও মেডুলা ও পনসের মতোই। এখানেও রয়েছে স্নায়ুতন্তুর গোছা, যা ব্রেন থেকে নিচের স্পাইনাল কর্ডে নেমে গেছে এবং ওপরে সেরিব্রাল করটেক্সে উঠে গেছে। দুটি ক্রানিয়াল নার্ভের উৎস এখানে। এখানে অবস্থিত কর্পোরা কোয়াড্রিজেমিনায় (Corpora quadrigemina) রয়েছে দর্শন ও শ্রবণ সমন্বয়কেন্দ্র। ব্রেনের এই অংশ কোন দিক থেকে একটা বিশেষ শব্দ আসছে তা নিরূপণ করে দেয়।


মিড ব্রেন

থ্যালামাস মিড-ব্রেনের একটু ওপরে সাদা পদার্থ দ্বারা আচ্ছাদিত ধূসর পদার্থ। এটি হচ্ছে একটি প্রধান রিলে কেন্দ্র। ব্রেনের নিম্ন এলাকা এবং স্পাইনাল কর্ড থেকে আসা প্রতিটি মেসেজ এখানে প্রক্রিয়াজাত হয়ে সেরিব্রাল করটেক্সে প্রেরিত হয়।


থ্যালামাস


হাইপোথ্যালামাস

থ্যালামাসের নিচেই হাইপোথ্যালামাস অবস্থিত। হাইপোথ্যালামাস ব্রেনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের সাথে মিলিতভাবে দেহের অভ্যন্তরে অবস্থিত বেঁচে থাকার উপযোগী প্রাণরাসায়নিক পরিবেশের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে। হাইপোথ্যালামাস দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় থাকা নিশ্চিত করে। কারণ হাইপোথ্যালামাস তাপমাত্রার যে-কোনো ওঠানামার ব্যাপারে অত্যন্ত সংবেদনশীল। ক্ষুধার ব্যথা ও তাড়নার ব্যাপারে সংবেদনশীল হওয়ার কারণে এটি খাবার গ্রহণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এতে অবস্থিত তৃষ্ণাকেন্দ্র রক্তে পানির পরিমাণ নিরূপণে বেশ সংবেদনশীল। তাই শরীরে পানির প্রয়োজন হলেই তৃষ্ণা অনুভূত হয়। ঘুম ও জাগৃতির প্যাটার্ন এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। হার্ট বিট, অন্ত্রের সংকোচন-প্রসারণ ও মূত্রথলি শূন্যকরণ প্রক্রিয়া এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়।


হাইপোথ্যালামাস

নার্ভাস সিস্টেম ও এন্ডোক্রাইন সিস্টেম অর্থাৎ শরীরের স্নায়ুভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও হরমোনভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে যোগসূত্র হচ্ছে হাইপোথ্যালামাস। কোনো দৈহিক প্রয়োজন সম্পর্কে সজাগ হলেই হাইপোথ্যালামাস রাসায়নিক নিঃসরণের মাধ্যমে পিটুইটারি গ্ল্যান্ডকে সক্রিয় করে তোলে। পস্টেরিয়র পিটুইটারি রক্তে দুটি হরমোন ছাড়ে, যা আসলে তৈরি হয় হাইপোথ্যালামাসে। অক্সিটসিন (Oxytocin) গর্ভবতীর রক্তে প্রচুর পরিমাণে নিঃসরণ হলেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রক্রিয়ার সূচনা করে। স্তনে দুধ উৎপাদনের পেছনেও এই হরমোনের ভূমিকাই মুখ্য। এন্টিডায়োরেটিক (Antidiuretic) হরমোন শরীর থেকে কিডনির মাধ্যমে যাতে অতিরিক্ত পানি নিঃসরণ না হয় তা নিশ্চিত করে। দুটি হরমোনই তৈরি হয় হাইপোথ্যালামাসে।

হাইপোথ্যালামাসের নির্দেশে এন্টিরিয়র পিটুইটারি ছয়টি পৃথক হরমোন নিঃসরণ করে। এগুলোর বেশিরভাগই অন্যান্য গ্ল্যান্ডকে তাদের নিজস্ব হরমোন উৎপাদন বা উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দেয়। প্রোল্যাকটিন দুধের ক্ষরণ ঘটায় এবং গ্রোথ হরমোন সেল বিভক্তি, হাড় বৃদ্ধি ও প্রোটিন সিনথেসিস ঘটায়। এ দুটি হরমোন সরাসরি শরীরের টিস্যুতে ক্রিয়া করে। 

আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী লিমবিক সিস্টেম (Limbic system) এর অংশও হচ্ছে হাইপোথ্যালামাস। থ্যালামাসের অংশ বিশেষ, হিপ্পোক্যাম্পাস (Hippocampus) ও ব্রেন স্টেমের সাথে সংযুক্ত এলাকার সাহায্যে হাইপোথ্যালামাস আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে। বলা যেতে পারে- মন ও দেহের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে হাইপোথ্যালামাস। এখানেই আবেগের যে-কোনো পরিবর্তন লিপিবদ্ধ হয় এবং তা দৈহিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে। যেমন আপনি সামনে দেখলেন একটি গোখরা সাপ ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে। সাথে সাথে আপনি যে অনুভূতি লিপিবদ্ধ করলেন তা হচ্ছে ভয়। আর এই ভয়ের প্রকাশ ঘটতে পারে হার্ট বিট বৃদ্ধি, মুখ ফ্যাকাসে হয়ে শরীর ঘেমে গিয়ে আর্তচিৎকারের মাধ্যমে। হাইপোথ্যালামাসের মাধ্যমেই আবেগ দেহের ওপর ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।
সেনসরি অর্গান

ব্রেনের একটি প্রধান কাজ হচ্ছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। বাইরের কোনো পরিবর্তন সম্পর্কে ইন্দ্রিয় আপনাকে অবহিত করলেই আপনি তা অনুভব করেন। ইন্দ্রিয় আপনাকে যা অনুভূত করাচ্ছে, তা হচ্ছে পরিবর্তন। আপনি যদি বিশেষ কোনো অনুভূতিতে অভ্যস্ত হয়ে যান, যেমন গায়ে কাপড় বা মাথায় টুপির অবস্থিতির ওজন। তাহলে তা আপনি কখনো সচেতনভাবে অনুভব করেন না। তখন আপনার অনুভূতি এর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। কিন্তু এই অবস্থায় কোনো পরিবর্তন হলে দেহের প্রাণরাসায়নিক ব্যবস্থার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যে দেহকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হয়। 

দেহের পঞ্চ ইন্দ্রিয় তথ্য সংগ্রহ করে এবং নার্ভাস সিস্টেমের মাধ্যমে ব্রেনে প্রেরণ করে। আপনি আপনার ইন্দ্রিয়ে কিছুই অনুভব করেন না। ইন্দ্রিয় শুধু স্নায়ুর মাধ্যমে তরঙ্গাকারে ব্রেনে তথ্য প্রেরণ করে। ব্রেন এই তথ্যের প্রকৃতি নিরূপণ করে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ চোখের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য ব্যাখ্যা করে দেখা যেতে পারে। যখন আলো চোখে প্রবেশ করে তখন তা রেটিনাতে অবস্থিত রড ও কোণগুলোয় আঘাত করে। আলো আঘাত করলে রড ও কোণে অবস্থিত রঞ্জক পদার্থ রাসায়নিকভাবে ভেঙে যায়। এই ভাঙনের ফলে স্নায়ুতরঙ্গ সৃষ্টি হয়, যা অপটিক নার্ভের মাধ্যমে সেরিব্রাল করটেক্সে দৃষ্টিনির্ভর তথ্য পৌঁছে দেয়। আপনি যা দেখছেন তা হচ্ছে অপটিক নার্ভের মাধ্যমে পাওয়া স্নায়ুতরঙ্গ সম্পর্কে ব্রেনের ব্যাখ্যা-আপনার দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো বস্তুর ওপর আলোর প্রতিফলন থেকে পাওয়া তথ্যের সাজানো রূপ।

পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও দেহের বিভিন্ন অঙ্গ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যে ১২ জোড়া ক্র্যানিয়াল নার্ভ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ জোড়ার উৎপত্তি হচ্ছে ব্রেন স্টেম থেকে। মটর নার্ভ গিয়েছে ব্রেন থেকে পেশি বা গ্ল্যান্ডে। সেনসরি নার্ভ তথ্য ব্রেনে নিয়ে যায়। আর মিশ্রিত নার্ভে রয়েছে সেনসরি ও মোটর তন্তু। ক্র্যানিয়াল নার্ভ যেহেতু সচেতন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে তাই এর কোনো ক্ষতি দেহের কিছু নির্দিষ্ট পেশি ব্যবহারে আপনার সামর্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ব্রেন ও দেহের মধ্যে যোগাযোগ

দেহের সবগুলো ইন্দ্রিয় হয় ব্রেন বা স্পাইনাল কর্ডের সাথে স্নায়ুতন্তু দ্বারা সংযুক্ত। যখন কোনো ইন্দ্রিয় কোনো তথ্য পায় তখন স্নায়ুতন্তুতে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সৃষ্টি করে। স্নায়ুতন্তুর মাধ্যমে এই তরঙ্গ গন্তব্যে যাত্রা করে। কখনো তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বা ইচ্ছানিরপেক্ষ ক্রিয়ার (Reflex action) মাধ্যমে পদক্ষেপ গ্রহণ করে আবার কখনো সচেতনভাবে ব্রেন তা অনুভব করে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ব্রেনে প্রতিনিয়ত এত বিপুল পরিমাণ তথ্য যাচ্ছে যে, সে সম্পর্কে সচেতন থাকাও সম্ভব নয়, আর তার প্রয়োজনও পড়ে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রক্তে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা পরিবর্তিত হওয়ার প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে সচেতনভাবে কিছু করার প্রয়োজন নেই। এই ধরনের তথ্য কখনো সচেতন স্তরে পৌঁছায় না। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। 
নার্ভাস সিস্টেম

নার্ভাস সিস্টেম বলে পরিচিত দেহাভ্যন্তরের যোগাযোগ পদ্ধতি আসলে একাধিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সংযুক্ত রূপ।
১. সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম (Central nervous system) ব্রেন ও স্পাইনাল কর্ডের সমন্বয়ে গঠিত।
২. পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেম (Peripheral nervous systym) সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম ও দেহের অঙ্গ ও পেশির সাথে যোগাযোগ স্থাপনকারী স্নায়ুসমূহ নিয়ে গঠিত।
৩. অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম হচ্ছে পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেমের একটা অংশ। অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম আপনার সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়াই অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহের কার্যাবলি মনিটর ও নিয়ন্ত্রণ করে। এটি আবার দুইভাগে বিভক্ত- প্যারাসিম্পেথেটিক ব্রাঞ্চ এবং সিম্পেথেটিক ব্রাঞ্চ (Parasympathetic branch and Sympathetic branch)। প্যারাসিম্পেথেটিক ব্রাঞ্চ সাধারণ বিশ্রাম ও দেহের পুনর্নির্মাণ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। আর সিম্পেথেটিক ব্রাঞ্চ জরুরি- যেমন মারো অথবা পালাও (Fight or Flight) কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। উভয় কাজই পরিচালিত হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আপনার সচেতনতার অজ্ঞাতসারে। 
এন্ডোক্রাইন সিস্টেম

যে-কোনো অবস্থায় দ্রুত সাড়া দিতে পারাটাই নার্ভাস সিস্টেমের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অপরদিকে এন্ডোক্রাইন সিস্টেম (Endocrine system) ধীরে ও সময় নিয়ে সম্পন্ন করতে হয় এমন কাজই করে। এন্ডোক্রাইন গ্ল্যান্ডগুলো হরমোন উৎপাদন করে এবং রক্তে ছেড়ে দেয় এবং রক্তের মাধ্যমেই তা শরীরের সর্বত্র প্রেরণ করে। যখনই এই হরমোন তার গন্তব্যে পৌঁছায় তখন তা সুনির্দিষ্ট পরিবর্তনের কারণ হয়। স্নায়ুতরঙ্গ দ্বারা প্রেরিত বার্তার চেয়ে হরমোনের ক্রিয়া হয় ধীরে। দৈহিক বৃদ্ধি, সাবালকত্ব অর্জন ও প্রজনন প্রক্রিয়ার মতো দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন নিয়ন্ত্রিত হয় হরমোন দ্বারা। 

হরমোন উৎপাদন সতর্কতার সাথে নিয়ন্ত্রণের জন্যে রয়েছে চমৎকার ফিডব্যাক প্রক্রিয়া। যা পরিচিত বায়োফিডব্যাক লুপ (Biofeedback loop) নামে। এর কার্যকারিতা গড়ে উঠেছে পিটুইটারি গ্ল্যান্ড ও হাইপোথ্যালামাসের মাঝে স্থাপিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ওপর। পিটুইটারি গ্ল্যান্ড অন্যান্য গ্ল্যান্ডগুলোকে প্রয়োজনীয় হরমোন উৎপাদনের নির্দেশ পাঠালেও এটি সক্রিয় হয়ে ওঠে হাইপোথ্যালামাস প্রেরিত স্নায়ুসংকেত দ্বারা। 
নিউরোন

ব্রেন ও নার্ভাস সিস্টেম গঠিত হয়েছে কোটি কোটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিউরোন সেল দ্বারা। নিউরোনই হচ্ছে ব্রেনের ক্ষুদ্রতম একক। এর আকার আকৃতি নির্ভর করে এর অবস্থান ও দায়িত্বের ওপর। তবে প্রত্যেক নিউরোনেরই রয়েছে একটি নিউক্লিয়াস ও তার চারপাশে বেষ্টিত সেল দেহ। আর এ নিউরোন সেল থেকে তারের মতো চারদিকে চলে গিয়েছে অসংখ্য স্নায়ুতন্তু যা পরিচিত এক্সন (Axon) ও ডেনড্রাইট (Dendrite) নামে। নিউরোন মূলত তিন ভাগে বিভক্ত।


নিউরোন

১. সেনসরি নিউরোন: এটি ইন্দ্রিয় থেকে বা রিসিপ্টর থেকে ব্রেন বা স্পাইনাল কর্ডে তথ্য বয়ে নিয়ে আসে।
২. মটর নিউরোন: এটি ব্রেন ও স্পাইনাল কর্ড থেকে তথ্য ও নির্দেশ নিয়ে গ্ল্যান্ড ও পেশিতে পৌঁছে দেয়। এরা পেশি ও অঙ্গগুলোকে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে।
৩. এসোসিয়েশন নিউরোন: এটি ব্রেন ও স্পাইনাল কর্ডে অবস্থান করে সেনসরি ও মটর নিউরোনের মাঝে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে।

বেশিরভাগ নিউরোনই পাওয়া গেছে ব্রেন ও স্পাইনাল কর্ডে। কিন্তু এদের তন্তুগুলো হতে পারে অনেক লম্বা। যেমন স্পাইনাল কর্ড থেকে পায়ের আঙুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে তন্তু। প্রতিটি অঙ্গ ও পেশিতে গিয়ে পৌঁছেছে এই তন্তু। শত শত তন্তু একত্রে গোছার আকার ধারণ করে স্নায়ু বা নার্ভ গঠন করে। 
তথ্যপ্রেরণ

স্নায়ুতন্তু ব্রেনের সাথে, পেশির সাথে, গ্ল্যান্ডের সাথে এবং একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু তারা একে অপরকে স্পর্শ করে না। নিউরোনের এক্সন (যে তন্তু নিউরোন থেকে তথ্য প্রেরণ করে, তাকে এক্সন বলে) এবং অন্য নিউরোনের ডেনড্রাইট (যে তন্তু তথ্য গ্রহণ করে, তাকে ডেনড্রাইট বলে)-এর মধ্যে অতি সূক্ষ্ম ফাঁক থাকে। একে বলে সিন্যাপস। যখন স্নায়ুতে বৈদ্যুতিক চার্জ গঠিত হয় তখন এক নিউরোন থেকে অপর নিউরোনে অথবা পেশিতে তথ্য প্রেরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। একটা বৈদ্যুতিক স্নায়ুসংকেত নিউরোনের এক্সন দিয়ে যাত্রা শুরু করে সিন্যাপস পর্যন্ত পৌঁছায়। সিন্যাপস নবে পৌঁছানোর সাথে সাথে সেখান থেকে একটি নিউরোট্রান্সমিটার নামে রাসায়নিক অণু ছুটে যায়। এই নিউরোট্রান্সমিটার পরবর্তী নিউরোনের ডেনড্রাইট বা পেশিতে পৌঁছে তথ্য প্রদান অব্যাহত রাখে। এভাবেই চলে দেহাভ্যন্তরে তথ্য আদান-প্রদানের রিলে। স্নায়ুতন্তু দিয়ে তথ্য প্রতিঘণ্টায় ২২৫ মাইল গতিতে ভ্রমণ করে। একটি সংকেত ব্রেন থেকে পায়ে পৌঁছুতে লাগে সেকেন্ডের ৫০ ভাগের ১ ভাগ সময়। তথ্য ইন্দ্রিয় থেকে ব্রেনে যাক, ব্রেনের এক সেল থেকে অন্য সেলে যাক বা নার্ভাস সিস্টেম থেকে পেশিতে যাক, তথ্য প্রেরণ ও গ্রহণের প্রক্রিয়া একই রকম। 


তথ্য প্রেরণ


নিউরোট্রান্সমিটার : অদম্য রানার

ব্রেন সংক্রান্ত এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা আমরা শেষ করতে পারি একটি গল্প দিয়ে। ইনকাদের গল্প। ইনকাদের দুর্গ শহর মাচু পিচ্চু-তে পৌঁছানো ছিল এক দুঃসাধ্য কাজ। আন্দিজ পর্বতমালার ১৬ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত গিরিপথ অতিক্রম করতে হতো প্রথমে। অক্সিজেনের স্বল্পতা সেখানে যে-কারো মাথা ঝিমঝিম করা বা মাথা ঘোরার জন্যে যথেষ্ট, আবার মেঘের ওপরে শহর দেখা যাওয়ার পরও পাথরের তৈরি তিন হাজারটি ধাপ অতিক্রম করেই পৌঁছা সম্ভব হতো শহরের গেটে। 

ভাবলে অবাক হতে হয় এই রাজধানীর সাথে দুই হাজার মাইলব্যাপী ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি গ্রামের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত রানাররা (Runner)। এরা খালি পায়েই দৌড়াতে পারত দীর্ঘ পথ। কখনো কখনো এরা প্রতিদিন দৌড়াতো ৫০ থেকে ৭৫ মাইল পর্যন্ত-ম্যারাথন দৌড়ের ২/৩ গুণ। কখনো কখনো তাদের পথ শুরু হতো পর্বত চূড়া থেকে। উঠতে হতো মাইলখানেক ওপরে। এদের কষ্ট সহ্য ক্ষমতা ও গতি এককথায় বলা যেতে পারে অতিমানবিক। এরাই ছিল সম্রাট আতাহুলপার চোখ এবং কান। স্প্যানিশ লুটেরাদের আক্রমণ অভিযানে আগমনের কথা এই পরিশ্রমী ও অতি কষ্টসহিষ্ণু রানাররা এসে সম্রাটকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল। কিন্তু আক্রমণ মোকাবেলায় সম্রাটের কোনো সুসংহত প্রস্তুতি ছিল না। তাই ১৫৩২ সালে ইনকাদের এই রাজধানীর পতন ঘটে। বিশ্বাসঘাতকতার পন্থা অবলম্বন করে স্প্যানিশ লুণ্ঠনকারীদের নেতা পিজারো সম্রাট আতাহুয়ালপাকে অপহরণ করে বিপুল ধনরত্ন মুক্তিপণ আদায় করার পর হত্যা করে। ইনকা সভ্যতার পতন ঘটে।

আপনি যদি ব্রেনকে আন্দিজ পর্বতমালার শীর্ষে অবস্থিত মাচু পিচ্চু দুর্গ ভাবেন, তাহলে দেখবেন যে, এরও রয়েছে অসংখ্য পরিশ্রমী রানার। যারা নিরলসভাবে দেহ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দূরবর্তী প্রান্ত থেকে বাণী বহন করে ব্রেনে পৌঁছাচ্ছে এবং ব্রেন থেকে কমান্ড পৌঁছে দিচ্ছে পায়ের আঙুলের মতো দূরবর্তী প্রান্তে। এই রানাররা হচ্ছে নিউরোট্রান্সমিটার অণু। এই নিউরোট্রান্সমিটার অণুগুলো প্রতিটি দেহকোষের জীবনকে প্রভাবিত করছে। ব্রেনের সকল চিন্তা, আশা, স্বপ্ন, ইচ্ছা, অনিচ্ছা, করণীয়, বর্জনীয় সকল নির্দেশ প্রতিটি সেলে পৌঁছে দিচ্ছে এই নিউরোট্রান্সমিটার। আবার দেহাভ্যন্তরের ও পারিপার্শ্বিকতার সকল তথ্য ব্রেনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে এই নিউরোট্রান্সমিটার। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ৫০ ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার শনাক্ত করেছেন।

এত চমৎকার ব্যবস্থা থাকতেও দেহ কখনো কখনো কেন রোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়, কেন পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ বা সাফল্য অব্যাহত রাখতে পারে না? 

এ প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করা যেতে পারে-ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপা এত নিবেদিতপ্রাণ রানারদের আগাম সতর্কবাণীর পরও কেন শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন? জবাব একটাই-সুসংহত মানসিক প্রস্তুতির অভাব। আমরা জানি মনের শক্তির অসীমতা। আমরা জানি বস্তু বিনাশ প্রাপ্ত হয়। কিন্তু তথ্য অবিনাশী। দেহকোষ মরে যায়। কিন্তু এর অভ্যন্তরের তথ্য ডিএনএ বেঁচে থাকে নতুন দেহকোষে। চিন্তা সর্বত্রগামী। আবার চিন্তার রয়েছে বস্তুগত ভিত্তি। (কারণ প্রতিটি নিউরোট্রান্সমিটার এক একটি বিশেষ ধরনের চিন্তা বা তথ্যকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। আর নিউরোট্রান্সমিটার একটি বিশেষ ধরনের রাসায়নিক অণু।) তাই মন ও চিন্তার শক্তি সবকিছুকেই প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। যদি আমরা মন ও চিন্তার শক্তিকে সৃজনশীল ও ফলপ্রসূভাবে ব্যবহার করতে পারি, সুসংহত মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি, তাহলে চিন্তা যেমন বস্তু সৃষ্টি করছে, চিন্তা তেমনি সুখ ও সাফল্য সৃষ্টি করবে।
লেখাটি কোয়ান্টাম মেথডের প্রবক্তা মহাজাতক এর মেডিটেশন বই থেকে সংগ্রহ।
এসএ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি