‘ব্লাস্ট থেকে বাঁচতে অগ্রহায়ণের প্রথমার্ধে বপন করুন গমের বীজ’
প্রকাশিত : ১৭:৫৯, ৮ অক্টোবর ২০১৮ | আপডেট: ১২:৪৫, ১১ অক্টোবর ২০১৮
বাংলাদেশে কৃষকদের কাছে অন্যতম চাষাবাদযোগ্য ফসল গম। যা আবহমান কাল ধরে তারা চাষ করে আসছেন। কিন্তু গত ২০১৬ সালে এ ফসলে আক্রমন করে ব্লাস্ট নামক ছত্রাকজনিত একটি রোগ। যা বছরে দেশের প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমির গমকে নষ্ট করে দেয়। গবেষকরা তাই এ রোগ প্রতিরোধে আবিষ্কার করেছেন নতুন জাতের বারি গম ৩৩। রোগ থেকে রক্ষা পেতে এ গমের বীজ অগ্রহায়নের প্রথম থেকে মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বপন করার জোর পরামর্শ দিচ্ছেন গবেষকরা।
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের(দিনাজপুর)মহাপরিচালক ড. নরেশ চন্দ্র দেব বর্মা বলেন, সামনে শীত আসছে। কৃষকদের এখনই গম চাষের প্রস্তুতি নিতে হবে।গমের ক্ষতিকর রোগ ‘ব্লাস্ট’ থেকে বাঁচতে কৃষকদের আগামী অগ্রহায়ন মাসের ১ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে বীজ বপন শেষ করতে হবে।
তিনি বলেন, ছত্রাকটির বৈজ্ঞানিক নাম (ম্যাগনাপরথি অরাইজি পাইরিকুলারিয়া অরাইজি প্যাথোটাইপ ট্রিটিকাম)। গমের শীষ বের হওয়া থেকে ফুল ফোটার সময়ে তুলনামূলক উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া থাকলে এ রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ শীত ও গরমের তারতম্য বেশি হলে এ রোগ বেশি হয়।
তিনি জানান, এ রোগের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে কৃষকদেরকে ব্লাস্টমুক্ত গমের ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। অপেক্ষাকৃত কম সংবেদনশীল জাত বারি গম ২৮, বারি গম ৩০ এর চাষ করতে হবে। বপনের আগে প্রতি কেজি বীজের সঙ্গে ৩ গ্রাম হারে প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি অথবা ৩ মিলি হারে ভিটাফ্লো ২০০ এফএফ ছত্রাকনাশক মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধন করলে গমের অন্যান্য বীজবাহিত রোগও দমন হবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়া প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসেবে শীষ বের হওয়ার সময় একবার এবং এর ১২ থেকে ১৫ দিন পর আরেকবার ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। প্রতি ৫ শতাংশ জমিতে ৬ গ্রাম নাটিভো ৭৫ ডব্লিউ জি-নভিটা ৭৫ ডব্লিউ জি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
ড. নরেশ চন্দ্র দেব বর্মা আরো জানান, ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধক জাত হিসেবে আমরা বারি গম ৩৩ উদ্বাবন করেছি। তবে আগামীতে রোগ প্রতিরোধে আরো শক্তিশালী নতুন গমের জাত উদ্ভাবনে আমাদের গবেষণা চলছে। এরই মধ্যে গবেষণার ৩ বছর পেরিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগে আমাদের বীজের নমুনা পাঠানো হয়েছে। আশা করছি আগামী ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে আমরা কৃষকদের মাঝে আরো উন্নত জাতের গমের বীজ তুলে দিতে পারবো।
বাংলাদেশ এগ্রিকালসার রিসার্স কাউন্সিলের ফসল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ বলেন, ব্লাস্ট রোগটি ১৯৮৫ সালে সর্বপ্রথম ব্রাজিলে দেখা যায় এবং পরে ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা এসব দেশে এর বিস্তার হয়। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল ও ভোলা জেলায় প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, যা মোট গম আবাদি জমির প্রায় ৩ শতাংশ।
বর্তমানে এ রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচতে আক্রান্ত এলাকাসহ এর আশপাশের এলাকাতেও কৃষকদের সতর্কতামূলক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। রোগটি অনেকটাই কমে এসেছে। আশা করছি আরো কমে আসবে।
বাংলাদেশ এগ্রিকালসার রিসার্স কাউন্সিল সূত্র জানায়, গমের জাত ও বপনের সময়ভেদে রোগের মাত্রা এবং ফলনের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। এ রোগের কারণে আক্রান্ত গমের ফলন শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ কমে যায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে কোনো কোনো ক্ষেতের ফসল প্রায় সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়।
একই প্রজাতির ছত্রাক হলেও গমের প্যাথোটাইপ ধানে এবং ধানের প্যাথোটাইপ গমে ব্লাস্ট রোগ সংঘটিত করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং যুক্তরাজ্যের সেইনসবারি ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ সিকোয়েনসিংয়ের মাধ্যমেও প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত গমের ব্লাস্ট রোগের জীবাণু ধানের ব্লাস্টের জীবাণু থেকে আলাদা।
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্লাস্ট আক্রান্ত গম ক্ষেতের কোনো কোনো স্থানে শীষ সাদা হয়ে যায় এবং অনুকূল আবহাওয়ায় তা অতি দ্রুত সারা ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ে। গমের কিছু শীষের উপরিভাগ শুকিয়ে সাদাটে বর্ণ ধারণ করে যা সহজেই নিম্নভাগের সবুজ ও সুস্থ অংশ থেকে আলাদা করা যায়; আবার কোনো কোনো শীষের প্রায় সম্পূর্ণ অংশই শুকিয়ে সাদাটে হয়ে যায়। এটি গমের ব্লাস্ট রোগের আদর্শ লক্ষণ।
প্রধানত গমের শীষে ছত্রাকের আক্রমণ হয়। শীষের আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ পড়ে এবং আক্রান্ত স্থানের উপরের অংশ সাদা হয়ে যায়। তবে শীষের গোড়ায় আক্রমণ হলে পুরো শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়। আক্রান্ত শীষের দানা অপুষ্ট হয় ও কুঁচকে যায় এবং দানা ধূসর বর্ণের হয়ে যায়। পাতায়ও ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে পাতায় চোখের মতো ধূসর বর্ণের ছোট ছোট নেক্রোটিক দাগ পড়ে।
আক্রান্ত বীজ এবং বাতাসের মাধ্যমে গমের ব্লাস্ট রোগ ছড়ায়। বৃষ্টির কারণে গমের শীষ ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা ভেজা থাকলে এবং তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস অথবা এর বেশি হলে এ রোগের সংক্রমণ হয় এবং রোগের জীবাণু দ্রুত বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্লাস্ট রোগের জীবাণু কিছু ঘাস জাতীয় বিকল্প পোষক আগাছার যেমন- চাপড়া, শ্যামা, আংগুলি ঘাসের মধ্যে বাস করতে পারে; তবে সেখানে রোগের স্পষ্ট লক্ষণ সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। অনুকূল পরিবেশে বিকল্প পোষক আগাছায় ব্যাপকভাবে উৎপন্ন জীবাণু ব্লাস্ট রোগের মহামারী সৃষ্টি করতে পারে।
/ এআর /
আরও পড়ুন