ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪

ব্লু ইকোনমিতে নতুন সম্ভাবনা

রিজাউল করিম

প্রকাশিত : ১৭:৫১, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১৮:৪২, ৫ ডিসেম্বর ২০২০

ব্লু-ইকোনমি হচ্ছে সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। সাগরের অজস্র জলরাশি ও এর তলদেশের বিশাল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন পূরণে এক অর্থনৈতিক বিপ্লব। বিশাল সমুদ্র জয়ের পর সে বিপ্লব বাস্তবায়নের রোডম্যাপে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সমুদ্র অর্থনীতি ঘিরে নতুন স্বপ্ন দেখছে দেশ। আর সেই স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে এবং সমুদ্রের বিশাল সম্পদ আহরণে এবার ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

বিশ্বব্যাংক নীল সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চায়। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশে নিযুক্ত আবাসিক প্রধান মার্সি টেম্বন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে এ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। 

সাক্ষাৎ শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম সৌন্দর্য নদী। নদীকেন্দ্রিক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক বিনিয়োগ করতে চায়। তবে তাদের উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হয় না। তাদের আশ্বস্ত করেছি, প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি বেড়েছে। সক্ষমতাও বাড়ছে।

তিনি বলেন, নীল সমুদ্র অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা আছে। আমাদের ৮৮ শতাংশ নীল সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। এই খাতে আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে সহযোগিতা পেতে পারি। কারণ, তারা বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। 

অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, টাকার কোনো সমস্যা নেই। যত টাকা লাগবে বিশ্বব্যাংক দিতে প্রস্তুত। তবে তার আগে প্রকল্প তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশের শত বছর মেয়াদি ব-দ্বীপ পরিকল্পনায়ও তারা বিনিয়োগ করতে চায়।

ব-দ্বীপ পরিকল্পনার বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেদারল্যান্ডসের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকও এগিয়ে আসবে। এ খাতে টাকা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা দেবে। বিশ্বব্যাংক যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে আমাদের ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আরো ত্বরান্বিত হবে।  

এদিকে সাগরের সম্পদ আহরণে নেওয়া হয়েছে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কর্মপন্থা। উপকূলীয় দেশগুলোর প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেতে আগে থেকেই নেওয়া হয়েছে কার্যকরী পরিকল্পনা। এরইমধ্যে সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কার্যক্রম পরিচালনায় স্থায়ী একটি ব্লু-ইকোনমি সেল গঠন হয়েছে। 

আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর্তৃত্ব পায়। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠারও অধিকার পায় বাংলাদেশ।
 
সমুদ্রের এই অধিকার সূত্রে বিদ্যমান সামুদ্রিক সম্পদকে কাজে লাগানোর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে সমুদ্রসীমা জয়ের ফলে সমুদ্রে আমাদের সীমানা বেড়েছে, তেমনি এ সমুদ্র এলাকায় অনেক সম্পদ রয়েছে। এ সম্পদ ব্যবহারে মানবসম্পদ ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সরকার এ লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। এরইমধ্যে এ বিষয়ে কার্যকরী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

২০১৩ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশেরে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির পর সরকার এ বিশাল অঞ্চলের সম্পদ আহরণের জন্য চিন্তাভাবনা শুরু করে। ২০১৪ সালেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালা, যেখানে ১৯ দেশ থেকে ৩২ জন বিশেষজ্ঞ অংশ নেন। অতিথিদের উপস্থিতিতেই সমুদ্রের সম্পদ কাজে লাগানোর ব্যপারে প্রতিজ্ঞ হয় বাংলাদেশ।

সূত্র বলছে, গভীর সমুদ্রের ন্যায্য অধিকার পাওয়ায় মৎস্য আহরণের বিপুল সম্ভাবনাও দেখছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে, এ অঞ্চলের টুনা মাছ সারা বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। সুস্বাদু ও দামী এই মাছটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের হোটেলগুলোতে আমদানি করা হয়ে থাকে। টুনা মাছের বিচরণ গভীর সমুদ্রে। মালিকানা অধিকারে বাংলাদেশের ফিশিং ট্রলার এখন গভীর সমুদ্রে টুনাসহ অন্যান্য মাছ আহরণের সুযোগ পাচ্ছে। বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী ৩ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা আসে মৎস্য আহরণের মাধ্যমে।

মৎস্য আহরণের পাশাপাশি সমুদ্রের তীরবর্তী পর্যটনকেন্দ্রের মাধ্যমেও অর্থনৈতিক বিপ্লবের কথা ভাবছে বাংলাদেশ। পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবছর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় গড়ে এক হাজার হেক্টর করে ভূখণ্ড বাড়ছে। ব্লু-ইকোনমি রূপরেখা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সমুদ্রে ভূখণ্ড (ডেন্টা প্ল্যান) আরও বাড়ানো সম্ভব। কৃত্রিমভাবে বাঁধ তৈরি করে পলিমাটি জমাট/চর জাগানোর মাধ্যমে সৃষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে মালদ্বীপের মতো দৃষ্টিনন্দন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলাও সম্ভব। এতে দেশের অর্থনীতি বহুমাত্রিকতা পাবে।
 
এ বিষয়ে অতিরিক্ত সচিব ও ব্লু-ইকোনমি সেলের সমন্বয়ক গোলাম শফিউদ্দিন এনডিসি বলেন, মিয়ানমার থেকে সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে আমরা যে জায়গার অধিকারী হয়েছি, সেখানে বিপুল পরিমান সমুদ্র সম্পদ আছে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণের জন্য আমাদের সে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। কেননা এসডিজি’র ১৪ নম্বর ধারাই টেকসই উন্নয়নের জন্য সামুদ্রিক সম্পদের অনুসন্ধান ও সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।

সে লক্ষ্যে অস্থায়ী ব্লু-ইকোনমি সেল থেকে এখন স্থায়ী ব্লু ইকোনমি সেল গঠন করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে স্থায়ী ব্লু-ইকোনমি সেল গঠন হতে পারে। এটা হলে আমাদের কাজের গতি বেড়ে যাবে। সরকারের গুরুত্ব আর আমাদের এ কাজের গতি ধরে রাখতে পারলে আগামীতে বাংলাদেশ ব্লু ইকোনমিতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে আমার বিশ্বাস।

ব্লু -ইকোনমি সেলের দায়িত্বে থাকা সহকারী পরিচালক আরিফ মাহমুদ জানান, সমুদ্র সম্পদ বা ব্লু -ইকোনমি বিষয়ে আমাদের খুশির খবর হলো সেল গঠনের মাধ্যমে আমরা অনেক এগিয়েছি। সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে ১৭ মন্ত্রণালয় ও ১০টি অধিদপ্তরের মধ্যে কাজের সমন্বয় আনতে পেরেছি। আগে এ সমন্বয়ের অভাবে কাজ এগোচ্ছিল না। এখন নিয়মিত মিটিং হচ্ছে। সেখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরগুলোকে কাজের পরিধি ও সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বরও এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

তিনি বলেন, সমুদ্র সম্পদ আহরণে বিভিন্ন ক্যাটাগরির কয়েকটা জাহাজ কেনার পরিকল্পনা আছে। এরই মধ্যে দু’টা জাহাজ কেনার চিন্তাভাবনা এগিয়ে যাচ্ছে। একটা হচ্ছে বিদ্যুৎ জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ভূতাত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের মাধ্যমে। আমাদের দেশের মাটির নিচে থাকা সম্পদগুলোর আহরণের কাজ ভূতাত্বিক জরিপ অধিদপ্তর দেখে। আর গভীর সমুদ্রে তেল এবং গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স করে থাকে। তবে এ কাজগুলো করার জন্য এতোদিন আমাদের বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হয়েছে। এখন বাংলাদেশ নিজস্ব জাহাজ কিনবে। এটার মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশে খনিজ সম্পদ আদৌ আছে, কী নেই সেটা জানা যাবে।
 
গবেষণা সূত্রগুলো বলছে, ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাবার যোগান দিতে তখন সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতি বহুবিধভাবে অবদান রেখে চলেছে। বছরব্যপী ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্রকে কেন্দ্র করে। বিশ্বের ৪শ ৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের যোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে সমুদ্র নির্ভর ঔষধশিল্পও গড়ে তোলা সম্ভব।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বজুড়ে ব্লু-ইকোনোমি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিগত বছরগুলোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে এ বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। এর মধ্যে ২০১২-এ রিও+২০, সমুদ্র বিষয়ক এশীয় সম্মেলন, ২০১৩ সালে বালিতে অনুষ্ঠিত খাদ্য নিরাপত্তা এবং ব্লু-গ্রোথ ইত্যাদি সম্মেলনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অর্থনৈতিক সহায়তা এবং উন্নয়ন সংস্থা, জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি, বিশ্বব্যাংক, এফএও, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উন্নয়ন কৌশলের মূলেও থাকছে ব্লু-ইকোনোমি।

সংবাদ মাধ্যমের সূত্র বলছে, আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন ছোট বড় দেশ ব্লু-ইকোনোমি নির্ভর উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন করছে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্র নির্ভর। সম্প্রতি দেশটি এমনকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা গেলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান জাতীয় বাজেটের দশগুণ হবে। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। যা আগামীতে আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওইসব দেশগুলোর সমুদ্র সম্পদের সমৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে সমুদ্র নির্ভর ব্লু-ইকোনোমির মাধ্যমে। সমুদ্র বিজয় সে সম্ভাবনাকে আরও প্রসারিত করেছে।

আরকে//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি