ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

বড়ই বেদনার বিষয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:১১, ২৪ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ১৬:০২, ২৪ আগস্ট ২০২০

শামীম আজাদ বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ কবি ও সাহিত্যিক। তিনি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের লন্ডন শাখার চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উপন্যাস, কবিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর তার ৩৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা নিয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ দেশ বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বিচিত্র পুরষ্কার ছাড়াও তিনি আরও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। 

তখন আমি ছিলাম বিচিত্রার একমাত্র সাংবাদিক নারী। সে হবে আশি দশকের গোড়ার দিক। কিংবদন্তী সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী আমাদের পাইলট। আমাদের পুরো গুচ্ছটি পোক্ত হয়ে ছিল শাহরিয়ার কবীর, চিন্ময় মুৎসুদ্দি, কাজী জাওয়াদ, আলমগীর রহমান, আনু মুহাম্মদ, মাহমুদ শফিক, চন্দন সরকার ও আমাকে নিয়ে। আমরা সবাই তরুণ, সবাই সম্ভাবনাময়, সবাই তুখোড় এবং দুর্বার। আমাদের একেকটি কভার স্টোরি বেরোয় আর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে উঠে। মন্ত্রীদের যেমন দপ্তর ভাগ করা থাকে তেমনি  আমাদের শক্তি ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এলাকা ভাগ করে দিয়েছিলেন শাহাদত ভাই- শাচৌ।

আটাত্তরে যোগ দিয়েছি বিচিত্রায়। বেশ ক’বছরে হাত ঝুনা হয়েছে। অনায়াসে লিখে চলেছি বিচিত্র সব কভার স্টোরি, স্ট্রিপ, এক কলম, দু’কলাম একা কিংবা যৌথ লিখে এবং নিয়মিতভাবে আমার বাহিনী নিয়ে জমিয়ে তুলেছি ‘জীবন এখন যেমন’ যে বিভাগ শেষ চার পাতা যা আমি সম্পাদনা করি।

আমার বিষয়গুলো আমারই মত। দেখতে শুনতে চাখতে মাখতে। মধ্যবিত্ত জীবন যাপন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নারী নির্যাতন, নাগরিক জীবনের খাদ্যাভ্যাস, জীবন আধুনিকীকরণ, শিশুর জন্য অত্যাবশ্যক বুকের দুধ, দেশের কাপড় দেশি ফ্যাশন, ঈদের বাজার, ঈদের মেনু , শিক্ষালয়গুলোর পড়াশোনার হাঁস হকিকত বা অবস্থা, কিংবা ঢাকার বিনোদন ইত্যাদি।এর সবগুলোই মহিলা হিসেবে আমার জীবনাভিজ্ঞতা কেন্দ্রিক। কারণ আমি এক সৎ সরকারী চাকুরের কন্যা, মধ্যবিত্ত নারী, স্বামী বিদেশি সিগারেট কোম্পানীতে কাজ করেন, ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করি, দুই সন্তানের মা, সুতি শাড়ি পরি, বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে যাই, ফার্স্ট ফুড খাই, নাটক দেখি, আর্ট কলেজে গিয়ে ছবি আঁকাই। উল্লিখিত দিকগুলো নিয়ে আমার মত আমার সহকর্মীদের তেমন অভিজ্ঞতা নেই।

আর বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত বা উঠতি মধ্যবিত্ত এরাই বিচিত্রার গ্রাহক। আমাকে তখন এসব অতি গতানুগতিক বিষয়েই পাঠকীয় আগ্রহ তৈরি করার জন্য করতে হয়েছে নানান কৌশল। আমার সাদামাটা স্টোরিতে কাব্য এনে, স্যান্ডুইচের গায়ে রোদ ফেলে, টাঙাইল রাজশাহীর সুতোতে তার বুনন বর্ণনা করে এবং সরেজমিনে তাঁত তুলে আনতে আঁতের দিকে না তাকিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জে বেনোজলে ডুবন্ত তাতের তন্তুর হাহাকার এনে তৈরি করেছি আমার লেখায়। 

কর্মজীবী সাংবাদিক-নারী বলে আমি যখন প্রানান্ত করেছি তখন আমার পুরুষ সহকর্মীরা পোর্ট আনোয়ারার স্মাগ্লিং অথবা যুদ্ধাপরাধীরা কে কোথায় আছে অথবা বিমানের কারচুপি লিখে হিরো হয়ে যাচ্ছে। যা লোকে বেশি খাবে তার এ্যাসাইনমেন্ট আমার জন্য আসে না। শাচৌ আমাকে তেমন কোন রিপোর্ট করাননি। আমিতো আর পারবো না ক্রিমিনাল শিবিরে ঢুকে কোন বদমাশের সঙ্গে এক টেবিলে চা সিগারেট খেয়ে তার কথা বার করতে। অথবা কাজ সেরে রাত দুটো তিনটায় মতিঝিল থেকে একা রিক্সায় ফিরতে। কিংবা তাড়া খেয়ে লাফিয়ে স্ক্রুটারে উঠে পালাতে। মানলাম এ আমাদের তখনকার সমাজ ব্যবস্থা। কিন্তু আমি তা বলছি না। বলছি আরেকটি দিকের কথা। 

সত্তুরের শেষার্ধ থেকে আশি’র পুরোটা দশক আমি যেভাবে যে বিষয় দেখেছি, লিখেছি তখন ঢাকার কোনো পুরুষ সহকর্মীরা তার খুব কমই করেছেন। পারেননি। কারণ হয়তোবা, ছোটবেলা থেকে গৃহ জীবনের ঐ সব অভিজ্ঞতা তাকে ছেলে বলেই পুতু পুতু করে কেউ দেয়ায় নি। প্রতি মাসে ঋতুমতি হয়ে তাকে নিজেকে অচ্ছুত ভাবতে হয়নি। সন্তান জন্ম দেয়ার মত চূড়ান্ত এক সাহসী কাজের কোন অভিজ্ঞতাই তার হয়নি এবং এই অপূর্ব বিষয়টি সে তেমন করে বুঝেই না। সে জানেই না শিশু ন্যাপির সংগে নাড়ির সংযোগ। বাংলাদেশি খুব নগণ্য সংখ্যক পুরুষই আছেন যারা তার স্ত্রীর প্রসবকালে সামনে থেকে সে প্রক্রিয়া ও কষ্টটুকু প্রত্যক্ষ করেছেন। তাই পুরুষ সাংবাদিকগণ নারী বিষয় নিয়ে লিখলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই তা তুলে এনেছেন যা কিনা কখনোই সাংবাদিক- নারীর সমকক্ষ হয়নি। এখানে নারী এগিয়ে। 
তাহলে এ ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই যে অভিজ্ঞতা অভ্যাস, অধ্যবসায় ও সুযোগ থাকলে সব বিদ্যেই সবাই আয়ত্ব করতে পারলেও কয়েকটি বিষয় চাইলেও পুরুষরা পারবেন না। এবং তা তাদের শক্তি।

শাচৌ ব্যাপারটা বুঝতেন। মানের ক্ষেত্রে কারো কোন কমতি নেই। আছে তার ভিন্নতায়। কিন্তু বাইরের সমাজে তার মূল্যায়ন হয়না নায্যতার ভিত্তিতে। ঘরের বিষয়ের দাম কম, বাইরের বিষয়ে বেশি!

আমি মনে করি মানুষের কাজের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি হওয়া সমীচীন- সে কাজটি কে করেছে এবং কি করেছে তার বিবেচনায়। মূল্যায়নের সময় মনে রাখতে হবে তার জৈব উপলব্ধি ও তার অর্জনও কিন্তু তার শক্তি-কারণ তার জন্যও তাকে খেসারত দিতে হয়েছে। দৃশ্যমান সামাজিক সুযোগ প্রাপ্তির কারণে কর্মে সিদ্ধ হওয়া বা তা মোকাবিলা করার জন্য পুরষ্কৃত হওয়া ঠিক না। এতে নায্যতা হয় না । কিন্তু এ আমাদের সময়ে  জাতীয় জীবন থেকে বাস্তবে ব্যাতিক্রম ছাড়া সব পেশায় হয়েছে সর্বত্র। এখন  তা নবরূপে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে ঠিক তেমনি। ইহা বড়ই বেদনার বিষয়। বড়ই বেদনার বিষয়।

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি