ঢাকা, সোমবার   ০২ ডিসেম্বর ২০২৪

ভুলের বৃত্তে জীবন!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:৩৯, ২৬ মার্চ ২০২৪ | আপডেট: ১২:৩১, ২৬ মার্চ ২০২৪

দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছেন, তুমি যদি কোনো ভুল করে থাকো এবং সেটিকে সংশোধন না কর তাহলে সেটিই হচ্ছে প্রকৃত ভুল। 

আসলে ভুল করা প্রতিটি মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই যিনি ভুল করেন নি। এই ভুল করাকে আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছি। যার ফলে প্রবাদই দাঁড়িয়ে গেছে যে, মানুষ মাত্রই ভুল করে। 

আমরা গানও শুনি এরকম যে, ‘ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল’। এভাবে ভুলকে মেনে নিয়ে আমরা ভুলের বৃত্তে আটকে আছি। 

জীবনের চলার পথে বিভিন্ন সময়ে আমরা ভুল করছি। আর এই একই ভুল বার বার করার পেছনে দায়ী মূলত আমাদের অসচেতনতা। 

এই অসচেতনতার বৃত্ত থেকে বের হয়ে আমরা যেন আমাদের জীবনকে সুন্দর করতে পারি, আত্মনির্মাণে, আত্মউপলব্ধিতে, আত্মআবিষ্কারের পথে চলতে পারি সেজন্যে প্রতি মঙ্গলবারের আলোকায়নে জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখে, জীবনের ভুলগুলোকে নতুন করে উপলব্ধি করে, জীবনের শিক্ষাগুলোকে কাজে লাগাতে জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়। 

সে ধারাবাহিকতায় এবারের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে- ভুলের পুনরাবৃত্তি নয়, ভুল থেকে শিখুন। 

পৃথিবীতে মানুষের আগমনের যে ইতিহাস তা কিন্তু একটা ছোট্ট ভুলের জন্যে

স্রষ্টা হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করলেন, অনেক আরামে রাখলেন জান্নাতে, শুধু নিষিদ্ধ এক গাছের ফল খেতে নিষেধ করলেন। হযরত আদম (আ.) আর তার সঙ্গিনী মা হাওয়া সুখেই ছিলেন। কিন্তু ভুল করে শয়তানের প্ররোচনায় খেয়ে ফেললেন নিষিদ্ধ ফল, বিতাড়িত হলেন স্বর্গ থেকে। আর এভাবেই মানুষের মাঝে ঢুকে গেল ভুলের প্রবণতা।

আমরা প্রতিনিয়ত ভুল করি কিন্তু ভুলটাকে সহজে স্বীকার করতে চাই না আমাদের অবচেতন মনের অহমের কারণে। ভুল স্বীকার না করে আমরা বরং বিষয়টিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করি। এর ফলে আমরা ভুলটাকে আর বুঝতে পারি না, ভুলের মধ্যেই বাস করি। তখন সহজ-সরল জীবনটা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে যায়। 

আমরা অনেক সময়ই একটা প্রবাদ বলে থাকি যে, ‘ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়’ অর্থাৎ মানুষ একবার ভুল করলে আর ঐ পথে যায় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো যে, মানুষ সাধারণভাবে একই ভুলই বার বার করে। 

আমরা ভুলের ক্ষেত্রেও নতুন কোন ভুল করতে পারি না। দেখবেন, যে রাগী সে হয়তো একটি ব্যাপার ঘুরে ফিরে একইভাবে রাগ করে। যেমন- সন্তান জানে যে, মা-বাবা কোন বিষয়টিতে বেশি রাগ করেন। হয়তো সেই ঘটনাটিই সে বার বার করে, যাতে তারা ক্ষেপেন। 

বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই পরীক্ষার আগে প্রার্থনা করে, হে আল্লাহ! এই বার কোনো রকমে পাস করিয়ে দাও। এমন ভুল আর করবো না। পরের বার সব পড়া আগেই শেষ করে রাখবো, আর ফাঁকি দেবো না, সময় নষ্ট করবো না। কিন্তু পরীক্ষা শেষ! পরের পরীক্ষার আগে আবার একই ঘটনা। 

আমরা কি করি- রোজ ভাবি কালকে সকালবেলা ঠিক সময় মতো ঘুম থেকে উঠবো, নামাজ পড়বো, ব্যায়াম করবো। এরপর কি হয়? এলার্ম বাজে আমরা এলার্ম বন্ধ করে দিয়ে আবার ঘুমাই। অর্থাৎ আমরা ভুল সংশোধন করার বদলে ভুলের পুনরাবৃত্তিই করি, ভুলের বৃত্তে ঘুরপাক খাই।

আসলে একই ভুল বার বার করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। আহাম্মকেরাই একই ভুল বার বার করে, আর জ্ঞানীরা ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বা সংশোধনের আন্তরিক প্রচেষ্টা চালায়। 

আসলে ভুল করা যতটা দোষের ভুলের পুনরাবৃত্তি তার চেয়ে বেশি দোষের। যতক্ষণ না নিজের ভেতর থেকে অভ্যাসটাকে বদলাতে পারবেন, ততক্ষণ আপনার দুর্দশা কেউ ঘোচাতে পারবে না। 

ভুল ছোট বা বড় সব ব্যাপারেই সচেতন হতে হবে

অনেক সময় ছোট ছোট ভুলগুলোকে অবহেলা করতে করতেই আমরা বড় গর্তে পড়ে যাই। একটা ছোট্ট ছিদ্রই কিন্তু একটা বিশাল জাহাজকে ডুবিয়ে দিতে পারে।

গ্যাংগ্রিন হয় ছোট্ট একটা কাটা থেকে। ছোট্ট একটা সিগারেটের টানই একজন ধূমপায়ীর জীবনে আসক্তির প্রথম পদক্ষেপ। 

আবার যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে দেখবো সম্রাট জাহাঙ্গীর তার কন্যার নিরাময় লাভের বিনিময়ে ব্রিটিশ চিকিৎসককে উপহারস্বরূপ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিনা মাশুলে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এর পরিণতিতে পুরো জাতিকে ২০০ বছরের পরাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে হয়েছে। 

আমাদের পারিবারিক জীবনেও যে অশান্তি, কলহ বা ঝগড়ার সূত্রপাত তা হয়তো খুব সাধারণ, ছোট্ট একটি বিষয় নিয়ে। 

অনেক সময় আমরা অপরপক্ষকে সেন্টিমেন্টে আঘাত করে কথা বলি যা আমাদের পরস্পরের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। ছোট্ট একটা বিষয় থেকে বিরাট কলহ এমনকি বিচ্ছেদেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

অতএব ছোট ছোট ভুলগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সংশোধনের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে, সচেতন হতে হবে। 

ভুল আসলে মানুষের জীবনে থাকবেই। রাতারাতি সবকিছু বদলে যায় না। তাকে সময় দিতে হবে, চেষ্টা করতে হবে। তবে আন্তরিক চেষ্টা করলে আস্তে আস্তে ভুলের পরিমাণ কমতে থাকবে। 
ভুল না করার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তবে অতীত ভুলকে বার বার মনে করে অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় পাপবোধ অর্থাৎ অহেতুক অনুশোচনা যেন আমরা না করি।

ভুলের পুনরাবৃত্তি হয়ে গেলেও হতাশ হওয়া যাবে না। বার বার চেষ্টা করতে হবে ভুলের গতি প্রকৃতি বিচার বিশ্লেষণ করে ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার একবার বলেছিলেন- ‘মানুষের সাফল্য সবটুকু করতে পারায় নয়, সাধ্যমতো করতে পারায়। সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে। সেটাই স্রষ্টা দেখবেন।

আসলে নিজের ভুলের জন্যে স্রষ্টার কাছ থেকে ক্ষমা পেতে চাইলে অন্যের ভুলকে ক্ষমা করতে হবে আগে। ততবার অন্যকে ক্ষমা করতে হবে, যতবার স্রষ্টার কাছে আমরা ক্ষমা চাই। প্রাকৃতিক নিয়মেই তখন ভুলের পরিমাণ কমতে থাকে। 

নিজের কাজের জন্যে বা নিজের ভুলের জন্যে নিজের কাছে জবাবদিহিতা হলো ভুল কমাবার সবচেয়ে ফলপ্রসূ প্রক্রিয়া।

আসলে বুদ্ধিমান মানুষ সবসময় নিজের ভুল বুঝতে পারেন, নিজের ভুলের দিকেই দৃষ্টি দেয়। 

দেখা যাচ্ছে যে, অস্থির অবস্থায়ই মানুষ ভুল করে বেশি। কাজে মনোসংযোগ না থাকলে কোনো কাজই সুশৃঙ্খলভাবে সঠিক উপায়ে করা যায় না। স্থির থাকলে সব কাজই সুন্দরভাবে করা যায়, যেকোনো অবস্থায় রি-এক্ট না করে সুন্দরভাবে বিষয়টি সমাধান করা যায়। 

যখন একজন মানুষ একটু সুস্থির হতে পারে, নীরবে চিন্তা করতে পারে তখন সে মস্তিষ্ককে ব্যবহার করতে পারে এবং সমাধানের নতুন পথ পেয়ে যায়। একমাত্র মেডিটেশন পারে আপনাকে স্থির করতে। ফলে আপনার কাজের গতি বাড়াবে, মনোসংযোগ বাড়াবে, কাজে পর্যালোচনাও বাড়বে নিয়মিত, সেই সাথে ভুলের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে জীবনের প্রশান্ত অনুভূতিতে সিক্ত হতে পারবেন। 

স্রষ্টা আমাদের সকলকেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভুলের বৃত্ত ভাঙার সুযোগ দিন।

এমএম//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি