ভেড়ায় ফরিদার ভাগ্য বদল
প্রকাশিত : ২০:০৬, ৩১ মার্চ ২০১৯
কিশোর বয়সেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। ১৯৮০ সালে বয়স তখন ১৭, যে কিশোর বয়সে ফরিদার জীবন কাটানোর কথা বিদ্যালয়ের লেখা-পড়ার পাশাপাশি আনন্দে। সেই বয়সেই তাকে যেতে হয়েছে স্বামীর সংসারে।
বিয়ের নয় মাসের মধ্যেই দুই মাসের অন্তসত্বা অবস্থায় স্বামীর সংসার থেকে বিতারিত হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু গৃহবধূ ফরিদার। পিতার সংসারে বোঝা হয়ে থাকেন দুটি বছর। এরপরই নিজের চেষ্টায় ভাগ্য বদলের ভাবনা। স্বামী আতাউর মিয়া তাকে ফেলে যাওয়ার ৮ মাস পর তার একমাত্র সন্তানটি দুনিয়ার আলো-বাতাস দেখে। এভাবে পিতার সংসারে কাটে আরও কিছু সময়। দ্বিতীয় বিয়ের জন্য মাতা-পিতার ও স্বজনদের চাপ ছিলো রীতিমতো। দ্বিতীয় বিয়ের চাপ থাকার পরও দ্বিতীয় বিয়ে না করে নিজের ওপর শতভাগ বিশ্বাস রেখে চলতে থাকেন তিনি।
১৯৮৫ সালে সন্তানের বয়স যখন ২ বছর তখন তার ভাই আবুল হোসেন ৮০ টাকা দিয়ে তাকে একটা ভেড়া উপহার দেন। পিতার সংসার ছেড়ে আশ্রয় নেন আশুলিয়ার কুমারখোদা আশ্রয়ন প্রকল্পে। তারপর থেকে ভেড়া আর ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে যাত্রা শুরু তার অভাব-অনটনের সংসার। ভেড়াটিকে নিজের সন্তানের মতো যত্নে লালন-পালন করতে লাগলেন তিনি। মাঝে মধ্যে ভেড়াটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। ৩৪ বছর পর তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। ফরিদার ভেড়ার খামারে এখন অর্ধশতাধিক ভেড়া রয়েছে। প্রতি বছরই কোরবানী ঈদে ৫০ হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকার ভেড়া বিক্রি করেন। কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই ২.৫ দশমিক জায়গায় এই ভেড়া পালন করে আসছেন তিনি। ছেলে বাবুল হোসেনকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেকও তিন বিঘা জমির ওপর গোলাপের বাগান করে দিয়েছেন। মা ব্যস্ত সময় কাটান ভেড়ার সঙ্গে আর ছেলে কাটান গোলাপের বাগান আর দোকানে। মা ছেলের প্রতি বছর প্রায় কয়েক লাখ টাকা সঞ্চয় করতে পারছেন। এখন তাদের সংসারে নেই কোন আর্থিক কষ্ট। তাদের দেখে অনেকেই নিজেরদের বাড়িতে পালন করছেন ভেড়া।
কথা হয় ফরিদার ছেলে বাবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার মা আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। জন্মের পর পিতাকে পাইনি। মা’ই আমার সব, মা’ই আমার বাবা। তিনি কষ্ট করে নিজের জন্য কিছুই করেননি। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন আমার জন্য। স্বাবলম্বী হয়েছেন নিজে, করেছেন আমাকেও। ভেড়াকে তিনি সন্তানের মতই দেখেন। কোনো একটি ভেড়া অসুস্থ হলে অস্থির হয়ে ওঠেন মা। যতক্ষণ ভেড়া ভালো না হয় ততক্ষণ খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দেয় মা। তিনি আরও বলেন, ভেড়া বিক্রিও তার জন্য কষ্টদায়ক। যেদিন ভেড়া বিক্রি করি সেদিন মা ভেড়ার কষ্টে সারাদনি কাঁদেন। তবে ভেড়াই মাকে নতুন জীবন দিয়েছে। মায়েরও ইচ্ছা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভেড়া পালন করে যাবেন।
নিজের ইচ্ছা শক্তি ও কঠোর পরিশ্রমে ভাগ্য পরিবর্তন করা এই সংগ্রামী ফরিদার তার জীবনের গল্প বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন, পেটে দুই মাসের বাচ্চাসহ আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমার তখন মাত্র ১৭ বছর বয়স। যখন আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গেলো তখন আমি নিজেই কিছু করতে চেয়েছি আর সফলও হয়েছি। কিন্তু তখন আমার কাছে শুধু ভাইয়ের দেওয়া একটি ভেড়ার বাচ্চা ছিলো। সেই ভেড়ার বাচ্চা আর আমার শিশু সন্তানকে নিয়ে শুরু করি আমার নতুন সংসারের।
ভাইয়ের দেওয়া ৮০ টাকার একটি ভেড়ার বাচ্চা থেকে এখন আমার ভেড়ার সংখ্যা অর্ধশতাধিক। বছর খানেক আগেও ছিলও ৯০টির মতো। জায়গার স্বল্পতা ও তার বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে ভেড়া বিক্রি করে দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ ৩৫টি বছর ধরেই ভেড়া লালন-পালন করে আসছি। ৩/৪ বছর আগেও বছরে ৩৫/৪০টির মত ভেড়া বেচতাম। আগে দাম ছিলো কম এখন দাম বাড়ছে। আমাগো বাড়ির পাশের বাজারে ভেড়া নিয়ে গেলে প্রতিটি ভেড়া প্রায় ৭-৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। বিভিন্ন সময় সংসারে টাকার দরকার হয় তখন ভেড়া বেচেই সংসারের ঝামেলা সামলাই। বছরে দুইবার ভেড়া বাচ্চা দেয় প্রতিবার ২/৩টি করে বাচ্চা হয়। এতোগুলো ভেড়া পালতে আমার কষ্ট হয়ে যায়। ঘরের মধ্যে জায়গাও কম। তাই মাঝে মাঝে ভেড়া বিক্রি করে কমাইয়া রাখি।
মুখে হাসি নিয়ে ফরিদা বেগম বলেন, আমি আমার ছেলের সন্তানদের (নাতি-নাতনিদের) শিক্ষার খরচ বহন করি। এই ভেড়া বিক্রি করে আমি গোলাপ ফুলের বাগান করছি, কানের, গলার গয়না বানাইছি। আরও আমার ছেলের বৌয়ে’র গয়না বানিয়ে দিয়েছি। ছেলের তিন বিঘা জমি লিজ নিয়ে গোলাপ ফুলের বাগান করে দিয়েছি। গত বছর ভেড়া বিক্রির টাকা দিয়ে ছেলেকে একটি দোকান করে দিয়েছি। পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছি। আমি আল্লাহর রহমতে আমার সংসার ও ভেড়া নিয়ে ভালোই আছি। আমার ভেড়া পালনের সফলতা দেখে গ্রামের অনেকই ভেড়া পালতে শুরু করেছে। তাদের অনেকই আমার নিকট থেকে বিভিন্ন সময় পরামর্শ নিতে আসেন।
এসএইচ/
আরও পড়ুন