মন সুস্থ তো দেহ সুস্থ
প্রকাশিত : ১৭:৪৬, ২৮ জানুয়ারি ২০২৪
গল্প নয়, সত্যি। পারস্যের এক রাজকুমার। তার এক অদ্ভুত রোগ হলো। নিজেকে মানুষ নয়, মনে করত সে একটি গরু! গরুর মতো হাম্বা হাম্বা স্বরে ডাকাডাকিও করত। একপর্যায়ে খাওয়াদাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিল। কেঁদে কেঁদে সে আর্জি জানাত, ‘আমাকে মারো, আমাকে জবাই করো, তোমরা আমার গোশত রান্না করে খাও।’ রাজকুমারের এই অবস্থা দেখে রাজা পড়লেন মহাবিপদে। কোন ডাক্তার-হেকিম করবে এ অদ্ভুত রোগের চিকিৎসা?
রাজা সে-সময় পারস্যের প্রখ্যাত চিকিৎসক ইবনে সিনার শরণাপন্ন হলেন এবং পুত্রের জীবন রক্ষার অনুরোধ জানালেন। ইবনে সিনা চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন। বুঝতে পারলেন, এটি মনস্তাত্তি্বক কোনো জটিলতা। তিনি রোগীর কাছে এক লোক পাঠিয়ে বললেন, ‘রাজকুমারকে গিয়ে আশ্বস্ত করো—তোমাকে জবাই করার জন্যে শিগগিরই কসাই আসবে। তুমি প্রস্তুত থেকো।’
একথা শোনার পর রাজকুমার মহাখুশি। ভাবখানা এমন যে, তার গরু হয়ে জন্মানোটা এবার সার্থক হতে যাচ্ছে! একসময় ইবনে সিনা একটি বড় ধারালো ছুরি হাতে হাজির হলেন। রাজপ্রাসাদে গিয়ে খুঁজতে শুরু করলেন—‘আমার গরুটা কোথায়? আমি এখন তাকে জবাই করব।’ রাজকুমার গরুর মতো হাম্বা শব্দ করে জানান দিল—এই যে, গরু এখানে!
ইবনে সিনার নির্দেশে সবাই তাকে ধরে শোয়াল। রোগীও আনন্দে শুয়ে পড়ল। ইবনে সিনা রাজকুমারের গলায় ছুরি ঠেকিয়ে বললেন যে, ‘নাহ! এই গরুটা খুব হ্যাংলাপাতলা, এর গায়ে তো তেমন গোশতই নেই। জবাই করব না। একে খাওয়াদাওয়া করাও। একটু মোটাতাজা হোক, তাহলে এর গোশত সুস্বাদু হবে।’
রোগীও ভাবল, তা-ই তো! এরপর রোগীকে যে খাবারই দেয়া হয়, তৃপ্তির সাথে সে খেতে শুরু করল। মোটাতাজা তাকে হতেই হবে। নিয়মিত খাবারের পাশাপাশি রোগীর সাথে কাউন্সেলিং শুরু করলেন ইবনে সিনা। ধীরে ধীরে রোগী তার স্বাস্থ্য ফিরে পেল। মানসিক অবস্থার উন্নতি হলো তার। একসময় সুস্থ হয়ে উঠল রাজকুমার। দূর হলো মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা।
মনোদৈহিক চিকিৎসার অগ্রপথিক
চিকিৎসাবিজ্ঞানে মনস্তত্ত্বের প্রয়োগ ও প্রমাণ দুটোই প্রথম করেছিলেন ইবনে সিনা। এখন থেকে হাজার বছর আগে চিকিৎসাজগতে তার অমর গ্রন্থ কিতাবুশ শেফা-য় তিনি বলেছেন, ‘মন দেহকে প্রভাবিত করে সবচেয়ে বেশি। মন সুস্থ হলে অর্থাৎ মনের আবর্জনা-ক্ষত-ব্যাধির নিরাময় হলে একজন মানুষ সহজেই সুস্থ হয়ে ওঠে।’
অথচ একশ বছর আগে পাশ্চাত্যের চিকিৎসকেরা ওষুধ বা রাসায়নিক উপাদান ছাড়া কোনোকিছুকেই নিরাময়-সহায়ক হিসেবে গণ্য করতেন না। বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে ইবনে সিনার এই তত্ত্বই সত্য বলে প্রমাণিত। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের যত ধরনের রোগ হয়, তার ৭০-৭৫ ভাগই মনোদৈহিক অর্থাৎ মন থেকে সৃষ্ট।
ইবনে সিনা তার অভিজ্ঞতা থেকে আরো বলেছেন, ‘সুস্থ মানুষও অসুস্থ হতে পারে, যদি সে মনের দিক থেকে আতঙ্কিত থাকে। আবার অসুস্থ একজন মানুষ শুধু ইচ্ছাশক্তি দ্বারাই পুরোপুরি সুস্থ হতে পারে।’ দেহের ওপর মনের প্রভাব কত বেশি—এ বিষয়ে তার একটি যুগান্তকারী উদাহরণ আছে।
রাস্তার ওপর একটি সরু কাঠের তক্তা বিছিয়ে দিয়ে কাউকে যদি বলা হয়, এর ওপর দিয়ে হেঁটে যাও। অনায়াসে তক্তার ওপর দিয়ে সে হেঁটে যাবে। একই তক্তা যদি খালের ওপর পুল হিসেবে বিছিয়ে দেয়া হয় এবং সেই ব্যক্তিকে তক্তার ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে বলা হয়, তাহলে ঘটবে উল্টো ঘটনা। শক্ত-সমর্থ পা দুটি দিয়ে সে আর পুল পার হতে পারবে না। কয়েক কদম চলার পর ধপাস করে পড়ে যাবে। কিন্তু কেন?
কারণ পুলের ওপর দিয়ে পার হওয়ার সময় সে ভাবে, ‘যদি পড়ে যাই’! আর নিউরোসায়েন্সের মতে, মানুষ যা কল্পনা করে, মস্তিষ্ক সেই বাস্তবতাই তৈরি করে। ঠিক তেমনি পুল থেকে পড়ে যাওয়ার ছবিটা ব্যক্তির মস্তিষ্কে গভীরভাবে গেঁথে যায় এবং তার মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পা দুটিও স্বাভাবিক শক্তি ও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং সে পড়ে যায়।
ইবনে সিনার এ উদাহরণটি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় মন নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলোতে যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কোয়ান্টাম মেথড কোর্সেও এই উদাহরণটি উল্লেখ করা হচ্ছে ২৭ বছর ধরে।
ইবনে সিনা শুধু চিকিৎসকই ছিলেন না। তিনি একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, কবি, ধর্মতত্ত্ববিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষবিজ্ঞানী ছিলেন। তখনকার দিনে জ্ঞানের এমন কোনো শাখা ছিল না, যেখানে তার বিচরণ ছিল না। মেধা ও যোগ্যতার জন্যে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন অল্প বয়সেই। অর্থ-প্রতিপত্তির ঊর্ধ্বে জ্ঞান অর্জনকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন তিনি।
জ্ঞানের জন্যে উৎসর্গীকৃত জীবন
তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর। বোখারার আমিরের গুরুতর এক ব্যাধি হলো। তখনকার অভিজ্ঞ ডাক্তার-হেকিম যারা ছিলেন, সবাই চিকিৎসা করতে ব্যর্থ হলেন। ইবনে সিনা বললেন, ‘আমি চেষ্টা করে দেখি।’ তার চিকিৎসা পেয়ে আমির সুস্থ হলেন এবং খুশি হয়ে বললেন, ‘কী পুরস্কার চাই তোমার?’
এই বলে আমির তার গলার রত্নখচিত মালাটি খুলতে শুরু করলেন ইবনে সিনাকে দেয়ার জন্যে। ইবনে সিনা বলে উঠলেন, ‘আমার একটি চাওয়া আছে। আপনার যে বিশাল লাইব্রেরি আছে, সেখানে আমি পড়াশোনা করার অনুমতি চাই।’
সাথে সাথেই আমির বললেন, ‘আমার লাইব্রেরিতে এখন থেকে তুমি ইচ্ছেমতো প্রবেশ করবে এবং পড়াশোনা করবে।’
জ্ঞানচর্চায় তিনি এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে, একবার সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যে একশ পৃষ্ঠার গবেষণা নিবন্ধ লিখে ফেললেন। ঘোড়ার পিঠে বসেও লিখতে পারতেন। একসময় তার জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বময়, হয়ে উঠলেন আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক। সভ্যতাকে করলেন চিরঋণী।
ইবনে সিনার জন্ম উজবেকিস্তানের বোখারায় এবং মৃত্যুবরণ করেন ইরানের হামাদানে।
মাত্র ১০ বছর বয়সে কোরআনে হাফেজ হন।
১৬ বছর বয়সে আত্মস্থ করেছিলেন এরিস্টটলের মেটাফিজিক্স। পরবর্তী দুবছরে চিকিৎসাবিজ্ঞানে দক্ষ হয়ে ওঠেন।
দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী, এই পাঁচশ বছর তার বই ক্যানন অব মেডিসিন বা আল কানুন ফিত-তিব চিকিৎসাশাস্ত্রে পাঠ্যবই হিসেবে ইউরোপে পড়ানো হয়।
তিনিই প্রথম এনাটমি, পেডিয়াট্রিক্স এবং গাইনোকোলজির কিছু মৌলিক তত্ত্ব তুলে ধরেন। ব্যাখ্যা করেন চোখের এনাটমি।
যক্ষ্মারোগ প্রথম শনাক্ত করেন ইবনে সিনা এবং প্রমাণ করেন যে, এটি ছোঁয়াচে। রোগ যে পানি ও মাটি দ্বারা বাহিত হতে পারে, এই ধারণাও তার দেয়া।
শরীর, মন ও আত্মার যোগসূত্রে যে চিকিৎসাপদ্ধতি অর্থাৎ হলিস্টিক মেডিসিন, এর প্রণেতাও তিনি।
জীবনের শেষ দিকে তিনি প্রায়ই ধ্যানে নিমগ্ন হতেন অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের মৌলিক বিষয় নিয়ে।
এমএম//