ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

মস্তিষ্কই আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:০৬, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বিশ্বের সমস্ত সম্পর্কের মধ্যেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক অনন্য। এই সম্পর্ক মনকে ভালো রাখে। সময়ের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একজন ভালো বন্ধু অনেক কিছু পরিবর্তন করে দিতে পারেন। পৃথিবীর সমস্ত কিছুর মধ্যে বন্ধু চেনা কঠিন কাজ। কিন্তু বন্ধু কি সবাই? কীভাবে বুঝবেন আসলে আপনার বন্ধু কে? সত্যিকারের বন্ধু চেনার উপায় কি? আজ আমরা আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ডকে চিনব। আপনি হয়তো বলবেন-আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের এই নাম, সেই নাম। তাদেরকে তো আমি চিনি। খুব ভালো, চেনেন। 

এবার তাহলে আরেকটি প্রশ্নের উত্তর দিন। এই ফ্রেন্ডরা আপনার জন্যে কেন বেস্ট? হয়তো বলবেন-এই বেস্ট ফ্রেন্ডরা আমার জন্যে কত কী করে! আমার প্রয়োজনের সময় আমাকে সাহায্য করে। যখন দরকার, ডাক দিলেই চলে আসে। খুব ভালো। এরকম বন্ধু পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। এই বেস্ট ফ্রেন্ডদের মধ্যেও বেস্ট একটি ফ্রেন্ডকে আজ আমরা নতুনভাবে বুঝতে চাই। যে ফ্রেন্ড আপনার সার্বক্ষণিক সঙ্গী এবং যে আপনার শিরোমণি হয়েই আছে। এখন বোঝা যাচ্ছে তো? জ্বী, আমরা মস্তিষ্কের কথাই বলছি। আমাদের ব্রেনের কথা বলছি।

কেন মস্তিষ্ককে আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ডদের মধ্যেও বেস্ট বলছি? কারণ-এই বেস্ট ফ্রেন্ড শুধু আমাদের ভালো এবং কল্যাণের জন্যেই কাজ করে। আপনি যা নির্দেশনা দেবেন, তা-ই করবে। অনেকটা আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের মতো। যার ক্লান্তি নেই, সারাক্ষণ শুধু তার কাজ চাই।

মস্তিষ্ক নিয়ে যত গবেষণা করছেন ততই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন বিশাল সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে তীরে ধেয়ে আসা ঢেউই কেবল তারা গুনছেন। মস্তিষ্কে ১০০ বিলিয়ন নিউরোন সেল রয়েছে। প্রতিটি নিউরোন ১ হাজার থেকে ৫ লক্ষ নিউরোনের সাথে সংযুক্ত। প্রতিমুহূর্তে কমপক্ষে ১০০ ট্রিলিয়ন সংযোগ ঘটছে মস্তিষ্কে। জার্মানির বিখ্যাত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. ম্যানফ্রেড ইগান নিরীক্ষা করে দেখেছেন যে, ব্রেনের কোনো কোনো কেমিক্যাল রি-একশন সংঘটিত হতে সময় লাগে মাত্র এক সেকেন্ডের ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়। তিনি বলেছেন, একটি দ্রুতগামী গাড়ির নিচে পড়া থেকে বাঁচার জন্যে এক পা পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া ও তা কার্যকর করার জন্যে এক লক্ষ নিউরোনের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের প্রয়োজন হয় এবং পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে। ভাবতে পারেন, আমরা রাস্তা পার হতে গিয়ে একটি রিকশার চাকার নিচে পড়া থেকেও বাঁচার সময় কী ঘটে যাচ্ছে এই খুলির ভেতরে!

দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ব্রেন। ব্রেনই মানুষকে প্রথম পাথরের অস্ত্র তৈরি করতে শিখিয়েছে। আর সেই ব্রেনের জেনেটিক উত্তরসূরিরাই বানিয়েছে মহাশূন্যযান। মানুষ অতীতে যা করেছে, ভবিষ্যতে যা করবে তা এই ব্রেনেরই ফসল। ব্রেনই মানুষকে ‘মানুষ’ বানিয়েছে। আসুন, সবাই মিলে বলি-হে প্রভু, এজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ!

ব্রেন অনেক অনেক সূক্ষ্ম কাজ অনায়াসে সম্পন্ন করে। মানুষের হার্ট ও দম মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেন, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেন, গরম কিছুতে ছ্যাকা লাগার সাথে সাথে হাত সরিয়ে নেয় ব্রেন। আর এ নিয়ন্ত্রণ পরিচালিত হচ্ছে মানুষের সচেতনতার অজ্ঞাতে। কম্পিউটারকে সুইচ অফ করে বন্ধ করে দেয়া যায়, কিন্তু ব্রেনকে বন্ধ করার উপায় নেই। আপনি কাজ করুন বা ঘুমিয়ে থাকুন ব্রেন সবসময়ই সক্রিয় থাকে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে-এই শক্তিশালী মস্তিষ্কের চালক হচ্ছে মন। আপনি মনের সচেতন বা অবচেতন স্তরে আপনার মস্তিষ্ককে যে নির্দেশ, প্রোগ্রাম বা সাজেশন দিচ্ছেন তা-ই সে বাস্তবায়ন করছে মাত্র। আপনার আজকের যে বাস্তবতা তা হচ্ছে আপনি গতকাল পর্যন্ত যা ভাবছেন তা। আপনি যদি মস্তিষ্কের বন্ধুত্বের গভীরতাকে বুঝতে পারেন, আপনি তাকে সঠিক উপায়ে নির্দেশনা দেন, তাহলে আপনার চাওয়া বাস্তবায়নের জন্যে সে দিনরাত কাজ করবে।

ছোট বাচ্চারা কাদামাটি নিয়ে খেলার সময় তাতে পানি মেশায়, নরম করে, তারপর মাছ, পাখি, পুতুল, ফুল তৈরি করে। তারা কল্পনা করে তারপরে তৈরি করে। আমরা মস্তিষ্ক দিয়ে সেভাবেই আমাদের প্রয়োজনীয় সুখশান্তি, প্রাচুর্য, সুস্বাস্থ্য তৈরি করে নিতে পারি। প্রয়োজন শুধু সঠিক ভাবনা, চিন্তা দিয়ে যথাযথভাবে তাকে পরিচালিত করা। নিউরোসায়েন্টিস্টরা গবেষণায় দেখেছেন, যখন মস্তিষ্কে নতুন বিশ্বাস, নতুন ধারণা, নতুন স্বপ্ন যায়, তখন মস্তিষ্কের নিউরোনে নতুন সংযোগপথ রচিত হয়। একই বিশ্বাস, একই স্বপ্ন, একই ধারণা, একই কল্পনার পুনরাবৃত্তি এই সংযোগপথকে রাখে ব্যস্ত ও সক্রিয়। সংযোগপথ মসৃণ থেকে মসৃণতর হতে থাকে। মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ অংশ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। বদলে যায় মস্তিষ্কের কর্মকাঠামো। তখন আপনার সকল মনোদৈহিক প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে শুরু করে লক্ষ্য বাস্তবায়নে।

পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। যদি প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ বার বলেন-‘আমি সাহসী, আমি নির্ভীক’, কিছুদিনের মধ্যেই আপনি আপনার নিজের সাহস দেখে অবাক হয়ে যাবেন। মস্তিষ্কে ক্রমাগত প্রেরণ করা এই অটোসাজেশন আপনাকে সাহসী করে তুলবে। কিন্তু আমরা কী করছি? নানা ধরনের আবর্জনা দিয়ে ভরে রাখছি আমাদের মস্তিষ্ককে। এই আবর্জনাগুলো হচ্ছে আমাদের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা, নেতিবাচক আবেগ, অনুভূতি এবং কর্মকাণ্ড।

শার্লক হোমসকে আমরা সবাই চিনি। লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল সৃষ্ট কল্পিত গোয়েন্দা চরিত্র। ‘এ স্টাডি ইন স্কারলেট’ উপন্যাসে হোমস ব্রেন সম্পর্কে তার বন্ধু ডা. ওয়াটসনকে বলছেন- “একজন মানুষের মস্তিষ্ক হলো প্রকৃতপক্ষে একটি খালি কুঠুরির মতো, তোমাকে তোমার মনমতো আসবাব দিয়ে কুঠুরিটি সাজাতে হবে। একজন বোকা মানুষ সামনে যা পায় তা দিয়েই তার কুঠুরিটিকে ভরিয়ে তোলে, যেন সেটি একটি গুদাম ঘর। এভাবে অপ্রয়োজনীয় জিনিসে কুঠুরিটি এতটাই ঘিঞ্জি হয় যে, প্রয়োজনের সময় সেখান থেকে দরকারি জিনিসগুলো বের করে আনাই মুশকিল। একজন দক্ষ কারিগর এ ব্যাপারে খুব হুঁশিয়ার যে সে তার মগজ কুঠুরিতে কী কী জিনিস নেবে। এভাবে বাজে জিনিস ঠাসতে গিয়ে এমন একটা সময় আসবে যখন প্রতিটি নতুন জ্ঞানের বিপরীতে তুমি এমন একটি কিছু ভুলে যাবে যা তুমি আগে জানতে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যেন অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান কখনো আমাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞানগুলোর সামনে চলে না আসে।”

আসলে বেস্ট ফ্রেন্ডকে নিজের সাফল্যে ব্যস্ত রাখতে হলে আমাদেরকে এই নেতিবাচকতা নামক আবর্জনা থেকে মুক্ত করতে হবে। আমাদের অধিকাংশের চিন্তাজগতের শতকরা ৭০-৮০ ভাগই দখল করে রাখে রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, দুঃখ, কষ্ট, বেদনা ইত্যাদি নেতিবাচক আবেগ ও চিন্তাভবনা। ইতিবাচক চিন্তাভাবনা দিয়েই ভরে দিতে হবে ব্রেনের কুঠুরি। কিন্তু বিষয়টি অতটা সহজ হয়তো আমাদের মনে হবে না। এজন্যে প্রয়োজন সচেতন প্রচেষ্টা।

শকুন্তলা দেবী ছিলেন ভারতের জীবন্ত ক্যালকুলেটর। তিনি যে-কোনো ধরনের গণনা ক্যালকুলেটরের চেয়ে আগেই মুখে মুখে বলে দিতে পারতেন এবং তা সবই নির্ভুল হতো। নিশ্চয়ই ব্রেনের সেই দিকটিকে তিনি ব্যবহার করতে পেরেছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আবার একজন হাফেজ সাহেব ৬২৩৬ আয়াত কীভাবে মুখস্ত করছেন ভেবে দেখুন। তিনিও তার ব্রেনকেই ব্যবহার করেছেন।

এখন আমরা কীভাবে মস্তিষ্ককে ব্যবহার করতে পারি? আমরাও যুক্তিসঙ্গত অনেক কিছু অর্জন করতে পারি আমাদের এই ব্রেনকে ব্যবহার করে। এজন্যে প্রথমে আমাদের ব্রেনের সক্ষমতার ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস রাখতে হবে। এরপর দরকার হবে প্রয়োজনীয় মাইন্ডসেট। আসলে ‘নিয়ত’ কে আমরা মাইন্ডসেট বলতে পারি। আপনি জীবনে কী চান সেটা পরিষ্কার থাকতে হবে। তাহলেই সেই চাওয়াটি ব্রেন বাস্তবায়ন করতে পারবে। যদি চাওয়ার ব্যাপারে সংশয়ী হন, তাহলে ব্রেনও সংশয়ী হবে এবং আপনার জন্যে বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। তারপর আপনার ইতিবাচক মাইন্ডসেট, লক্ষ্য বা প্রোগ্রামকে ব্রেনে পৌঁছাতে হবে তার নিজের ভাষায়। ব্রেনের ভাষা হচ্ছে কল্পনা বা মনছবি। এই ছবির সাথে ইতিবাচক আবেগ যুক্ত থাকতে হবে।

এই মনছবি ও মাইন্ডসেট ঠিক করার পরে একে মস্তিষ্কে পৌঁছানোর জন্যে দরকার পরিবেশ। সেই পরিবেশ সৃষ্টি হবে মেডিটেশনের মাধ্যমে। শক্তিশালী অবচেতন মনে পাঠানো প্রোগ্রামই ব্রেন বাস্তবায়ন করবে। মেডিটেশনে আমরা আমাদের মনকে সেই অবস্থায় স্থির করতে পারি যেখানে যে-কোনো চিন্তা-ভাবনা, ছবি মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে তা বাস্তবায়নের জন্যে। ক্রমাগত পাঠানো অটোসাজেশনও মস্তিষ্কে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারে। এজন্যে আমরা বলছি-ভাবুন, বিশ্বাস করুন, অর্জন করুন।

মানুষ যখনই সমস্যায় পড়েছে সে তার এই মস্তিষ্ককে ব্যবহার করেছে এবং সমস্যাকে জয় করেছে। ছোট্ট উদাহরণ দেই। ধরুন মানুষ দেখল যে, সে ঘোড়ার মতো দৌড়াতে পারে না। সে কী করল? বুদ্ধি করে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসল যে, তুই দৌড়া, আমি বসে থাকি। যখন দেখল ওটাতে অত আরাম নাই, চাকা বানাল। ঘোড়ার সামনে লাগিয়ে দিল যে তোরা দৌড়া, আমি শুয়ে থাকি। মানুষ দেখল সে পাথর ভাঙতে পারে না। হাতুড়ি বানাল, পাথর গুঁড়া করে ফেলল। সে দেখল যে, না-পাহাড় তার সামনে। সে যেতে পারছে না। ডিনামাইট বানাল। পাহাড় গুঁড়িয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে পথ করে নিল।

অর্থাৎ মানুষ তার সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে জয় করেছে এই মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে। আর মেডিটেশন মস্তিষ্কটাকে ঠান্ডা রেখে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করার পথই করে দেয়। যখনই আপনি মস্তিষ্ককে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করতে পারবেন আপনি আপনার সমস্যাকে নতুন সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করতে পারবেন। কল্যাণ, প্রশান্তি, সুস্বাস্থ্য ও সাফল্যে ভরে উঠবে জীবন।
কেআই//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি