ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

মহামারীর এ মৃত্যুর মিছিল থামবে

গোলাম সারোয়ার

প্রকাশিত : ২২:২১, ১৩ এপ্রিল ২০২০

বিশ্বে করোনায় মৃত্যুর হার কমছে। টানা চারদিন ধরে এই কমতি চলমান আছে। আমরা চারদিনের সারণী দেখি নিই। ৯ এপ্রিল সারাবিশ্বের মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ৭,২৩৪ জন। ১০ এপ্রিল তা হয় ৬,৯৭৩ জন। ১১ এপ্রিল তা হয় ৬,০৯২ জন এবং গতকাল ১২ এপ্রিল তা’ এসে থামে ৫,৪১৪ জনে। এই হিসাব যদি ঠিক থাকে, তবে তা শূন্যে কাছাকাছি চলে যেতে খুব বেশি দেরি হবেনা।
 
এখন পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্ত রোগী ১৮,৫৩,১৫৫ জন এবং মোট মৃত্যু হলো ১,১২,২৪৭ জন। মৃতদের ভিতরে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানী, ব্রিটেন, চীন, ইরান, তুরস্ক, বেলজিয়াম,নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, সুইডেন, পর্তুগাল এবং ব্রাজিল--এই ষোলটি দেশের ১,০৭,০৩৭ জন আর বাকী বিশ্বের প্রায় দু'শটি দেশের মোট মৃত্যু হলো ৫,২১০ জন। মৃত্যুর হারের দিক দিক দিয়ে পৃথিবীতে মোট মৃত্যু হচ্ছে ইউরোপে এবং একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হলো যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির মোট মৃত্যু এখন পর্যন্ত ২২,১০৫ জন। আক্রান্তের দিক দিয়েও দেশটির লোকসংখ্যা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত(১৩/০৪/২০২০) আক্রান্তের সংখ্যা হলো ৫,৬০,৩০০ জন।

ইউরোপে মোট মৃত্যু হয়েছে ৭৬,৭৬৮ জন মানুষের। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, সমস্ত ইউরোপ কিন্তু একসাথে একভাবে আক্তান্ত হয়নি। ইউরোপে মোট দেশহলো পঞ্চাশটি আর ছয়টি আছে সীমিত স্বীকৃতির দেশ। তার ভিতরে পনেরটি দেশের মৃত্যু হলো ৭৫,৪৮৬ জন আর বাকী প্রায় ৩৫টি দেশের মোট মৃত্যু হলো ১,২৮২ জন! এশিয়ার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, এখানেও ঠিক প্রায় একই রকম অংক। এশিয়াতে মোট রাষ্ট্র আছে ৪৯টি এবং সীমিত স্বাধীনতা ভোগ করেন এমন অধীন দেশ আছে ৫ টি। এশিয়ায় এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১১,০০২ জন মানুষের। তার ভিতরে ১০ টি দেশের মৃতের সংখ্যা ১০,৫৪৩ জন, আর বাকী ৩৯টির বেশি দেশের মোট মৃত্যু হলো ৪৫৯ জন!

আফ্রিকার দিকে তাকালে এবারের মহামারীতে আমাদের আশাবাদী হতে হয়। এই মহাদেশের অধিকাংশ দেশ হলো দরিদ্র এবং সেখানে বেশিরভাগ দেশের সামাজিক সুরক্ষা অত্যন্ত দুর্বল। আফ্রিকাতে মোট দেশ হলো দেশ হলো ৫৪ টি। এই ৫৪টি দেশের মোট মৃত্যু হয়েছে ৭৯১ জনের, তার ভিতরে ১০টি দেশের মৃতের সংখ্যা ৬৯৭ জন, আর বাকী ৪৪টি দেশের মোট মৃত্যু হলো ৯৪ জন মানুষ!

উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মিলে মোট দেশ হলো ৩৬ টি। এই ছত্রিশটি দেশের করোনাভাইরাসে মারা গেছেন মোট ২৫,৫৫৭ জন। তার ভিতরে দশটি দেশের মারা গেছেন ২৫,২৯৬ জন এবং এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মৃতের সংখ্যা হলো ২২,১০৫ জন! অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড যে মহাদেশে অবস্থিত তাকে বলে ওশেনিয়া। ওশেনিয়া মহাদেশের ৬ টি দেশে মোট মানুষ মারা গেছেন ৬৩ জন মানুষ। 

পৃথিবীতে কোরানাভাইরাসের কারণে হঠাৎ সৃষ্ট এই মহামারী নিয়ে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ বলছে এটি চায়নার তৈরি যা তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করছে। চায়নারা বলেছিলো, এটি যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা তাদের দেশে ছড়িয়েছে। কেউ বলছে, এটি চায়নিজ বন্যপ্রাণী বিক্রির বাজার থেকে ছড়িয়েছে, আবার কেউ কেউ বলছে এটি চীনের জীবাণু গবেষণাগার থেকে লিক হয়ে বের হয়ে পড়ে। 

অভিযোগ যাই হোক না কেন, আমরা এই ভাইরাসের একটি রাজনৈতিক চরিত্র এখনো দেখতে পাই। আর তা’ হলো, এটি পৃথিবীর সেসব উন্নত দেখে তাণ্ডব দেখাচ্ছে, যেসব দেশ বিশ্বরাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয়। বাকী বিশ্ব এখনো এক রকম নিরাপদে আছে। আমরা দেখতে পাই, পৃথিবীর প্রায় পঞ্চাশটি দেশে এই ভাইরাসে এখনো একজন মানুষও মারা যায়নি। আর উন্নত বিশ-বাইশটি দেশ বাদ দিলে বাকীদের প্রাণহানি খুবই কম। 

পৃথিবীর রাজনীতি গত শতাব্দী থেকে দুই ব্লকে বিভক্ত। পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী ব্লক। গত শতাব্দীর নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার ফলে সাম্যবাদী বিশ্বের একরকম পরাজয় হয়। তখন থেকে পৃথিবী শাসিত হচ্ছে এক মেরু থেকে, যার কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্র আর যাদের সহযোগী শক্তি হলো ইউরোপ, যা ন্যাটোর মাধ্যমে যূথবদ্ধ। আমরা দেখতে পাই, সেসব দেশেরও যেসব শহরগুলো অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র সেগুলোতেই প্রাণহানি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হচ্ছে নিউইয়র্কে, যুক্তরাজ্যে খারাপ অবস্থা লন্ডনে এবং ইতালির তাণ্ডব যাচ্ছে উত্তর ইতালিতে যা হলো দেশটির অর্থনীতির শক্তিকেন্দ্র।

মধ্যযুগের পর, গত তিন দশকে একমেরুর বিশ্বে আরেক শক্তি মাথাছাড়া দিয়ে উঠে, আর তা হলো ধর্ম। এবারের মহামারী আশ্চর্যজনকভাবে আঘাত করে ন্যাটোর নেতৃত্বের দেশগুলোতে এবং ধর্মের কেন্দ্রগুলোতে। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, বহু শতাব্দী পর পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রধান ধর্মগৃহ আজ বন্ধ। মানুষ বিশ্বাসের এরকম চ্যালেঞ্জে বহু বছর পড়েনি। কেন আজ বিশ্বরাজনীতির নেতৃত্বের কেন্দ্রগুলো আর ধর্মকেন্দ্রগুলো অস্তিত্বের সংকটে লড়ছে !

এর কারণ হলো, মানব ইতিহাসের ধারাপাত। মানুষের ভিতরে সুপ্রিমেসি কাজ করে। প্রতিটি মানুষ চায় অন্যরা তাকে সমীহ করুক, তার দর্শন মেনে চলুক, অন্যদের পরিত্রাতা হিসেবে সেই থাকুক। মানুষ নিয়েই জাতি, তাই প্রতিটি জাতিরই থাকে হেজিমনি। কোন রাষ্ট্র শুধু উৎপাদন করে যাবে আর অন্যরাষ্ট্র ছড়ি ঘুরিয়ে বিশ্বের নেতৃত্ব দিবে, এটি পৃথিবীর সবজাতি মেনে নিবেনা। বিশেষ করে, যে জাতিগুলো পৃথিবীর টোটাল সাপ্লাই চেইনের সিংগভাগের যোগানদাতা তাদের মেনে নিতে কষ্ট হবে, অন্য কেউ শুধু কাগজের অর্থ ছাপিয়ে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। এগুলো বৈশ্বিক সমরবিদেরা হিসাব কষছে। 

তাঁরা আমলে নিচ্ছেন, বহু বছর পর চীনের পলিটব্যুরোর চেঞ্জ, তাঁরা আমলে নিচ্ছেন তাঁদের নিজেদের মতো বস্তুবাদীভাবে কোরান, বাইবেন নতুন করে লেখার প্রস্তাব। তাঁরা আমলে নিচ্ছে কিভাবে ইউরোপের শেয়ারমার্কেটগুলো ধ্বসে যাচ্ছে আর চাইনিজ মার্কেটগুলো উঠে যাচ্ছে। তারা হিসাবে নিচ্ছে ইউরোপীয়রা যখন শেয়ার বিক্রি করছে আতঙ্কে, চাইনিজরা তখন সেগুলো কিনছে আনন্দে এবং ডলার যখন আস্থা ও মূল্য হারাচ্ছে তখন উঠে আসছে উয়েন।   

আমরা মূলত বলতে পারি, আগুন ছাড়া যেমন ধোঁয়া হবেনা, কারণ ছাড়াও তেমনি কোন কার্য হবেনা। আমরা ইতোমধ্যে দেখছি, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ব্রিটেন যেভাবে বিশ্বরাজনীতিতে চুপসে যেতে থাকে আর ডলারের মুখোমুখিতে পাউন্ড নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে, তেমনি এবার যুক্তরাষ্ট্র আর তাদের ডলারের অবস্থাও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। ইতোমধ্যে দেশটিতে বেকার হয়ে পড়েছে অন্তত ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ।

বিশ্বের যখন এ অবস্থা তখন আসি নিজেদের হিসাবে। গত চব্বিশ ঘন্টাতে ১৮২ জন শনাক্ত হয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের রোগীর সংখ্যা হয়েছে ৮০৩ জন। আমরা দেখছি, আমাদের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত চব্বিশ ঘন্টাতে পাঁচ জন সহ আমাদের মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ৩৯ জনে। আমাদের ভয় হলো আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। আসলে যত টেস্ট বাড়বে তত রোগীর সংখ্যাও বাড়বে। টেস্ট বাড়লে আমাদের সুরক্ষার স্ট্যাটেজিও বাড়বে। তাই ভয় পেলে চলবেনা।

বিশ্বে যখন দুই মিলিয়নের মতো মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেছে, তখন আমরা পৃথিবীর বাইরের কোন দেশ নয়। তবে আশার কথা হলো, আমাদের এখানে মৃত্যুর সংখ্যা এখনো ব্যাপক নয়। তবে একজন মানুষের অকাল মৃত্যুও বেদনার। সে জন্যে আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে, প্রাণহানি যত কমানো যায়। সে মতে আমাদের চলতেও হবে। 

প্রশ্ন আসতে পারে, করোনা মহামারী যদি রাজনৈতিক কারণে হয়, তাহলে আমাদের এখানে রোগী বাড়বে কেন! এর উত্তর হতে পারে, দুই শক্তিশালী পক্ষ যখন যুদ্ধ করে তখন এর সাইড ইফেক্ট হিসেবে কিছু নিরপেক্ষ মানুষও ক্রসে পড়ে যেতে পারেন। এর ভিতরে কেউ পড়ে যাবেন ভাগ্যের ও অবস্থানের কারণে, কেউ পড়ে যাবেন অসচেতনতার কারণে। 

করোনা ভাইরাস প্রাকৃতিক হলে আমরা ইতোমধ্যে তার অনেক ফেভার পেয়েছি। আর যদি তা’ রাজনৈতিক হয়, তাহলে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আমরা যেন ক্রসে পড়ে না যাই। এখানো আমরা সচেতন হলে আমাদের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। অন্তত ইউরোপ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা আমাদের দেশে হওয়ার সম্ভাবনা নেই। 

করোনাভাইরাস চীনের উহানে প্রথম ধরা পড়ে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে। চীনের সাথে আমাদের আমদানী-রপ্তানী, প্রকল্পে অর্থায়ন ও বাস্তবায়নসহ নানান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক থাকার কারণে আমাদের সাথে তাদের ছিলো ব্যাপক যোগাযোগ। হিসাব মতে তাই আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ হওয়ার কথা সেই জানুয়ারী মাস থেকেই। তারপরও আমরা অসচেতনভাবে বহু সময় পার করেছি। আমরা লকডাউনের নিয়মগুলো ঠিকমতো মানিনি। তবুও আমাদের ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক হয়নি। কিন্তু এখন আমাদের হাতে আর তত সময় নেই। 

এখন আমাদের সরকার ঘোষিত নিয়মগুলো মানতেই হবে। এছাড়া আমাদের আর উপায় নেই। সুতরাং আমাদের ঘরেই থাকতে হবে। আমরা দেখছি, সমস্ত বিশ্বেই এই মহামারীর প্রকোপ কমে আসছে, তারমানে লকডাউনে কাজ দিচ্ছে। 

এর ভিতরে একটি ভালো খবর হলো, চীন সরকারের ভাইরাস কন্ট্রোল দলের প্রধান ডঃ ঝং নানশেন দাবি করেন, আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে পুরো বিশ্বের করোনা ভাইরাসের নতুন কেস আসা কমবে। যেহেতু তাঁদের দেশই করোনার উৎসস্থল এবং তাঁরাই এটি সবার আগে হ্যান্ডেল করে নিয়ন্ত্রণে এনেছেন এবং বিশ্বে করোনায় মৃতের সংখ্যা কমে আসছে, তাই আশা করা যায়, আগামি মাসের ভিতরেই এই মহামারী কমে আসবে। সে পর্যন্ত আমাদের সচেতনভাবে ঘরে থাকতে হবে। 

গোলাম সারোয়ার-গবেষক ও কলামিস্ট।  

আরকে//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি