মানসিক সমস্যা বাড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া!
প্রকাশিত : ১৩:৩৩, ৩০ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ১৩:৩৯, ৩০ আগস্ট ২০২০
বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ৩৭ হাজার নতুন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যোগ হচ্ছে। নতুন ব্যবহারকারীদের কাছে ইন্টারনেট বলতে ফেসবুক, কথা বলতে ইমো, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ ও বিনোদন বলতে ইউটিউব। এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং বিরূপ ছোয়ায় পৃথিবী যেন এক আবেগ শূন্য প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। এছাড়া ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি কিশোর-যুবকদের মধ্যে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
ভারতের এইচওডি সাইক্রিয়াট্রি অ্যান্ড চিফ ন্যাশনাল ড্রাগ ডিপেনডেন্স ট্রিটমেন্ট সেন্টারের (এনডিডিটিসি) বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর ও যুবকদের মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারে আসক্তি বাড়ছে। তা থেকে তারা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে।
গত বছরের শুরুর দিকে অনলাইনে হয়রানি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনকারীদের কবল থেকে ৩২ শতাংশ বাংলাদেশী শিশুদের রক্ষার আহ্বান জানিয়েছিল ইউনিসেফ। ইউনিসেফের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিলো, ‘বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইন সহিংসতা, অনলাইনে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ডিজিটাল উৎপীড়নের শিকার হওয়ার মতো বিপদের মুখে রয়েছে।’
এছাড়াও বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ব্যাপকহারে বাড়ছে। ২০০০ সাল থেকে এই সংখ্যা ৮০০ গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশে অনলাইন জনগোষ্ঠীর গড় বয়স ক্রমেই কমছে। এমনকি ১১ বছরের শিশুরাও প্রতিদিন ইন্টারনেটে প্রবেশ ও ব্যবহার করছে। যদিও ছোট শিশুদের তুলনায় বেশি বয়সী শিশুরা অনলাইনে ভয়ভীতির সম্মুখীন হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকে। তবে ক্ষতিকর সামগ্রী, যৌন নিগ্রহ ও অপব্যবহার এবং ভয়ভীতির সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকি থেকে শিশুরা কখনোই মুক্ত নয়।
রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক লিও টলস্টয় বলেছিলেন, মানুষের জীবনে শুধুমাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন, ‘বই, বই এবং বই।’ কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের কাছে যে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন অত্যধিক তা হলো, ‘অনলাইন, অনলাইন এবং অনলাইন।’
অনলাইন ব্যবহৃত কিছু দুর্জনের বিষাক্ত ছোবলে একটি পরিবার, একটি সমাজ এবং একটি রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত জর্জরিত হচ্ছে বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ধীরা ঢালী।
তিনি বলেন , ‘আমিও একটি পরিবারের সন্তান। অনলাইন জগতের সঙ্গে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। তবে অল্প দিনের এই পরিচয়ে আমার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। অনলাইন জগতের রঙিন ছোঁয়ায় মানুষের বিবেক, মনুষ্যত্ব, সহমর্মিতা সবই যেন মহামারিতে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞানের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার পৃথিবীকে যেন এক আবেগ শূন্য প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত করেছে। তবে এখনও আশার আলো দেখতে পাই, আমরা যদি স্ব স্ব অবস্থান থেকে সচেতনতা অবলম্বন করি তাহলে আবারও এক সুখী, সমৃদ্ধ এবং সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে পারবো।’
এ বিষয়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক আফরোজা সিদ্দীকা বলেন , ‘একটা সময় ছিল যখন পরিবার এর সবাই একসঙ্গে খেত টেলিভিশন দেখতো, গল্প করতো। বাসায় একটাই টেলিফোন থাকতো। এখন প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ফোন। বাসায় ফিরে যে যার ঘরে ফোন বা নেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে বাস্তব জীবনে কাছের মানুষ গুলো দুরে চলে যাচ্ছে। বর্তমানে অসংখ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকলেও ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটার,ইন্সট্রাগ্রাম,স্কাইপ ইত্যাদিই বেশি জনপ্রিয়।’
সহজলভ্য এ সকল যোগাযোগ মাধ্যমের ভিড়ে প্রিয় বন্ধনগুলো আস্তে আস্তে গৌণ হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করতে গিয়ে আফরোজা সিদ্দীকা আরও বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে যেমন পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পাচ্ছি। নিজের কথা নিজের কোন মুহূর্ত ভাগাভাগি করতে পারছি। কিন্তু অনেক নেতিবাচক দিকও দেখতে পাচ্ছি। আমরা সামাজিকতা ও সৌজন্য বোধ হারাচ্ছি। আমরা যতই যান্ত্রিক জীবনযাপন করছি ততই আমাদের প্রিয় বন্ধনগুলো আস্তে আস্তে গৌন হয়ে যাচ্ছে। বাসায় এক সাথে থাকলেও প্রিয়জনদের সাথে সময় দেয়া এবং আন্তরিকতার সাথে কথা বলা পর্যন্ত হয় না। বেশির ভাগ মানুষের সময় কাটে স্যাটেলাইট চ্যানেল এবং অপ্রয়োজনীয় টুইটারিং, ফেইসবুকিং বা উদ্দেশ্যহীন নেট সার্ফিং করে। আসলে এই ভার্চুয়াল যোগাযোগ আমাদের কে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে পরিবার থেকে সমাজ থেকে।’
তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘ভার্চুয়াল দুনিয়ায় অতিরিক্ত সময় কাটানোর ফলে কিশোরেরা বাস্তব থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হয়। তারা একটি কাল্পনিক জগৎ গড়ে তোলে এবং তাতে নিজেকে মানিয়ে নেয়। ১৪ থেকে ২৫ বছর বয়সী কিশোর ও যুবকদের ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যার ঝুঁকি বেশি দেখা যায়।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরূপ প্রভাব থেকে সমাজকে কিভাবে রক্ষা করা যায় এমন প্রশ্নের জবাবে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক তাহমিনা সুলতানা বলেন , ‘অনলাইন যোগাযোগ এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে একে বাদ দেওয়া যাবে না। তবে সারাক্ষণ অনলাইনে না থেকে সময় ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। সামাজিক কোনো আচার-অনুষ্ঠানে এসব যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার না করে আপনজনদের সাথে ভালো সময় কাটানো যেতে পারে। অনেক অচেনা মানুষের সাথে বন্ধুত্ব গড়ার থেকে, চেনা বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা বেশি জরুরি।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো জীবন নয় বরং জীবনের ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র উল্লেখ করে তাহমিনা সুলতানা বলেন , ‘অভিভাবকদের সন্তানদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। অনলাইন জগতের রঙ্গিন দুনিয়ায় আমরা অন্ধ হয়ে থাকলেও বাস্তব পৃথিবীটা তার থেকেও অনেক সুন্দর ও বড়। তাই সন্তানদের নিজস্ব, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলো জীবন নয়, জীবনের ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। তাই আসক্তি পরিহার করে কার্যকর যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারলেই একে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলা যেতে পারে নয়তো একে অসামাজিকতা তৈরির হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করায় শ্রেয়।’
এমবি/
আরও পড়ুন